ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

উপকূল থেকে উপকূল

উপকূলে সংকটে শৈশব-৫

কম ওজনে জন্ম, পুষ্টিহীনতা জীবন জুড়ে

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১৩৮ ঘণ্টা, এপ্রিল ৫, ২০১৫
কম ওজনে জন্ম, পুষ্টিহীনতা জীবন জুড়ে ছবি: বাংলা্নিউজটোয়েন্টিফোর.কম

হাজারো সংকটে উপকূলের শৈশব। এখানে শৈশবের ডানা মুখ থুবড়ে মরে অপুষ্টি আর অশিক্ষায়।

দূরন্তপনার রেশ কাটতে না কাটতেই কর্মজীবনের সূচনা। কাঁধে ভর করে ভারি কাজের বোঝা। শৈশবের রঙিণ স্বপ্ন ওদের জীবনকে আলোড়িত করে না। দারিদ্র্যের বেড়াজাল নিয়ে আসে বঞ্চনার পর বঞ্চনা। শিশু অধিকারের বার্তা ওদের কাছে অর্থহীন। পেটপুরে খাবারের আয়োজন ঠিকঠাক না থাকলেও হাড়ভাঙা পরিশ্রমটা পুরোমাত্রায় নিত্যসঙ্গী। উপকূলের প্রান্তিক জনপদের শিশুদের সংকটের আদিঅন্ত অনুসন্ধানের মাধ্যমে বাংলানিউজ তৈরি করেছে ‘উপকূলে সংকটে শৈশব’ শীর্ষক ছয় পর্বের ধারাবাহিক। আজ পড়ুন পঞ্চম পর্ব।

উপকূলের প্রান্তিক জনপদ ঘুরে এসে: মাত্র দু’বছর ৫ মাসের বাচ্চাকে নিয়ে দুশ্চিন্তার শেষ নেই রোকসানা বেগমের। শিশুটি বেড়ে উঠছে কংকালসার দেহ নিয়ে। পুষ্টিকর কোন খাবার দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। নাসিমা বেগমের ৫ মাসের ছেলে রিফাতেরও একই অবস্থা। দিনকে দিন শুকিয়ে যাচ্ছে। কোন খাবার তেমনটা খাচ্ছে না।

রোকসানা আর নাসিমা দ্বীপ জেলা ভোলার মনপুরা ঢালচরের বাসিন্দা। সন্তানদের লালন পালনে বহুমুখী সমস্যা সম্পর্কে জানাতে গিয়ে এরা জানালেন, এই চরের সব মানুষকে প্রকৃতি আর দস্যুদের লড়াই করে বেঁচে থাকতে হয়। এর ওপর তিনবেলা খাবার যোগাড়ে বহুমুখী সংকট তো আছেই।  

ঢালচরসহ এ ধরনের দুর্গম চরের মানুষের সঙ্গে আলাপ করে সহজেই অনুমান করা যায়, হাজারো সমস্যার ভিড়ে দুর্গম এই চরে সন্তান জন্মদান আর লালন পালনের মত গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়টি যেন একেবারেই গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। ফলে হাজারো সংকটের ভেতর দিয়ে বেড়ে ওঠে এইসব চরের প্রজন্ম।

সরেজমিন ঘুরে ঢালচরের বেশ কয়েকজন নারীর সঙ্গে আলাপ হয়। রোকসানা আর নাসিমার সঙ্গে যোগ দেন তারাও। গর্ভবতী মায়েদের অনেকগুলো সমস্যা তুলে ধরেন তারা। চরে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দাই নেই। তারও আগে গর্ভবতী মায়ের পরিচর্যার বিষয়ে নেই কোন ধরনের সচেতনতা। পুষ্টিকর খাবার তো জোটেই না, বরং গর্ভাবস্থায় মায়েদের সাংসারিক কাজে খাটুনির মাত্রাও কোন অংশে কমে না। গর্ভবতী মায়েদের জরুরি সেবা পাওয়ার তো কোন সুযোগই নেই।

কথা বলে জানা গেল, গর্ভবর্তী মায়েরা টিকা সম্পর্কে কোন ধারণা রাখেন না। নিয়মিত চেকআপের কোন সুযোগও নেই। পাশের আরেকটি চরে একটি কমিউনিটি ক্লিনিক থাকলেও সেখানে চিকিৎসক ও ওষুধ কিছুই পাওয়া যায় না বলে অভিযোগ ঢালচরের নারীদের। গর্ভকালীন জটিলতায় এই চরের বহু নারী মারাত্মক সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন। অনেকে মারা গেছেন, অনেকের বাচ্চাকে জীবিত রাখা সম্ভব হয়নি।

ঢালচরসহ উপকূলের বেশ কয়েকটি দুর্গম চর ঘুরে প্রান্তিক শিশুদের সমস্যা সম্পর্কে তথ্য মেলে। মায়েরা জানান, অধিকাংশ বাচ্চা কম ওজনে জন্ম নেয়। বাচ্চারা জন্মের পর শুকিয়ে যেতে থাকে। অনেকে আবার ঠিকমত কথা বলতে পারে না। অনেক শিশু ৬-৭ বছরের মধ্যে কংকালসার হয়ে যায়। অনেকের বুদ্ধি কম হয়, কোন কাজ করতে পারে না। অনেকে একটু বেশি দূর হাঁটলে হাঁপিয়ে উঠে।

উপকূল অঞ্চলে কর্মরত বেসরকারি সংস্থা কোস্টট্রাস্ট দ্বীপ জেলা ভোলার দুর্গম অঞ্চলের ১০০ নবজাতক শিশুর ওপর জরিপ চালিয়ে দেখেছে, অধিকাংশ শিশু কম ওজন নিয়ে জন্মগ্রহণ করছে। এর কারণ হিসাবে গর্ভকালে মায়েদের প্রয়োজনীয় খাবারের অভাব এবং মায়েদের অসচেতনতাকে চিহ্নিত করা হয়েছে।

কোস্টট্রাস্টের নির্বাহী পরিচালক রেজাউল করিম চৌধুরী এ প্রসঙ্গে বলেন, নবজাতকের ওপর পরিচালিত জরিপে যে ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে তা আমাদেরকে শংকায় ফেলে দেয়। কারণ অপুষ্টি নিয়ে জন্মগ্রহণকারী শিশুর মেধার বিকাশ ঘটবে না। এরা নিজেদের সম্মানজনক কাজে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে না।                

উপকূল ঘুরে পাওয়া তথ্যের সঙ্গে কেন্দ্রীয়ভাবে প্রচারিত সরকারি তথ্যের কোন মিল পাওয়া যায় না। প্রতি ৬ হাজার মানুষের জন্য একটি কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে বলে সরকার দাবি করলেও উপকূলের বিভিন্ন এলাকায় চিত্রটা পুরোপুরি উল্টো। কোথাও কোথাও ২০-২৫ হাজার লোকের জন্যও একটা কমিউনিটি ক্লিনিক খুঁজে পাওয়া যায় না। আবার ক্লিনিক থাকলেও চিকিৎসক কিংবা ওষুধ মেলে না। ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রের অবস্থাও একই রকম। এই দু’ধরনের স্বাস্থ্যকেন্দ্রের অপ্রতূলতা ও অব্যবস্থাপনার প্রভাব শিশুদের ওপর পড়ছে বলে দাবি করেন সংশ্লিষ্টরা।
 
চিকিৎসা সেবার অপ্রতূলতায় উপকূলের অনেক স্থানে তাবিজ-কবজের দাওয়াই প্রধান হয়ে দেখা দেয়। মনপুরার চর কলাতলীতে সরেজমিনে তথ্য সংগ্রহে গেলে চিকিৎসা সংকটের কথা জানাতে গিয়ে চরের কয়েকজন নারী বলছিলেন, ডাক্তার কবিরাজ তো দূরের কথা। অসুখ হলে ‘খনকার’ও মেলে না। বিচ্ছিন্ন এই দ্বীপ অঞ্চলে ‘খনকার’ নামের এক শ্রেণী রয়েছে, যারা তাবিজ-কবজ দিয়ে নানান রোগের দাওয়াই দিয়ে থাকেন। বিশেষ করে মা ও শিশুদের ক্ষেত্রে এ ধরনের চিকিৎসা বেশি নেওয়া হয়।  

চর কলাতলী বাজার ঘুরে দেখা গেল, প্রায় প্রতিটি ওষুধের দোকানে এলোপ্যাথিক, হোমিওপ্যাথিক ও গরু-ছাগলের ওষুধ পাওয়া যায়। এ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ‘ডাক্তার’ বললেন, ‘এখানে তো ভাই চিকিৎসা করার মত কেউ নেই। আমরা শুধু মানুষের চিকিৎসা নয়, গরু-বাছুরের চিকিৎসাও করি। এলোপ্যাথিক, হোমিওপ্যাথিক ওষুধ তো আছেই। প্রয়োজন পড়লে তাবিজ-কবজ দিয়ে ‘খনকার’-এর কাজও করি। মানুষ তো এতে সন্তুষ্ট। তাদের তো কোন অভিযোগ নেই। ’

স্থানীয় বাসিন্দারা জানালেন, ভয়াল মেঘনার বুকে জেগে থাকা দ্বীপ কলাতলীর প্রায় ২২ হাজার মানুষ সুষ্ঠু চিকিৎসা ব্যবস্থা থেকে অনেক দূরে। ‘সব মানুষের দোর গোড়ায় চিকিৎসা ব্যবস্থা পৌঁছে দেওয়া হয়েছে’ বলে সরকারি ঘোষণা এই চরের মানুষের বেলায় প্রযোজ্য নয়। বিনা চিকিৎসায় প্রতিবছর এখানে বহু মানুষ মারা যায়। জরুরি মুহূর্তে প্রসূতি মায়েদের জীবন তুলে দিতে হয় নিয়তির কাছে। চরের বেশ কয়েকটি স্থানে কথা বলার সময় স্থানীয় বাসিন্দারা সন্তান প্রসবকালে মৃত মায়েদের তালিকা তুলে ধরেন।

মনপুরা উপজেলার মনপুরা ইউনিয়নের এক নম্বর ওয়ার্ড হিসাবে এ চরে একটি কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে। কিন্তু সেখানে গিয়ে নির্দিষ্ট সময়ে ডাক্তার পাওয়া যায় না বলে এলাকাবাসীর অভিযোগ। আবার কখনো ডাক্তারের দেখা মিললেও ওষুধ পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। এখানকার কমিউনিটি ক্লিনিকের কার্যক্রম এতটাই অনিয়মিত, চরের অনেক মানুষ জানেনই না এখানে এ ধরনের সরকারি চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে।

এলাকার ইউপি সদস্য মো. জাফর উল্লাহ বলেন, এখানে বিভিন্ন সময়ে ডায়রিয়াসহ পানিবাহিত রোগ দেখা দেয়। কমিউনিটি ক্লিনিক একটি থাকলেও সেখানকার ডাক্তার আসে নদীর ওপার থেকে। তাছাড়া যোগাযোগ সমস্যার কারণে চরের সব এলাকার মানুষ ওই ক্লিনিকে যেতে পারেন না। স্থানীয় পর্যায়ে কয়েকজন ডাক্তার থাকলেও তারা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নন।

মনপুরা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. সুনিল চন্দ্র দাস বলেন, চর কলাতলী একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। এখানকার মানুষের যথাযথ চিকিৎসা পেতে অনেক সমস্যা হয়। চর থেকে উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আসতেও প্রায় তিন ঘণ্টা সময় লাগে। ওখানকার বাসিন্দাদের জন্য আরও কমিউনিটি ক্লিনিক ও ডাক্তার প্রয়োজন।

উপকূলের দুর্গম জনপদে চিকিৎসা ক্ষেত্রে এই সংকটে শিশুরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের সেবা যথাযথভাবে পৌঁছায় না তাদের কাছে। ফলে জন্মের আগে থেকে শুরু হওয়া অবহেলাটা যেন জন্মের পর আরও অনেকখানি বেড়ে যায়। এক সময় ওরা সমাজের বোঝা হয়ে দাঁড়ায়।
 
[ পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোন খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: [email protected] ]

বাংলাদেশ সময়: ০১৩৯ ঘণ্টা, এপ্রিল ০৫, ২০১৫
জেডএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।