ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

উপকূল থেকে উপকূল

উপকূলে সংকটে শৈশব-৪

প্রান্তিকের ‘মীনা’, অনিশ্চয়তায় বেড়ে ওঠা জীবন

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০২৩ ঘণ্টা, এপ্রিল ৪, ২০১৫
প্রান্তিকের ‘মীনা’, অনিশ্চয়তায় বেড়ে ওঠা জীবন ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

হাজারো সংকটে উপকূলের শৈশব। এ এক অন্যরকম বেড়ে ওঠা।

এখানে শৈশব ডানা মেলে অপুষ্টি আর অশিক্ষায়। দূরন্তপনার রেশ কাটতে না কাটতেই কর্মজীবনের সূচনা। কাঁধে ভর করে ভারি কাজের বোঝা। শৈশবের রঙিন স্বপ্ন ওদের জীবনকে আলোড়িত করে না। দারিদ্র্যের বেড়াজাল নিয়ে আসে বঞ্চনার পর বঞ্চনা।

শিশু অধিকারের বার্তা ওদের কাছে অর্থহীন। পেটভর্তি খাবারের আয়োজনটা ঠিকঠাক না থাকলেও হাড়ভাঙা পরিশ্রমটা পুরো মাত্রায়। উপকূলের প্রান্তিক জনপদের শিশুদের সংকটের আদিঅন্ত অনুসন্ধানের মাধ্যমে বাংলানিউজ তৈরি করেছে ‘উপকূলে সংকটে শৈশব’ শীর্ষক ছয় পর্বের ধারাবাহিক। আজ পড়ুন চতুর্থ পর্ব...

উপকূলের প্রান্তিক জনপদ ঘুরে এসে: স্কুলে যাওয়ার বদলে মাছ ধরতে যায় কিশোরী। হৈ-হুল্লোড় করার এই বয়সটাতে তাকে সাজতে হয় বধূ। দারিদ্র্যের ছোবল বহু কিশোরীকে পেরোতে দেয় না স্কুলের গণ্ডিটাও। বাবার সংসারে অধিক খাটুনির ভারে পুষ্টিকর খাবার গ্রহণের সুযোগটুকুও মেলে না। আর সে অবস্থায় বাবার ঘর থেকে ‘কিশোর স্বামীর’ ঘরে পা ফেলতে হয়। কন্যা শিশুদের এই বৈষম্য শুরু হয় শৈশব থেকেই।

দেশের দক্ষিণে উপকূলের দুর্গম জনপদে ‘মীনা’দের চিত্র এমনই। কন্যা শিশুদের প্রতি সব বৈষম্য দূরীকরণে বিশ্বজুড়ে ‘মীনা আর রাজু’ সচেতনতামূলক তথ্য প্রচার করলেও উপকূলের হাজারো ‘মীনা’র কাছে সে তথ্য পৌঁছেনি। কোনো বার্তাই জানে না তারা। এমনকি এ অঞ্চলের অভিভাবকেরাও এসব তথ্যের বিষয়ে ততটা সচেতন নয়। আর তাইতো উপকূলের প্রান্তিক জনপদে ‘মীনা’দের চোখে পড়ে বিচিত্র চেহারায়।

মেয়েশিশুদের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বদলের প্রতীকী চরিত্র ‘মীনা’র জন্ম ১৯৯২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর। সেই থেকে বিশ্বজুড়ে কন্যা শিশুদের প্রতি বৈষম্য দূরীকরণের অন্যতম চরিত্র হিসাবে ‘মীনা’কে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়েছে ইউনিসেফ। বিভিন্ন বিষয়ে কার্টুন চরিত্রে মীনা জানাচ্ছে সচেতনতার কথা, মেয়ে শিশুদের এগিয়ে যাওয়ার কথা। ইউনিসেফ কার্টুনের এই মীনার ভূমিকা দেশের উপকূলে কতটা প্রভাব ফেলেছে, বাংলানিউজ তারই খোঁজ করেছে সরেজমিন অনুসন্ধানে।

ভর দুপুরে দ্বীপ জেলা ভোলার চর নিজামের দুই বোন কিশোরী সুমী আক্তার ও সাথী আক্তার জাল নিয়ে ছুটছিল নদীতে মাছ ধরতে। বাবা আবুল বাসার যাচ্ছেন আরেকটি বড় জাল নিয়ে। মীনাকে কখনো দেখেছে কি না? এমন প্রশ্ন করতেই দুই কিশোরী অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। কিছুই বলতে পারলো না। ওদের বাবা বললেন, ‘কী করমু? পেট তো চালাইতে পারি না। মাইয়াগো স্কুলে দিমু ক্যামনে?’।

ভোলার দ্বীপ কলাতলীর নূর ইসলামের মেয়ে রাফেজা বেগম। দ্বিতীয় শ্রেণি পড়ে লেখাপড়া বন্ধ। বয়স ১৪ পেরিয়েছে। ঘরের কাজ, বাইরের কাজ সবই করতে হয় ওকে। তিনবেলা ঠিকমত খাবারও জোটে না। বয়সী মেয়ে ঘরে রাখা বাবা-মায়ের জন্য কষ্টকর। তাই মেয়ের বিয়ের উপায় খুঁজছেন বাবা। রাফেজার মা আলেয়া বেগম বলেন, ‘মোরা গরিব। নদীতে জমিজমা লইয়া গ্যাছে। মাইয়া তো পড়াইতে পারছি না। ’

মীনাকে চেনে কি না, জানতে চাইলে রাফেজা জানালো মীনার ছবি দেখেছে। কিন্তু তার চরিত্র সম্পর্কে তেমন কিছু শোনেনি। তবে লেখাপড়া বন্ধ হওয়ায় ওর মন খুব খারাপ হয়েছে। ওর লেখাপড়ার প্রবল ইচ্ছা ছিল।

ভোলার দৌলতখান উপজেলার মদনপুর চরে দুপুরের প্রখর রোদটা তখন ম্লান হয়ে আসছিল। প্রায় বাড়িতে দুপুরের খাবার শেষ। কিন্তু চরের পূর্বপ্রান্তে রাখাল বালিকা সাজেদা বেগম আর শেফালী বেগমের খাওয়ার সময়টা তখনও হয়নি। একজন ধান খেতের পাশে গরু চরাচ্ছিল, অরেকজন গরুর জন্য ঘাস কেটে বাড়িতে তুলছিল। চেহারা দেখেই বোঝা যায় ওরা অপুষ্টিতে ভুগছে।

তিন মেয়ের মধ্যে কেউই লেখাপড়া করতে পারেনি, এ কথটা অবলীলায় বলে ফেললেন শেফালীর মা জয়নব বিবি। বাবা মাছ ধরে। মেয়েরা ঘরে-বাইরে কাজ করে। এক ছেলে বাবার সঙ্গে মাছ ধরতে যায়। ঘাসের আঁটি মাথায় নিয়ে ঘর পর্যন্ত আসতে হাঁপিয়ে উঠেছিল শেফালি। দিনের অধিকাংশ সময় সে এভাবেই কাজ করে। মীনা-রাজুর কোনো গল্পই শেফালির কাছে পৌঁছেনি।

‘আমি বাবা-মায়ের শত আদরের মেয়ে লেখাপড়া শিখে যাই’- মীনার এই গানের গানের সঙ্গে উপকূলের বহু ছেলেমেয়ে পরিচিত নয়। স্কুল পড়ুয়া ছেলেমেয়েরা মীনাকে কিছুটা চিনলেও যারা কখনোই স্কুলে যায়নি, তাদের কাছে এই দীর্ঘ সময়েও মীনা অচেনা রয়ে গেছে। ছেলেসন্তানকে বেশি আদর-যত্ন করার ধারণা এখনও এই অঞ্চলের পরিবারগুলোতে বিদ্যমান। কিন্তু মীনা এই প্রথা ভাঙতে চেয়েছে। সে কারণেই কার্টুনচিত্রে মায়ের অনুমতি নিয়ে মীনা ভাইয়ের সঙ্গে কাজের ক্ষেত্র পরিবর্তন করে নিয়েছিল।

মীনা কার্টুনে মীনা বুঝিয়ে দিয়েছে ছেলেমেয়ে সবাই সমান। সমাজের চোখ বদলাতে চেয়েছে মীনা। দেখানো হয়েছে একটি মেয়ে সমস্যার সমাধান করতে পারে। উপকূলের দুর্গম জনপদের পরিবারের মেয়েশিশুরাও পরিবারের সমস্যার সমাধান করে, তবে সেটা অন্যভাবে। বাবা-মায়ের সঙ্গে কঠোর শ্রম ছাড়া বুদ্ধির কৌশলে কোন কাজ করার সামর্থ্য এদের নেই। কিন্তু মীনা বুঝিয়েছে, মেয়েদের প্রতি সমাজের বৈষম্য দূর করতে লেখাপড়া জানাটা খুবই জরুরি।

‘স্কুলে যাইয়া আর হি হইবে, ঘরে থাইক্কা রান্দার (রান্না) কাজ করলে মুই গায় খাইট্টা (কাজ করে) কয়ডা টাহা কামাই করতে পারি। আর স্কুলে গ্যালে এ্যাহন অনেক টাকা লাগে হেই টাহা মোরা পামু কই। কেলাস (ক্লাস) ফোর পর্যন্ত তো ওরা পড়ছে। বইপত্র পড়তে পারে। আর কয়দিন পর বিয়া হইবে। এসব কথা বলেই কেঁদে ফেলে আসমা বেগম। পটুয়াখালীর কলাপাড়ার ধুলাসার ইউনিয়নের চর ধুলাসার গ্রামে বাড়ি আসমা ও ইসা দম্পত্তির।

পুত্র সন্তানের আশায় মাত্র ২৫ বছর বয়সে পাঁচটি কন্যা সন্তানের মা। দিনমজুর স্বামী ইসার একার উপার্জনে আট সদস্যের পরিবারে তিনবেলা খাবার জোটানো অসম্ভব। তাই আসমাকেও এখন কখনও মাঠে, কখনও অন্যের বাসায় কাজ করতে হয়। তাই দরিদ্রতার কারণে পঞ্চম শ্রেণিতে উঠলেই তার মেয়েদের লেখাপড়া বন্ধ করে দিতে হচ্ছে। আর্থিক সংকটে মেধাবী চম্পা ও রিমার লেখাপড়া এখন বন্ধ।

প্রান্তিক জনপদে কেন পৌঁছাচ্ছে না মীনার বার্তা? এমন প্রশ্নের জবাবে স্থানীয় লোকজন বলছেন গণমাধ্যম অপ্রতুলতার কথা। উপকূলের বহু স্থানে সংবাদপত্র পৌঁছায় না, টেলিভিশন দেখা যায় না। কিছু এলাকায় টেলিভিশন দেখা গেলেও বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল দেখার সুযোগ নেই। জেলা তথ্য দপ্তরের মাধ্যমে মীনা কার্টুনসহ সচেতনতামূলক বার্তা প্রচারে প্রামাণ্যচিত্র দেখানোর কথা থাকলেও তা এই প্রান্তিকে আসে না।

ভোলার দৌলতখানের মদনপুর, মনপুরা, চর নিজাম, পটুয়াখালীর রাঙাবালী, চর মন্তাজ, আন্ডার চর, বড় বাইশদিয়ার বহু মানুষের অভিযোগ, তাদের এলাকায় সরকারি প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন খুবই কম হচ্ছে। এরফলে মানুষের মধ্যে সচেতনতামূলক বার্তা খুবই কম পৌঁছাচ্ছে। অন্যদিকে এই এলাকার মানুষের অবস্থা নিয়ে গণমাধ্যমে লেখালেখিও হচ্ছে তূলনামূলক কম।

তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তথ্য দপ্তরের একাধিক কর্মকর্তার দাবি, পরিকল্পনা অনুযায়ী তারা প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনসহ অন্যান্য কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছেন। তবে দুর্গম জনপদে নিয়মিতভাবে যাওয়া তাদের পক্ষে কঠিন।                               
 
[পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোন খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: [email protected]]

বাংলাদেশ সময়: ০০২৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ০৪, ২০১৫

** পুতুল খেলার বয়সেই বিয়ের পিঁড়িতে
** প্রতিকূলে শিশুশিক্ষা, বাড়ছে ঝরে পড়া
** সাতেই হাতেখড়ি বৈঠায়

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।