ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

উপকূল থেকে উপকূল

উপকূলের জেলে জীবন ৬

হেই যে গেলো আর আইলো না

সুমন সিকদার, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০৫৯ ঘণ্টা, জুলাই ২৬, ২০১৫
হেই যে গেলো আর আইলো না ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা ও পিরোজপুরসহ উপকূলীয় জেলেদের জীবিকা চলে বঙ্গোপসাগরে ইলিশ শিকার করে। উত্তাল ঢেউয়ের সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকা এসব জেলের দুর্দশার তাই অন্ত নেই।

একদিকে সমুদ্রের সঙ্গে লড়াই, আরেক দিকে জলদস্যু উৎপাত। তারওপর রযেছে দাদনের নীপিড়ন। প্রতিনিয়ত দ্রব্যমূল্যের কষাঘাতে জর্জরিত উপকূলের জেলে পরিবারগুলোর ঋণের বোঝাতো বেড়েই চলেছে। তাদের অন্তহীন দুর্দশার চিত্র নিয়ে বরগুনা করেসপন্ডেন্ট সুমন সিকদার এর আট পর্বের প্রতিবেদনের আজ পড়ুন ষষ্ঠ পর্ব।

উপকূলের জেলে পল্লী ঘুরে: স্বামী, মাইয়া(মেয়ে) জামাই হেই যে গেলো আর আইলো না। এহন এ বাড়ি ও বাড়ি কাম করে সংসার চালাই, হেও দু’বেলা দু’মুঠো ভাত তুলে দিতে পারি না মাইয়া-পোলার মুখে। লেহাপড়ার খরচটাও দিতে পারি না। তবে এহনো অপেক্ষায় আছি, যদি হে ফিরে আসে কোন দিন।

এভাবেই বরগুনার মাঝের চর জেলে পল্লীর স্বামীহারা জাহানারা বেগম বললেন তার কষ্টের কথা। দু’বছর হয়েছে বঙ্গোপসাগরে ইলিশ শিকার করতে গিয়ে আর ফিরে আসেনি পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি স্বামী শুক্কুর। ত‍াকে হারিয়ে ছেলে মেয়ে ও বৃদ্ধ শ্বশুরকে নিয়ে অসহায় দিনযাপন করছেন তিনি। ছেলে-মেয়ের পড়ালেখা তো দূরের কথা, তাদের মুখে দু’বেলা দু’মুঠো অন্ন তুলে দিতে হিমশিম খাচ্ছেন তিনি।

শুধু জাহানার বেগমের স্বামী শুক্কুরই নন, একই ঘটনায় এখনো নিখোঁজ রয়েছে এই পল্লীর ছয় জেলে। কেউ হারিয়েছে আদরের সন্তান, কেউ হারিয়েছে সংসারের একমাত্র অবলম্বন স্বামীকে, আবার কেউ হারিয়েছে তার পিতাকে।

উপকূলের জেলে পল্লীগুলোতে কতো জেলে মারা গেছেন কিংবা নিখোঁজ রয়েছেন এর সঠিক কোন পরিসংখ্যান না থাকলেও প্রতিবছর শুধু ইলিশের মৌসুমে ২শ’ থেকে ৩শ’ জেলে নিখোঁজ হন বলে দাবি জেলে ট্রলার মালিক ও মৎস্যজীবীদের।

সমুদ্রে মাছ শিকারে গিয়ে নিখোঁজ জেলে পরিবারের খোঁজ রাখে না কেউ। না ট্রলার মালিক, না মহাজন, না সরকার। আর পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারালে নিখোঁজ জেলে পরিবারগুলো সমাজ থেকেও হয়ে যায় বিচ্যুৎ। ধার দেনা তো দূরের কথা, ঠিক মতো কাজও দিতে চায় না অনেকে।

উপার্জনক্ষম ছেলেকে হারিয়ে দিশেহারা ষাটোর্দ্ধ আলতাফ জমাদ্দার। অনেকটাই দিকশূন্য তিনি কি করবেন ভেবে পাচ্ছেন না। এমনকি কেউ ধারও দিতে চাইছে না। কেননা তাকে ধার দিলে যদি তিনি মারা যায় তখন কে পরিশোধ করবে তার ধারের টাকা। তাই অনেকদিন তাকে না খেয়ে থাকতে হয়েছে ছেলে নিখোঁজ হওয়ার পর।

বাংলানিউজকে তিনি বলেন, খোদায় নিবো নিবো আমারে নিতো, মোর পোয়ারে নিছে ক্যা? নাতি নাতনিগো মুখের দিকে তাকাইত পারি না, পারিনা দুগ্গা খাওন দিতে। ও আল্লাহ তুমি এমন ক্যা? মোর পোয়ারে ফিরাইয়া মোরে লইয়া যাও। আর সইতে পারি না এই যন্ত্রণা।

বরগুনা মাঝেরচর জেলে পল্লীর পাথরঘাটা অংশের ইরানী বেগমও হারিয়েছেন তার পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যাক্তিটিকে। বেঁচে আছেন না মরে গেছেন সঠিক করে বলতে পারেন না তিনি। শুধু অপেক্ষায় আছেন যদি ফিরে আসে কোনদিন।

তার অবুঝ শিশুটিও এখন বুঝতে শিখেছে। হাঁটি হাঁটি করে পা দিয়েছে ১৬ বছরে। এবার এসএসসি পরীক্ষাও দিয়েছে। এ বাড়ি ও বাড়ি ঝিয়ের কাজ করে মেয়েকে পড়িয়েছেন। কিন্তু তার উচ্চশিক্ষার খরচ যোগাবে কে?

বাংলানিউজকে ইরানি বলেন, স্বামী হারা জীবন বড় কষ্টের। অনেকের অনেক কথা শুনতে হয়। তবুও মেয়েটার মুখের দিকে চেয়ে বেঁচে আছি, ওরা যদি একটু ভালো থাকে।

বরগুনা জেলা মৎস্যজীবী সমিতির সভাপতি আ. খালেক দফাদার বাংলানিউজকে বলেন, এই অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষই জেলে। যাদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে আমাদের অর্থনীতি হয় মজবুত। কিন্তু সমুদ্রে মাছ শিকারে যাওয়া জেলেদের উপর কখনো নেমে আসে প্রাকৃতিক দুযোর্গ, আবার কখনো দস্যু তাণ্ডবে অনেকে হারায় প্রাণ হারান। কেউবা নিখোঁজ হয়ে যান চিরতরে।

কেউ নিখোঁজ হলে তার পরিবারের সদস্যদের ভরণ পোষণ বা সহায়তার জন্য সরকারের সহায়তা কামনা করেন তিনি।

বরগুনা জেলা প্রশাসক মীর জহুরুল ইসলাম আশার বাণী শুনিয়ে বাংলানিউজকে বলেন, সমুদ্রে মাছ শিকারে গিয়ে যে সকল জেলে প্রাণ হারায় বা নিখোঁজ থাকে তাদের সঠিক তালিকা পেলে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সহায়তাসহ সরকারের উচ্চ পর্যায়ে সাহায্যের আবেদন করা হবে।

বাংলাদেশ সময়: ০০৫৮ ঘণ্টা, জুলাই ২৬, ২০১৫
জেডএম/

** বিদেশি ট্রলার আতঙ্ক!
** গভীর সমুদ্রে মেলে না প্রাকৃতিক দুর্যোগের পূর্বাভাস
** দস্যুদের কার্ডেও নেই জীবনের নিশ্চয়তা
** দস্যু ভয় তবু যেতে হয়
** ঋণ-দাদনে দিশেহারা জীবন

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।