ঢাকা, শনিবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

উপকূল থেকে উপকূল

উপকূল থেকে উপকূল

সেই কালরাতের ক্ষতচিহ্ন মোছেনি এখনও 

অশোকেশ রায়, আউটপুট এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৪৪ ঘণ্টা, জুন ২৭, ২০১৬
সেই কালরাতের ক্ষতচিহ্ন মোছেনি এখনও  ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

পাথরঘাটা (বরগুনা থেকে): ‘গাছ ধইরা কোনোমতে ঝুইল্যা আছিলাম। ১০/১২ মিনিট প্রচণ্ড বাতাস ছিটকে নিতে চাইছিল।

লগে বাঁধ ভাইঙ্গা বন্যা আইসা ভাসাইয়া নিয়্যা গেল আমাগো বাড়ি। দেখলাম, ভাইঙ্গা-চুইড়া গেল সবডি ঘর, টিন উডলো গাছে, গাছ গেল দুমড়া-মুইচড়া। একলগে মারা গেল আমগো বাড়ির ছয়জন। ঝড় থামলে তাগো লাশ পাওয়া গেছিল ক্ষেতে, পানিতে, ঝুইল্যা ছিল গাছেও’।  

ভয়াল সিডরের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা বলছিলেন বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার পদ্মা গ্রামের উনিশ বছরের রিপন। সে সময় তার বয়স ছিল ১২ বছর।  

সেদিনের কথা বলতে গিয়ে রিপনের চোখে-মুখে এখনও ফুটে ওঠে ভয়-আতঙ্ক আর সেই কালরাতের ধ্বংসযজ্ঞের ক্ষতচিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছে উপকূলের জনপদ পাথরঘাটা।  
  

২০০৭ সালের ১৪ নভেম্বর রাত থেকে ১৫ নভেম্বর সকাল পর্যন্ত বলেশ্বর নদের বাগেরহাটের শরণখোলা পয়েন্ট দিয়ে স্থলভাগে আঘাত হেনেছিল প্রলয়ঙ্কারী ঘূর্ণিঝড় সিডর। কয়েক ঘণ্টার সে তাণ্ডবে লণ্ডভণ্ড হয় উপকূলীয় ১১ জেলা।  


সিডর ও ১৫ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাসের মরণ ছোবলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় পাথরঘাটা সদর ইউনিয়নের পদ্মা গ্রামটি, যা ক্ষতচিহ্ন আজও রয়ে গেছে।  

২৪০ কিলোমিটার গতির প্রলয়ঙ্কারী এ ঘূর্ণিঝড়ের কারণে উপকূলীয় এ গ্রাম এখন ‘পদ্মা ভাঙন’ বা শুধু ‘ভাঙন’ বলেই পরিচিত।  

রিপন জানান, বলেশ্বরের পাড় ঘেঁষে থাকা দেড়শ’ মিটার বাঁধ পুরো ধসে আঁছড়ে পড়ে পদ্মার পূর্বপাড়ের জনপদে। মুহূর্তেই সিডরের স্রোত ঢুকে কয়েকশ’ ঘর-বাড়ি, মানুষ, প্রাণী সবকিছু নিয়ে গিয়েছিল অথৈ সাগরে। সব মিলিয়ে ৭৫ জনের মৃতদেহ পাওয়া গেলেও যারা পানির স্রোতে ভেসে যান, তাদের পাওয়া যায়নি।  

সেদিন মৃতদেহ পাওয়া গেছে নদীর পাড়ের বালু ও মাটির মধ্যে, ধান ক্ষেতে, গাছের মাথায় বিধ্বস্ত ঘর-বাড়ির মধ্যেও।
 
অন্যদিকে জীবিকার তাগিদে বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরতে যাওয়া জেলেদের অনেকেই ফিরে আসতে পারেননি স্বজনদের কাছে। সব মিলিয়ে সিডরে ৩৪৯ জন মানুষ মারা গেছেন পাথরঘাটায়, এখনও নিখোঁজ মাছ ধরতে যাওয়া ৪৬ জেলে।  

দেশের দক্ষিণাঞ্চলের শেষ স্থলসীমানা পদ্মা গ্রাম, বঙ্গোপসাগর-বিষখালী-পায়রা-বলেশ্বরের মোহনা ঘেঁষা। পশ্চিমে বলেশ্বর নদীর ওপাড়ে সুন্দরবন আর পূর্বে বিষখালী। উপজেলার ২টি পোল্ডারের ১১৭ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের শেষ প্রান্তও পদ্মা গ্রামকে ঘিরে।  


দুঃসহ স্মৃতি-হতাশা আর দুর্বিসহ যন্ত্রণা এখনও কুঁড়ে কুঁড়ে খায় সিডরে পরিবারের ১৩ জনকে একসঙ্গে হারানো রহমান খাঁ (২৭), ৭ জনকে হারানো রহিম মুন্সী (৩৩) এবং ৬ জনকে হারানো জাহাঙ্গীরদের (২৮)। নিখোঁজ জেলেদের স্বজনদের চোখে আজও শুধুই চোখের পানি।  

তবে সন্তানহারা বাবা-মা, বাবা-মা হারা এসব সন্তানরা এখনও পথের দিকে তাকিয়ে আছেন, হয়তো আবার ফিরে আসবেন তারা।  

সিডরে পাথরঘাটার ৫৮ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ সম্পূর্ণ ভেঙে গেছে। যা গত সাড়ে ছয় বছর পরও পুরোপুরি মেরামত না করায় চরম ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে নদী-সাগর আর ইলিশ নির্ভর পুরো পাথরঘাটা উপজেলার সব গ্রাম-জনপদের দুই লক্ষাধিক মানুষের জীবন-জীবিকা ও বেঁচে থাকা।  

জেলেসহ উপকূলের মানুষের জীবন-জীবিকা নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থা সংকল্প ট্রাস্টের নির্বাহী পরিচালক ও পাথরঘাটা প্রেসক্লাবের সভাপতি মির্জা শহিদুল ইসলাম খালেদ, পদ্মা ৬ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক মেম্বার আব্দুল মজিদ মিয়া (৭০), গ্রাম্য মুরুব্বি নূরুল আলম (৬৫), এক সময়কার জেলে আলতাফ মাঝির (৫০) দাবি, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবেলায় বাঁধ মেরামত ও পুনর্নির্মাণ করতে হবে। নদীর পাড় ঘেঁষে ব্লক ফেলার পাশাপাশি কেওড়া গাছ লাগিয়ে বেড়িবাঁধের চারপাশে সবুজ বেষ্টনী গড়ে তুলতে হবে।  

ম্যানগ্রোভ বনের আদলে সামাজিক বনায়ন গড়ে তোলার দাবি জানান তারা।  

তবে পাথরঘাটা পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, ৫০ কোটির টাকার বেশি দরকার হলেও ক্ষতিগ্রস্থ বেড়িবাঁধ মেরামতের জন্য সরকার থেকে মাত্র এক কোটি টাকা বরাদ্দ এসেছে।  

এ স্বল্প বরাদ্দেই বাঁধ ও মানুষকে রক্ষা করতে চেষ্টা করছেন বলে জানান পাউবোর উপ-সহকারী প্রকৌশলী শহিদুল ইসলাম।  

বাংলাদেশ সময়: ১০১৫ ঘণ্টা, জুন ২৭, ২০১৬
এএসআর/ 
**
 পানিতেই জীবন, পানিতেই মরণ!
** সেতু ভাঙা, তাই ডিঙিতে পারাপার

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।