[কখনো জেলে, কখনো কৃষক, কখনোবা কঠোর পরিশ্রমী দিনমজুর। দারিদ্রের যাতাকলে নিষ্পেষিত জীবন।
উপকূলের প্রান্তিক জনপদ ঘুরে: যেখানে হাসি-খুশি ও আনন্দ-উল্লাসে বেড়ে ওঠার কথা, সেখানে শুধুই দারিদ্রের কষাঘাত। অনিশ্চয়তায় বিবর্ণ হয়ে ওঠে উপকূলের হাজারো শিশুর শৈশব। শিশুশ্রমের বেড়াজালে বন্দিজীবন কাটে উপকূলের হাজারো শিশুর।
যেখানে শিশুর হাতে থাকার কথা বই, সেখানে কোমলমতি শিশুদের কাঁধে ওঠে সংসারের বোঝা। যে চোখে স্বপ্ন দেখার কথা উজ্জ্বল ভবিষতের, সেই চোখ নির্ঘুম রাত জাগে গভীর সমুদ্রে মৎস্য আহরণের প্রয়োজনে। নৌকা আর জাল নিয়ে ছুটতে হয় মৎস্য শিকারে। শুধু জেলে, কৃষক ও শ্রমিকই নয়- কর্মের সব ক্ষেত্রে এদের সমান পদচারণা।
বরগুনা মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র, নলী মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র, পাথরঘাটা মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র ও চরদুয়ানি মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রসহ বিভিন্ন চরাঞ্চলে গিয়ে দেখা গেছে, ৮-১৫ বছর বয়সি শত শত শিশু কাজ করছে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। কেউ কাজ করে মৎস্য আড়ৎ, কেউ জেলে নৌকায় আবার কেউ কাজ করে পাইকারদের সঙ্গে। আবার অনেক শিশু কাজ করে অবতরণ কেন্দ্রগুলোর শ্রমিক হিসেবে। যে যেভাবেই কাজ করুক না কেন পরিশ্রমটা করতে হয় পুরোমাত্রায়। বড়দের সঙ্গে সমান তালে কাজ করতে হয় দু’বেলা দু’মুঠো খাদ্যের জন্য।
শুধু মৎস্য ঘাট কিংবা বাজারেই নয় একই অবস্থা কৃষি, ইট ভাটা, হোটেল, রেস্টুরেন্টেও। দিনমজুর হিসেবে চোখে পড়ে তাদের হাড় ভাঙা পরিশ্রম।
বরগুনা মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে গিয়ে দেখা গেছে, যে সব শিশুর এখন থাকার কথা ছিলো বাবা মায়ের কাছে, যাওয়ার কথা ছিলো বিদ্যালয়ে, তারা এখানে বড়দের সঙ্গে কাজ করছে পুরোমাত্রায়। কেউ সাগর থেকে আসা ট্রলারের ভেতর থেকে মাছ তুলছে, আবার কেউ সেই মাছের দর হাঁকাচ্ছে বিক্রির উদ্দেশে।
বরগুনা মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র ও মৎস্য বাজারে বাংলানিউজের সঙ্গে কথা হয় সুমন, মেহেদি, রাসেল, নাঈমসহ আরো অনেকের শিশু শ্রমিকের। প্রত্যেকেই দারিদ্রের বেড়াজালে বন্দি হয়ে সুখের শৈশব ছেড়ে এসেছে কষ্টের কর্ম জীবনে।
‘খাজার দোয়া’ মৎস্য আড়তে ৪ বছর ধরে কাজ করছে সুমন নামে ১২ বছর বয়সী একটি শিশু। এখন তার বয়স ১২! তাহলে পাঁচ বছর আগে কতো ছিলো? সেই সময় থেকেই হাড় ভাঙা খাটুনি তার নিত্য দিনের সঙ্গী। সুমনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিই সুমন। বাবা থেকেও না থাকার মতো। মা এবাড়ি ওবাড়ি ঝিয়ের কাজ করেন তাতে সংসার চলে না। এই মাছ বাজার থেকে সুমন যা রোজগার করে তা দিয়ে চলে তার সংসার।
প্রথমে সুমন মাছ বাজারে মাছ টোকাতো, এখন সে পুরোমাত্রায় একজন দক্ষ শ্রমিক। সুমনের সঙ্গে কথার ফাঁকে পড়াশোনা করতে ইচ্ছে হয় কিনা জানতে চাইলে সুমন বলে, ইচ্ছে তো হয় সাহেবদের পোলাপাইনের মতো পড়ালেহা হিইক্কা অনেক বড় হই, কিন্তু সংসার চালাইবো কেডা? মোগো ভাগ্যে যে পড়ালেহা নাই, পড়মু কেমনে?
একই সঙ্গে কাজ করেন বরগুনা সদর উপজেলার পোটকাখালী গ্রামের রাসেল (১৩)। পৃথিবীকে বুঝে উঠার আগে পৃথিবী ছেড়ে বিদায় নিয়েছেন জন্মদাতা পিতা ইউনুস গাজী। প্রতিদিন সকালে সাগর থেকে আসা ট্রলারের মাছ তুলতে হয় রাসেলকে। আর এখানে উপার্জিত টাকা দিয়েই চলে ওর সংসার। রাসেল বাংলানিউজকে বলেন, বাপ মইরা গেছে হেই ছোডকালে, এহন ঘরের দায় দায়িত্ব সবই তো আমার। কাম করমু না খামু কি?
কথা হয় মৎস্য ব্যবসায়ী দেলোয়ার হোসেনের সঙ্গে। খাজার দোয়া মৎস্য আড়তের মালিক তিনি। তার এখানেই কাজ করে সুমন, রাসেল, জসিমসহ আরো অনেকে। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, এই মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে প্রায় ৭০ থেকে ৮০জন শিশু কাজ করে যাদের প্রত্যেকের বয়স ১০ থেকে ১৫ বছর।
তিনি আরো বলেন, আমরা সাধারণত শিশুদের কাজে নিতে চাই না। কিন্তু কি করবো বলেন, এমন ভাবে এসে ধরে যে কাজ না দিয়ে উপায় থাকে না। এরা প্রত্যেকেই খুব গরীব কাজ না করলে খাবে কি? এখানে কাজ করে যা পায় তাতে অনেক সময় বাজারের টাকায় ঠেকা পড়লে আরো বাড়তি টাকা পয়সা দিয়ে থাকি, যাতে করে ওদের সংসার ভালো চলে।
শুধু ওরাই নয়, দারিদ্রের বেড়াজালে এভাবে হাজারো শিশুর শৈশব ও ভবিষৎ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে উপকূলে। শিশু অধিকারের কথা কাগজে কলমে থাকলেও নেই বাস্তবে। তাই উপকূলের হাজারো শিশু বঞ্চিত হচ্ছে তাদের প্রাপ্য অধিকার থেকে।
জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদ (Convention on the Rights of the Child, CRC)-এ স্বাক্ষরকারি ১৯১ দেশের মধ্যে প্রথম সারির দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। ১৯৯০ সালের আগস্টে স্বাক্ষর করলেও ১৯৮৯ সালের ২০ নভেম্বর সাধারণ পরিষদে গৃহীত হওয়ার পর থেকেই বাংলাদেশ এ সনদ গ্রহণ করে। ইতোমধ্যেই পেরিয়ে গেছে ২৫ বছর। আগের তুলনায় শহরে এলাকায় শিশুশ্রম কিছুটা কমলেও উপকূলের চরাঞ্চল ও জেলে পল্লীতে এর মাত্রা অত্যাধিক।
শিশুদের সুরক্ষায় ১৯৭৪ সালের শিশু আইন সংশোধন করে ২০১৩ সালের ১৬ জুন সংসদে শিশু আইন ২০১৩ পাস হয়। শিশু আইন ছাড়াও শিশু অধিকার রক্ষায় সরকারের অসংখ্য আইন ও প্রকল্প রয়েছে। এগুলোর মধ্যে জাতীয় শিশু নীতিমালা ২০১১, জাতীয় শিক্ষা নীতিমালা ২০১০ এবং জাতীয় শিশুশ্রম নিরোধ নীতিমালা ২০১০ অন্যতম।
এসব আইন ও নীতিমালায় শিশুদের সুরক্ষার বিষয় নিশ্চিত করার কথা উল্লেখ থাকলেও বাস্তবে এ আইন ও নীতিমালা শুধু কাগজে কলমেই আটকে আছে। ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশুদের অংশগ্রহণ চোখে পড়ছে অহরহ। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় অর্থ সঙ্কটে পড়ে এমন অনেক শিশুকেই শ্রমে নিয়োজিত করছেন গরীব অভিভাবকরা। অনেকে আবার অভিবাবকহীন হয়ে পেটের ক্ষুধায় আসে ঝুঁকিপূর্ণ এসব কাজে।
এ বিষয়ে মানবাধিকার কর্মী সাইমুল ইসলাম রাব্বি বাংলানিউজকে বলেন, শিশু অধিকার রক্ষায় প্রণীত আইন ও নীতিমালাগুলোর সঠিক প্রণয়ন এবং আমাদের সচেতনতাই পারে শিশুদের এই ঝুঁকিপূর্ণ কাজ থেকে সরিয়ে আনতে।
উপকূলের শিশুদের এই হাড় ভাঙা পরিশ্রমে বিবর্ণ শৈশবের জন্য দারিদ্রকেই দায়ী করে তিনি আরো বলেন, দেশ থেকে দারিদ্রকে দূর করতে হবে এবং সেই পথে আমাদের বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। আশা করি একদিন আমাদের শিশুদের জন্য নিশ্চিত ভবিষ্যতের একটি বাংলাদেশ উপহার দিতে পারবো।
বরগুনা জেলা শিশু বিষয়ক কর্মকর্তা ফারুক হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, শিশু শ্রম প্রতিরোধে সরকার ও বিভিন্ন উন্নয়ন সংগঠন নানামুখী কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। তবে উপকূলীয় অঞ্চলে শিশু শ্রমের মাত্রা একটু বেশি, এর কারণ হচ্ছে- এখানে অভাবী মানুষের হার বেশি। যার ফলে শিশুরা লেখাপড়া ছেড়ে বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নেমে পড়ছে।
তিনি আরো বলেন, শিশুদের এসব ঝুঁকিপূর্ণ কাজ থেকে রক্ষা করতে হলে তাদের পরিবারকে স্বচ্ছল করে গড়ে তুলতে হবে। তবেই আজকের শিশু আগামীতে একজন সফল নাগরিক হিসেবে এদেশ পরিচালনায় অংশ নিতে পারবে।
বাংলাদেশ সময়: ০০৪১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৭, ২০১৬
এসএইচ/জেডএম
উপকূল থেকে উপকূল
উপকূলে অপ্রতিরোধ্য শিশু শ্রম (পর্ব-১)
সুমন সিকদার, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।