ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

উপকূল থেকে উপকূল

জলবায়ু পরিবর্তন

ঝুঁকিতে ভোলার উপকূলীয় এলাকা

ছোটন সাহা, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১০৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১, ২০১৫
ঝুঁকিতে ভোলার উপকূলীয় এলাকা ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

উপকূলীয় এলাকা ঘুরে: জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকিতে রয়েছে দ্বীপ জেলা ভোলা। এ পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে উপকূল জুড়ে নদী ভাঙনসহ নানা সমস্যা দেখা দিয়েছে।



পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) জানায়, গত ৪৪ বছরে মেঘনা ও তেঁতুলিয়ায় প্রায় ৫৭ বর্গকিলোমিটার এলাকা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।

এছাড়াও পানির উচ্চতা বৃদ্ধিতে উঁচু জলোচ্ছ্বাস, ফসলের উৎপাদন হ্রাস, বনায়নে বৃক্ষ মারা যাওয়ার পাশাপাশি জীববৈচিত্র্যে মারাত্মক প্রভাব পড়ছে।

জেলা বন বিভাগ, কৃষি অধিদফতর, মৎস্য কর্মকর্তারাও জলবায়ুর প্রভাবে ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে বেশ চিন্তিত। এ থেকে দ্রুত উত্তরণের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন তারা।

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে উপকূলীয় এ জেলায় শীতের দিনে গরম, ঘন ঘন দুর্যোগ ও অতিবৃষ্টির কারণে জনজীবনে প্রভাব পড়ছে বলে মনে করছেন এলাকার বাসিন্দারা।
 
সূত্র বলছে, পদ্মা, মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্র বাহিত পলি দিয়ে বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে গড়ে ওঠা দেশের বৃহৎ  দ্বীপটি হচ্ছে ভোলা। ১৮ লাখ জনগোষ্ঠির মধ্যে পাঁচ লাখ মানুষই বাস করেন উপকূলবর্তী এলাকায়।

ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের সঙ্গে যুদ্ধ করে চলা এসব মানুষ প্রতিনিয়তই নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে দিন কাটাচ্ছেন। এর মধ্যে আবার নতুন করে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি হওয়ায় জনমনে দেখা দিয়েছে নানা শঙ্কা ও আতঙ্ক।
 
পাউবো’র হিসাব অনুযায়ী, গত ৪৪ বছরে জেলার ৫৭ কিলোমিটার এলাকা বিলীন হয়ে লাখের বেশি মানুষ বাস্তুহারা হয়েছেন। ঠিকানাহারা হয়েছেন বহু মানুষ।

উপকূল নিয়ে কাজ করা বেসরকারি (এনজিও) সংস্থা কোস্ট ট্রাস্টের সমন্বয়কারী সোহেল মাহমুদ বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাচ্ছে, বৃষ্টির সময় বৃষ্টি হচ্ছে না, শীতের সময়েও সকালে শীত আবার বিকেলে গরম পড়ছে।

তিনি বলেন, আগে জেলেরা সারাদিন নদীতে থাকলেও তাদের কোনো অসুখ-বিসুখ হতো না। কিন্তু এখন সামান্য সময় নদীতে থাকলেই তারা নানা অসুখ-বিসুখে ভুগছেন। তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেকাংশে কমে গেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই এমনটি হচ্ছে বলেও মনে করেন তিনি।

দীর্ঘদিন পরিবেশ নিয়ে কাজ করছেন ভোলা সুশীল সমাজের প্রতিনিধি অ্যাডভোকেট নজরুল হক অনু।

তিনি বলেন, আমরা লক্ষ্য করছি, ভোলায় গত কয়েক বছর ধরে গরম, শীত, নদী ভাঙনের প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া বৃষ্টিও বেশি হচ্ছে। অথচ ইলিশ মাছের পরিমাণ দিন দিন কমে যাচ্ছে। এ পরিবর্তনের কারণে আমরা খুবই শঙ্কিত। এজন্যই আমরা মনে করছি, আগামীতে আমাদের জন্য ভয়াবহ পরিস্থিতি অপেক্ষা করছে। এ পরিস্থিতি থেকে রক্ষার জন্য এখনই বিশেষ প্রকল্প বাস্তবায়ন দরকার।

ভোলা নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব এসএম বাহাউদ্দিন বলেন, জলবায়ু নিয়ে যতোটা কথা হচ্ছে, দৃশ্যমান তেমন কোনো কাজ হচ্ছে না। আমাদের দাবি, জলবায়ু নিয়ে কাজ করার জন্য গবেষণা ও মনিটরিংয়ের স্থায়ী ক্যাম্প এবং গবেষণাগার স্থাপন করা হোক। এর মাধ্যমে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব থেকে কিভাবে দেশকে রক্ষা করা যায় সেজন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে।

উপকূল ঘুরে স্থানীয়দের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, উপকূলের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া সিডর ও আইলার ভয়াবহতার পরেও যেন মানুষের সংকট কিছুতেই কাটছে না। এখনও ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি বহু মানুষ।

বর্তমানে জলবায়ুর প্রভাবে মাছের সংকট, খেতের ফসলের উৎপাদন কমে যাওয়া ও বনায়নে মারা যাচ্ছে বৃক্ষ। সংরক্ষিত বনে খাদ্য ও মিঠা পানির সংকট দেখা দেওয়ায় লোকালয়ে ছুটে আসছে হরিণ। বন্য পশু-পাখিদের আবাসস্থলে বিচরণ করতে অনেকটাই সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। এ নিয়ে উদ্বিগ্ন সংশ্লিষ্ঠ মহল।

ভোলা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা প্রীতিষ কুমার মল্লিক জানান, বিগত পাঁচ বছর ধরে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ইলিশ মাছের ওপর বিরুপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। নদীর নাব্যতা হ্রাস ও ডুবোচরের সৃষ্টি হওয়ায় সাগর থেকে মাছ নদীতে আসতে বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। দিন দিন এ সমস্যা বেড়েই চলেছে। এ নিয়ে মৎস্য বিভাগ উদ্বিগ্ন।
 
ভোলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক প্রশান্ত কুমার সাহা বলেন, জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাবে ফসলের খেতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাওয়ায় ধান ও গম চাষ হুমকির মুখে পড়েছে। এভাবে চলতে থাকলে অচিরেই কৃষক তাদের জমিতে ধান ও গমসহ বিভিন্ন ধরনের ফসল উৎপাদন করতে পারবেন না।

এ সংকট থেকে দ্রুত উত্তরণের ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি আরো বলেন, মজবুত বেড়িবাঁধ ও স্লুইস গেট নির্মাণ করতে হবে, যাতে লবণাক্ত পানি ফসলের খেতে প্রবেশ করতে না পারে। এছাড়াও খাল খনন করাও জরুরি।

ভোলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী হারুন অর রশিদ বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে মেঘনা ও তেঁতুলিয়ার ভাঙনের তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৭১ সাল থেকে এ পর্যন্ত সদর, দৌলতখান ও বোরহানউদ্দিন উপজেলার মেঘনার বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে ৩৯ কিলোমিটার ও তেঁতুলিয়ায় ১০ কিলোমিটার বিলীন হয়ে গেছে।
 
এ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ভাঙন বৃদ্ধি পাওয়ায় গুগল থেকে পাওয়া গেছে আরেক তথ্য। দেখা গেছে, বোরহানউদ্দিন উপজেলার পক্ষিয়া ও গঙ্গাপুর ইউনিয়নে মাত্র সাড়ে ৮ কিলোমিটার এলাকা যুক্ত আছে। ভাঙনের তীব্রতা অব্যাহত থাকলে আগামী ৯ বছরের মধ্যে ভোলা সদর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে এ উপজেলাটি।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে নদী ভাঙন ও পানির উচ্চতা বেড়ে গেছে উল্লেখ করে উপকূলীয় বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মোহাম্মদ রুহুল আমিন বলেন, নন ম্যানগ্রোভ বনের চারা লবণাক্ত পানির কারণে মরে যাচ্ছে। কমে যাচ্ছে বন্য প্রাণীর আবাসস্থল।   জলাশয়গুলো শুষ্ক ও বর্ষা মৌসুমে লোনা পানির দখলে চলে যাচ্ছে। এতে জীববৈচিত্র্যের বিচরণ হুমকির মুখে পড়ছে।

এদিকে জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত প্রভাব, বিশ্ব উষ্ণায়ন আর গ্রিনহাউজ এফেক্টের ভয়াল ছোবল থেকে  ৩ হাজার ৪৪৮ বর্গকিলোমিটারের এ ভোলাকে রক্ষার দাবি সর্বমহলের।
 
ভোলার জেলা প্রশাসক মো. সেলিম রেজা বলেন, ভোলা একটি উপকূলীয় দ্বীপজেলা। এ জেলায় অনেক সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবও লক্ষ্যণীয়। ইতোমধ্যেই জলবায়ু ট্রাস্টের আওতায় বেশ কিছু প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে।
 
তিনি বলেন, মনপুরা-চরফ্যাশন থেকে শুরু করে গোটা জেলাতেই জলবায়ুর পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এর প্রভাবে যেন ব্যাপক ক্ষতি না হয় সেজন্য জলবায়ু মোকাবেলায় বেশ কিছু কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে। বেশ কিছু প্রজেক্ট কুকরি-মুকরি, ঢালচর ও মনপুরা-চরফ্যাশনে বাস্তবায়িত হচ্ছে। আমরা জনগণকে সচেতন করতে সক্ষম হয়েছি।

ভোলা জেলায় জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতির প্রভাবে যাতে জনজীবনে ঝুঁকি নেমে না আসে সেজন্য জনসাধারণ, জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় প্রশাসন সবার সহযোগিতায় পূর্ব প্রস্তুতিমূলক কাজ করা হয়েছে বলেও জানান জেলা প্রশাসক।

বাংলাদেশ সময়: ০১০৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০১, ২০১৫
আরএ/এএসঅার

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।