বাগেরহাট: তাদের প্রত্যেকেরই টানাপোড়েনের সংসার। স্বামীর একার রোজগারে এদিক হলে ওদিকে টান পড়ে তাদের।
তবে সম্প্রতি আর্থিক দৈন্য কাটিয়ে স্বাবলম্বী হওয়ার পথ খুঁজে পেয়েছেন বাগেরহাটের জনা তিরিশেক নারী। তাদের চোখে অমিত স্বপ্ন, নিজের এ ক্ষুদ্র চেষ্টায় একসময় দূর হবে সংসারের অভাব, আসবে শান্তি।
বলা হচ্ছে বাগেরহাট বাজার সংলগ্ন শহর রক্ষা বাঁধ এলাকার ৩০ নারীর কথা। নিজের উদ্যোগে মাটির চুলা তৈরি, পরে তা বিক্রি করে সংসারে সুদিন ফেরানোর স্বপ্ন বুনছেন এই নারীরা।
নিজ দক্ষতা আর সৃজনশীলতাকে কাজে লগিয়ে অভাবের সংসারে মুক্তির দিশা খোঁজা এমন নারীদের খোঁজে যাওয়া শহর রক্ষা বাঁধ এলাকায়।
সেখানে গিয়ে জানা গেলো, নদী থেকে তোলা পলিমাটি দিয়ে ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ মাটির চুলা তৈরি এখন তাদের পেশা। কোনো সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টা বা কারো পরামর্শে নয়; সংসারের অনটন মেটাতে নিজেরাই স্বউদ্যোগী হয়ে বেছে নিয়েছেন এই অভিনব মুক্তির পথ।
পরিবার বা বৈবাহিক সূত্রে গ্রাম থেকে শহরে আসা দরিদ্র পরিবারের এসব নারীরা আগে থেকেই জানতেন মাটি দিয়ে চুলা তৈরির কৌশল। এখন সেই রপ্ত করা কৌশল আরো একটু ঝালিয়ে নিয়ে চুলার এক অস্থায়ী বাজারও গড়ে তুলেছেন তারা।
ফলে এখন বাগেরহাট শহর রক্ষা বাঁধের লঞ্চঘাট সংলগ্ন কয়লাঘাট এলাকায় গেলেই দেখা মিলবে তাদের তৈরি নানা আকৃতির মাটির চুলার।
রোববার (৩ জানুয়রি) শহরের লঞ্চঘাট এলাকায় বাংলানিউজের সঙ্গে কথা হয় এসব মৃৎ শিল্পীদের সঙ্গে। শোনান তাদের জীবন সংগ্রামের গল্প।
এ এলাকার দিনমজুর সালাম খাঁর স্ত্রী রেশমা বেগম (২৫) জানান, স্বামীর আয়ে (ঘর) ভাড়ার টাকা দিয়ে দুই সন্তানসহ সংসারের খরচ মেটানো কঠিন হয়ে যায়।
তিনি বলেন, ‘মেয়েটারে স্কুলে দিছিলাম, এবার ফাইবে (পঞ্চম) উঠছে। ওর তো মানুষ করতে হবে। অভাবের সংসার, তার (স্বামী) আয়ে সব খরচ কি করে চলে? পাশের খালাগো দেখতাম মাটি দিয়ে চুলা বানায়ে বিক্রি করে। আমিও চুলা বানাইতে জানতাম। এই তিন বছর হইলো নদী থেকে মাটি তুলে চুলা বানাই। বিক্রি করে যা সামান্য পাই সংসারের অনেক উপকার হয়। মেয়েডার পড়ানোর খরচ তো হইতেছে। ’
রেশমার সঙ্গে আলাপের পাশাপাশি চলছিল তৈরি করে সাজিয়ে রাখা চুলার ছবি তোলা। তা দেখে ডেকে নেন এক নারী। বললেন, ‘বাবা, চুলোর ছবি তুলে কি হবে? কতো জনে তো ছবি তুলে, আমাগো জ্বালা কি কমে?’
জোবেদা বেগম (৪৮) নামে ওই নারী বলেন, ‘দুই বছর আগে স্বামী মারা গেছে। বড় ছেলেডারে অনেক কষ্টে বিএ পাশ করাইছি। কোথাও একটা চাকরি পায়না। সবখানে ঘুষ লাগে। সামান্য বেতনে এখন একটা কম্পানির চাকরি পাইছে। ছোট ছেলেডারেও স্কুল থেকে ছাড়ায়ে এক দোকানে কাজে দিছি। অভাবের সংসারে প্রায় ৭ বছর ধরে এই চুলা বিক্রি করি। ’
তিনি জানান, একটা চুলা তৈরি থেকে শুরু করে শুকিয়ে বিক্রি উপযোগী করতে ১৫ থেকে ২০ দিন সময় লাগে। কিন্তু তারপরও ভালো দাম মেলে না। তবুও এই আয়ে কোনোমতে চলছে সংসার।
চুলা তৈরি করা করা আরো একাধিক নারীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শুকনা মৌসুমেই মূলত নদীর মাটি তুলে তা দিয়ে চুলা তৈরি করেন তারা। সবশেষে ওপরে কাঁদার প্রলেপ দেন। এরপর রোদে শুকিয়ে নেওয়া হয় চুলা।
তারা জানান, এসব চুলার রয়েছে বাহারি নাম। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য দো-চুলা, বন্ধু চুলা, কয়লা চুলা,পাশ কাঁটা চুলা, পাইপয়ের চুলা, ঝিক চুলা। চুলার ধরণ ও আকৃতি ভেদে শুকনা মৌসুমে ১৫০ থেকে ৩৫০ টাকা পর্যন্ত দামে মেলে এক একটি চুলা।
তবে সহজে বহনযোগ্য এসব চুলার চাহিদা সবচেয়ে বেশি থাকে বর্ষা মৌসুমে। বাগেরহাট নিচু এলাকা হওয়ায় বর্ষাকালে অনেক এলাকা প্লাবিত হয়ে পড়ে। তখন মাটির চুলার চাহিদা বেড়ে যায়। সে সময়ে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয় মাটির চুলা।
এছাড়া শহরের যেসব পরিবার সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহার করতে পারেন না এমন বাসা-বাড়ির গৃহিণী ও হোস্টেলের ছাত্র-ছাত্রীরাও এ চুলার অন্যতম ক্রেতা বলে জানান তারা।
বাংলাদেশ সময়: ০৭২১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১০, ২০১৬
এসআর