ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

উপকূল থেকে উপকূল

উপকূলে ন্যায্য পারিশ্রমিকবঞ্চিত নারী

সুমন সিকদার, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৬২৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ৩০, ২০১৫
উপকূলে ন্যায্য পারিশ্রমিকবঞ্চিত নারী ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

বরগুনা: দারিদ্রপীড়িত জনপদ বরগুনাসহ উপকূলীয় অঞ্চলের নারীরা ঘরের পাশাপাশি বাইরেও পুরুষের সঙ্গে সমানতালে কাজ করছেন।

কিন্তু সমান কাজ করেও নানাভাবে মজুরি বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন এ নারী শ্রমিকরা।

এর বাইরেও কাজ করতে গিয়ে রয়েছে নানা বিড়ম্বনাতে পড়ার ঝক্কি। সব মানতে হচ্ছে তাদের। তবুও জুটছে না ন্যায্য পারিশ্রমিক।

জানা গেছে, উপকূলীয় অঞ্চলের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির কারণে পুরুষের পাশাপাশি নারীরা বিভিন্ন পেশার সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন।

বর্তমানে তারা কৃষি, জেলে, ব্যবসা এমনকি দিনমজুরির কাজেও পুরুষের পাশাপাশি সমান ভূমিকা রাখছেন। তবুও পুরুষতান্ত্রিক চিন্তাচেতনা ও সমাজ ব্যবস্থার কারণে প্রতিনিয়ত বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন এ শ্রমজীবী নারীরা।

এর উপর রয়েছে হয়রানি। নারী শ্রমিকদের সঙ্গে কোলের বাচ্চা থাকলে তাদের কাজে নেওয়া হয় না। অনেকক্ষেত্রে তাদের কুপ্রস্তাব দেওয়ার ঘটনাও ঘটে। তবুও সংসারের প্রয়োজনে নারী শ্রমিকরা এসব প্রতিকূলতার মধ্যেও দিনরাত কাজ করে চলেছেন।

সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে, এ অঞ্চলের ৬১ শতাংশ নারী শ্রমিক দৈনিক ১০০ টাকা থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত মজুরি পেয়ে থাকেন এবং ৩২ শতাংশ দৈনিক ১০০ টাকার কম মজুরি পান। অন্যদিকে, ৫৬ শতাংশ পুরুষ শ্রমিক ২০০ থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত মজুরি পান।

সরেজমিনে বরগুনা সদর উপজেলাসহ পাথরঘাটা, বামনা, বেতাগী, আমতলী ও তালতলী ঘুরে দেখা গেছে, আগের চেয়ে বেশিসংখ্যক নারী কাজের জন্য ঘরের বাইরে যাচ্ছে। ঘরে ও বাইরে সমানতালে কাজ করছেন তারা। দিনমজুরিসহ জেলে, কৃষি ও হস্তশিল্প কাজে পুরুষের চেয়ে তাদের ভূমিকা রাখছে।

কিন্তু মজুরিতে রয়েছে বড় ধরনের তারতম্য। পণ্য বাজারজাতকরণ ও পরিবহণে সমস্যা, নিরাপত্তার অভাব, পারিবারিক বাধা এবং বাজার সম্পর্কিত তথ্য না পাওয়ায় তারা ন্যায্য পারিশ্রমিক পাচ্ছেন না। যেখানে নারীদের দৈনিক মজুরি ১০০ থেকে ১৫০ টাকা সেখানে একই কাজের জন্য পুরুষদের দৈনিক মজুরি ২০০ থেকে ৪০০ টাকা। সেই সঙ্গে রয়েছে নানাবিধ সুবিধা।

বরগুনা সদর উপজেলার গৌরিচন্না ইউনিয়নের শেফালী বেগম পেশায় দিনমজুর। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, ‘প্রতিদিন রাস্তায় কাজ করে ১৫০ টাকা করে মজুরি পাই. অন্যদিকে একই কাজ করে ২০০-২৫০ টাকা করে পায় পুরুষরা।

একই ইউনিয়নের হোসনেয়ারা হাসি স্বামীহীন সংসারের ভরণ-পোষণের জন্য সারাদিন জাল নিয়ে পড়ে থাকেন বিষখালী নদীতে। মাছ শিকার করে চলে তার সংসার। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, মাছ ধরি ঠিকই কিন্তু বেচতে (বিক্রি) গেলে দাম পাই না। মোগো (নারীদের) একটা বাজার থাকলে ভালো হতো।

এদিকে, পণ্য বিক্রির ক্ষেত্রেও বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন নারীরা। ফলে তাদের উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করতে হচ্ছে পরিবারের পুরুষ সদস্যদের।

বরগুনা সদর উপজেলার সোনাতলা গ্রামের নাসিমা বেগম একজন সফল কৃষক কিন্তু তার উৎপাদিত পণ্য তিনি কখনো বিক্রি করতে পারেননি। তার স্বামী তার উৎপাদিত শাক-সবজি বিক্রি করেন।

নাসিমা বেগম বলেন, আমাদের জন্য নির্ধারিত কোনো বাজার নেই, পণ্য পরিবহনেও আমাদের অনেক অসুবিধা হয়। তাই আমাদের সংসারের পুরুষ সদস্যরা আমাদের পণ্য বাজারে বিক্রি করেন।

এরকমই আরেকজন হলেন বরগুনার সদর উপজেলার ফুলঝুড়ি ইউনিয়নরে সবিতা রাণী, তিনি হস্তশিল্পের কাজ করেন। প্রতিদিন হাড়ভাঙা খাটুনি তার। কিন্তু নারীদের জন্য নির্দিষ্ট কোনো বাজার না থাকায় তাদের উৎপাদিত পণ্য ঘরের পুরুষ সদস্যদের দিয়ে বিক্রি করাতে হয়।

নারী শ্রমিকদের মজুরি তারতম্যের বিষয়ে বরগুনা পাবলিক পলিসি ফোরামের আহ্বায়ক মো. হাসানুর রহমান ঝন্টু বাংলানিউজকে বলেন, নারী শ্রমিকদের জন্য জাতীয়ভাবে ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা করা হলে এই বৈষম্য কমানোর ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে। আর্থিক ব্যবস্থাপনা, পণ্য বাজারজাতকরণ, উপার্জিত অর্থব্যয়ের ক্ষমতা ইত্যাদি ক্ষেত্রে নারীদের দক্ষতা বৃদ্ধি, নারী উদ্যোক্তাদের উৎসাহ প্রদান এবং উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা করলে নারীরাও আরো সচেতন হবে।

এ বিষয়ে মানবাধিকার সংগঠন নাগরিক অধিকারের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হাসান তারিক পলাশ বলেন, সরকার নারীর ভাগ্যোন্নয়নে ব্যাপক গুরুত্ব দিচ্ছে। উপকূলীয় অঞ্চলের নারীদের শিক্ষার হার কম থাকায় ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। তবে নারীদের জন্য আলাদা বাজারের ব্যবস্থা করা গেলে এটা অনেকাংশে কমে আসবে।

নারীদের নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে স্থানীয় উন্নয়ন সংগঠন জাগো নারী। এ বিষয়ে জাগো নারীর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হোসেনেয়ারা হাসি বাংলানিউজকে বলেন, আমরা দীর্ঘদিন ধরে গ্রামীণ নারীদের ক্ষমতায়নে কাজ করছি। নারীদের আলাদা বাজার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রশাসনের সঙ্গে কথা হয়েছে। আশা করছি শিগগিরই আলাদা বাজার স্থাপন করা সম্ভব হবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা মেহেরুন নাহার মুন্নি বলেন, নারীদের উন্নয়নে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর নানামুখী কর্মসূচি গ্রহণ করে আসছে। আগে নারীরা ঘরের বাইরে কাজে যেত না, সেটা এখন নেই বললেই চলে। তবে এখনো ন্যায্য মজুরি থেকে তারা বঞ্চিত হচ্ছেন। তবে এ সমস্যাও নিরসন হবে।

বাংলাদেশ সময়: ০৬০০ ঘণ্টা, এপ্রিল ৩০, ২০১৫
এসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।