ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

উপকূল থেকে উপকূল

উপকূলের জেলে জীবন-১

দস্যু ভয় তবু যেতে হয়

সুমন সিকদার, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৪০৯ ঘণ্টা, জুলাই ২১, ২০১৫
দস্যু ভয় তবু যেতে হয় ছবি : বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা ও পিরোজপুরসহ উপকূলীয় জেলেদের জীবিকা চলে বঙ্গোপসাগরে ইলিশ শিকার করে। উত্তাল ঢেউয়ের সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকা এসব জেলের দুর্দশার তাই অন্ত নেই।

একদিকে সমুদ্রের সঙ্গে লড়াই, আরেক দিকে জলদস্যুর উৎপাত। তারওপর রযেছে দাদনের নীপিড়ন। প্রতিনিয়ত দ্রব্যমূল্যের কষাঘাতে জর্জরিত উপকূলের জেলে পরিবারগুলোর ঋণের বোঝাও বেড়েই চলেছে। তাদের অন্তহীন দুর্দশার চিত্র নিয়ে বরগুনা করেসপন্ডেন্ট সুমন সিকদার এর আট পর্বের প্রতিবেদনের আজ পড়ুন প্রথম পর্ব।

উপকূলের জেলে পল্লী ঘুরে: ‘বোটের (জেলে ট্রলারের) পাশে বোট লাগাইয়া অস্ত্র ঠেকাইয়া আউড়াধাউড়া (এলোপাথারি) মাইর শুরু করে। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগে মাঝিকে নিয়ে যায় দস্যুরা। আবার কোনো কোনো সময় মাঝির সঙ্গে  যুবক বয়সী থাকলে তাদেরকেও নিয়ে যায়। প্রতিবাদ তো দূরের কথা, বাঁচার চেষ্টা করলে জীবন শেষ।

এমন কথাই বললেন বরগুনার নলটোনা ইউনিয়নের জেলে বেল্লাল হোসেন। ২০ বছর ধরে বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরছেন, তাই  দস্যু ভয় এখন তার গা সয়ে গেছে। আতঙ্ক রয়েছে জেনেও প্রতিনিয়ত জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাগরে মাছ ধরতে যাচ্ছেন তিনি।   দস্যুদের উৎপাতের কথা আক্ষেপ করে বলা ছাড়া আর কিছুই করার নেই তাদের।

দস্যুদের নির্যাতনের কথা বলতে বলতে বিরক্ত হয়ে গেছেন উপকূলের জেলেরা, এখন আর ভালো লাগে না তাদের। সবাই শুধু শুনেই যায়, পায় না কোনো প্রতিকার। তাই এখন বলতে কষ্ট হয় তাদের কষ্টগাথা। গভীর সমুদ্রে যখন দস্যু আক্রমণ হয়, না থাকে কোস্টগার্ড না থাকে কোনো নিরাপত্তা বাহিনী। সৃষ্টিকর্তার উপর ভরসা করা ছাড়া আর কোনো রাস্তাই খোলা থাকে না তাদের।

তবুও উপকূলের হাজার হাজার জেলে দস্যু ভয় নিয়ে প্রতিনিয়ত সমুদ্রে যাচ্ছে। কেউ ফিরছে আপন সংসারে, আবার কেউ কোনদিনই ফিরছে না এই ভব সংসারে। আবার অনেকে দস্যুদের ভয়ে সমুদ্র সীমানা লঙ্গন করায় ভিনদেশের কারাগারে বন্দি অবস্থায় কাটাচ্ছে মানবেতর জীবন।

বরগুনা সদর উপজেলার জেলে আউয়াল বাংলানিউজকে বলেন, জানি জীবনের নিরাপত্তা নাই, হেরপর না যাইয়া উপায় নাই, পেটে ভাত দিতে হইলে যাইতেই হইবে গাঙ্গে (সাগরে)। প্রত্যেক বছর ডাহাইতে পিডায় (পিটায়), মাইরা (মেরে) হালায় (ফালায়) হেরপরও গাঙ্গে যাই যদি মাছ পাই মাইয়া (মেয়ে) পোলা (ছেলে) লইয়া ভালো থাকতে পারুম হেই আশায়।

বঙ্গোপসাগরে দস্যুদের অপরহণ ও মুক্তিপণ বাণিজ্যে দিশেহারা হয়ে পড়েছে উপকূলীয় জেলেরা। ইলিশ মৌসুমে বঙ্গোপসাগরে দস্যুতা চালিয়ে জেলে অপহরণ ও ট্রলার জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায় করছে বঙ্গোপসাগর কেন্দ্রিক বিভিন্ন দস্যু গ্রুপ। আর মুক্তিপণের এসব টাকা আইন-শৃঙ্খলা বাহীনির নাগালের মধ্যেই চলছে আদান-প্রদান। কর্তব্যরত আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীরর নিষ্ক্রিয়তার কারণে দস্যুদের মুক্তিপণ বাণিজ্য অনেকটা নীরবেই মেনে নিয়েছেন জেলে, ট্রলার মালিক ও মৎস্যজীবীরা।  

জেলা ট্রলার মালিক সমিতি ও জেলে সমিতির হিসাবে গতবছর শতাধিক ট্রলারসহ প্রায় তিন হাজার জেলে অপহৃত হয়েছে। শেষ সম্বল ভিটে মাটি বন্ধক রেখে জেলেপ্রতি ৫০ হাজার থেকে এক লাখ ও ট্রলারপ্রতি তিন থেকে পাঁচ লাখ টাকা মুক্তিপণের বিনিময়ে দস্যুদের আস্তানা থেকে অপহৃতদের ফিরিয়ে এনেছেন স্বজনরা।

আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ক্ষমতার ওপর ভরসা নেই জেলেদের। তাই তো দস্যুদের বেঁধে দেওয়া সময়সীমার মধ্যে মুক্তিপণ পরিশোধ করে জেলেদের ফিরিয়ে আনাতেই নিরাপদ বোধ করেন স্বজনরা।

এ বিষয়ে বরগুনা জেলা মৎস্যজীবী সমিতি সভাপতি আবদুল খালেক দফাদার বাংলানিউজকে বলেন, জেলেদের তো উপায় নেই, খাইতে হইলে সাগরে যাইতে হবে, আর সাগরে গেলে দস্যুর কবলে পড়বে এটা এখন নিয়তি হিসেবে মেনে নিয়েছে উপকূলীয় জেলেরা। এ নিয়ে বিভিন্ন সময় মানববন্ধন সভা সমাবেশ করেও সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়নি উপকূলীয় জেলেরা। পায়নি গভীর সমুদ্রে নিরাপত্তার কোনো আশ্বাস।

জেলা ফিশিং ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি নজরুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, বিরূপ আবহাওয়া, দস্যুদের উৎপাতসহ নানা প্রতিকূলতা সামাল দিয়ে ইলিশ শিকার করতে হয় জেলেদের। প্রতিবছর মৌসুম শুরুতে জেলেরা ইলিশ শিকারে গেলে দস্যুদের উৎপাত বাড়ে কয়েক গুণ। সাগরে মাছ বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধি পায় দস্যুদের তাণ্ডব। তবুও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রতিনিয়ত দস্যু ভয়কে উপেক্ষা করে সাগরে যাচ্ছে জেলেরা। দু‘বেলা দু‘মুঠো খেয়ে পরে বাঁচার জন্য।

জেলেদের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা কোস্টগার্ডের পাথরঘাটা স্টেশন কমান্ডার লে. এফ এ রউফ বাংলানিউজকে বলেন,  জেলেদের নিরাপত্তায় আমরা সব সময় প্রস্তুত আছি। প্রতিনিয়ত আমাদের টহল অব্যাহত রেখেছি এবং গভীর সমুদ্রে নৌবাহিনীর টহল অব্যাহত রয়েছে। কোস্টগার্ডের পক্ষ থেকে জেলেদের নিরাপত্তার জন্য নানামুখি কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ সময়: ০৩০৩ ঘণ্টা, জুলাই ২১, ২০১৫
এসএইচ/জেডএম/এটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।