ঢালচর (মনপুরা, ভোলা) ঘুরে এসে: কোস্টগার্ডের কোস্টাল ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট সেন্টার (সিসিএমসি) স্থাপনের খবরে যে দ্বীপে স্বস্তি ফিরে এসেছিল, সে দ্বীপে এখন নেমে এসেছে দস্যু আতঙ্ক।
পুরানো সেই ভয়ের এখন জনপদ পরিণত দুর্গম দ্বীপ।
শুধু ডাকাতি বা লুণ্ঠন নয়, রাতের আঁধারে নারীদের তুলে নেওয়ার ঘটনা ঘটে বলেও অভিযোগ করেছেন বাসিন্দারা।
দুর্গম এই জনপদের নাম ঢালচর। অবস্থান দ্বীপ জেলা ভোলার মনপুরা উপজেলায়। জেলা কিংবা উপজেলা সদর থেকে অনেক দূরের দ্বীপ ঢালচরের বাসিন্দারা সারাক্ষণই নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন।
পাশের একাধিক চরে দস্যুদের আস্তানা থাকায় চরবাসীর ভয় আরও বেশি। এ বিষয়টি বিবেচনায় রেখেই ঢালচরে সিসিএমসি স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছিল কোস্টগার্ড। সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার পর এটি প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে।
স্থানীয়রা বলছেন, কোস্টগার্ডের কেন্দ্র প্রত্যাহার করায় বঙ্গোপসাগরের উত্তর মোহনার মেঘনার নোয়াখালীর হাতিয়া ভোলার মনপুরা ও তজুমদ্দিনের প্রায় ২০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় জেলে ও মৎস ব্যবসায়ীদের মাঝে এখন দস্যু আতঙ্ক বিরাজ করছে।
হাতিয়া, তজুমদ্দিন ও মনপুরা উপজেলা সীমানার মধ্যে প্রায় ১০টি চর ও বনবিভাগের আটটি ম্যানগ্রোভ বন রয়েছে।
জলদস্যুরা এই দুর্গম এলাকায় মাছধরা ট্রলারসহ জেলেদের অপহরণ করে এইসব বন ও চরে নিয়ে যায়। জেলেদের কাছ থেকে আদায় করে মোটা অংকের মুক্তিপণ। দস্যুদের তাণ্ডব ঠেকাতেই ঢালচরে সিসিএমসি স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছিল কোস্টগার্ড।
২০১৪ সনে ঢালচরে সিসিএমসি স্থাপনের লক্ষ্যে কোস্টগার্ডকে আট একর জমি দান করেন মনপুরা উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন চৌধুরী।
যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অর্থায়নে শুরু হয় নির্মাণ প্রক্রিয়াও। সিসিএমসি নির্মাণের জন্য দান করা জমি কোস্টগার্ডের নামে নামজারিও হয়েছে। কিন্তু হঠাৎ করে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ঢালচর থেকে সিসিএমসি স্থানান্তর করা হয় পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলার রামনাবাদ এলাকায়।
সিসিএমসি প্রত্যাহারের খবর জানার পর ঢালচরসহ আশপাশের এলাকার মানুষের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। ঢালচরের জেলে-কৃষকেরা কয়েক দফা বিক্ষোভও করেছেন।
বিক্ষোভকারীরা বলছেন, হাতিয়া, তজুমদ্দিন ও মনপুরায় কোস্টগার্ডের স্টেশন থাকার পর এ তিন উপজেলার মধ্যবর্তী ঢালচরে ২০১৩ সনে কোস্টগার্ডের সিসিএমসি স্থাপন করার কথা বলা হয়। এরপর গত দু’বছরে এই এলাকায় জলদস্যুতা এক তৃতীয়াংশ কমে এসেছিল।
কোস্টগার্ডের সিসিএমসি স্থানান্তরের নেপথ্যে প্রভাবশালী মহলের অশুভ ইঙ্গিত রয়েছে বলে অভিযোগ করেন এলাকাবাসী।
মনপুরা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আবুল কাশেম হাওলাদার ও বর্তমান ইউপি সদস্য মাহাবুবুল ইসলাম নিক্সন বলেন, ঢালচরে সিসিএমসি থাকলে জলদস্যুদের গডফাদার, বনের গাছ চোর আর চরের ধান লুটেরাদের খুব সমস্যা হয়। তাদের সঙ্গে জড়িত সংশ্লিষ্টরাই উপর মহলে তদবির করে সিসিএমসি সরিয়েছে।
‘আসছে মাছের মৌসুম কিংবা পরবর্তী ধানের মৌসুমে দস্যুতা ফের আগের অবস্থা ধারণ করবে,’ যোগ করেন তারা।
সরেজমিনে ঢালচরের নারী-পুরুষের কাছ থেকে মিলেছে দস্যুদের অত্যাহারের লোমহর্ষক সব কাহিনী।
প্রায় ৫০ বছরের পুরানো এই দ্বীপে অন্ততপক্ষে তিন হাজার মানুষের বাস। এরমধ্যে অধিকাংশই জেলে ও কৃষি কাজে জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন।
কিন্তু মাছের মৌসুম এলে তাদের আতঙ্ক-উৎকন্ঠায় কাটাতে হয়। বিশেষ করে দ্বীপের নারীরা সারাক্ষণ নিরাপত্তাহীনতায় থাকেন। চরের বিধবা নারী সকিনা বিবি দশ বছরে চারবার দস্যুদের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। আজও বিচার পাননি তিনি।
নির্যাতনের বর্ণনায় সকিনা বলেন, তিনবছর আগে একদল ডাকাত আমার বাড়িতে হানা দেয়। চোখ-মুখ বেঁধে তুলে নিয়ে যায়। মেঘনার উপকূলবর্তী জাগলার চরে আটকে রেখে টানা ১৪ দিন নির্যাতন করে। এক পর্যায়ে কৌশলে ডাকাতদের কবল থেকে পালিয়ে আসি। ’
শুধু সকিনাই নন, তার মতো আরও অনেক নারী দস্যুদের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। প্রায় একইভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন মোতাহারের স্ত্রী মাইনুর।
তাকে দুইবছর আগে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায় ডাকাতরা। এখনও তার সন্ধান মেলেনি। স্ত্রীকে না পেয়ে এরইমধ্যে স্বামী মোতাহার দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন। কিন্তু দ্বিতীয় স্ত্রীর নিরাপত্তা নিয়েও আতঙ্কিত মোতাহার।
ডাকাতের হাতে আরেক অপহৃত নারী মন্নানের স্ত্রী আমেনা (৪০) জানান, গত বছর মাছ ধরার মৌসুমে তাকেসহ পরিবারের সাত সদস্যকে তুলে নিয়ে যায় ডাকাতরা। তাদের সামনেই ৪/৫টি নারীকে ধর্ষণ করে ডাকাতরা।
ডাকাতদের নির্যাতনে রিনা (১৩) নামের এক কিশোরী মারা যান।
মহিউদ্দিনের স্ত্রী মহিমাকেও তুলে নিয়ে যায় ডাকাতরা। চলে রাতভর নির্যাতন। পরে ডাকাতদের হাত থেকে ছাড়া পান তিনি।
ঢালচরের বাসিন্দা গৃহবধূ রোকসানা বেগম বলেন, দিনে ডাকাতি আর রাতে নারী নির্যাতন। ঘরে কোনো নিরাপত্তা নেই। ডাকাতদের ভয়ে রাতের বেলায় ঘর ছেড়ে বাগানে আশ্রয় নিতে হয়।
‘কোস্টগার্ড থাকায় আমাদের কোনো ভয় ছিল না। সামনের মাছের মৌসুমে আবার দস্যুতা শুরু হবে! আমাদের ঘুম কেড়ে নেবে ডাকাতরা। চরের সব নারীরা সারাক্ষণ থাকবে নিরাপত্তাহীনতায়,’ বলেন তিনি।
চরের বাসিন্দা জরিনা বেগম বলেন, গরীবের টাকা পয়সা নেই, আছে ইজ্জত। ডাকাতরা তাও কেড়ে নিতে চায়। ডাকাতদের ভয়ে অনেকেই গ্রাম ছাড়া। ভয়ে কেউ মুখ খুলে না। প্রতিবাদ করার সাহস নেই কারো। ডাকাত দমন না হলে চরে কোনো মানুষ থাকতে পারবে না।
চরের আরেক বাসিন্দা বেলায়েত হোসেন (৭০) বলেন, চরে বেশ কিছু লাঠিয়াল ও দস্যু রয়েছে। তারা চরে গরু লুট করে। জেলেদের মাছ ও ট্রলার লুট করার পর অপহরণ করে নিয়ে যায় জেলেদের। মুক্তিপণ পেলে তাদের ছেড়ে দেয়।
ডাকাতের কবলে পড়া বৃদ্ধ আবদুর রব হাওলাদার বলেন, নদীতে মাছ শিকার করতে গিয়ে দুইবার ডাকাতের কবলে পড়েছি। পরে মহিষ বিক্রির টাকা দিয়ে ছাড়া পেয়েছি।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঢালচরে জনবসতি গড়ে উঠলেও শান্তি ফিরেনি। লাঠিয়াল, জোরদার, ভূমি দস্যু ও ডাকাতদের কারণে চরে অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে।
তবে এধরনের অনেক ঘটনা প্রশাসনের নজরে পৌঁছায় না। অসহায় জেলেরা সব হারালেও দস্যুদের নির্যাতন বন্ধ হয় না। আসছে মাছ ধরার মৌসুম নিয়ে বেশ চিন্তিত চরের মানুষ।
জানতে চাইলে কোস্টগার্ড দক্ষিণ জোনের জোনাল কমান্ডার ক্যাপ্টেন কাউসার আলম জানান, মন্ত্রণালয় ও সদরদফতরের নির্দেশে ক্যাম্প তুলে নেওয়া হয়েছে।
মনপুরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এরশাদ হোসেন খান বাংলানিউজকে জানান, ঢালচরে অনেক সমস্যা আছে। তবে এ মুহূর্তে চরবাসীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি। বিষয়টির সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে পুলিশ ক্যাম্প স্থাপনের বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হবে।
ভোলা জেলা প্রশাসক মো. সেলিম রেজা জানান, চরের জমি নিয়ে সমস্যা দেখা দেওয়ায় কোস্টগার্ডের সিসিএমসি সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
তবে চরের মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে প্রশাসন সব সময় সজাগ রয়েছে বলে জানান তিনি।
[ পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোন খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: [email protected] ]
বাংলাদেশ সময়: ০৩২৭ ঘণ্টা, মার্চ ২২, ২০১৫