ঢাকা, শনিবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

উপকূল থেকে উপকূল

উপকূল থেকে উপকূল

শিক্ষা নয়, কাজেই হাতেখড়ি পলাশদের

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৩১৭ ঘণ্টা, জুন ২৮, ২০১৬
শিক্ষা নয়, কাজেই হাতেখড়ি পলাশদের

চর চান্দিয়া, ফেনী থেকে: পাঁচ বছরের ছোট্ট পলাশ। ঠিকমতো বুঝতে শিখেনি, শুরু হয়নি স্কুলে যাওয়ার পালাও।

কিন্তু এখনই বাবার হাত ধরে প্রতিদিনই নদীতে মাছ ধরতে যেতে হয় তাকে।

শিক্ষা নয়, জন্মের পরপরই এসব কাজেই হাতেখড়ি হয় এ পাড়ার সুমন, রাজেশ, সুজিত, রামুসহ প্রায় সব শিশুর। আর এর মধ্য দিয়ে স্কুলে যাওয়ার আগেই দক্ষ হয়ে উঠছে তারা। হয়ে ওঠে বাবার অন্যতম সহকারী। কারো কারো আবার স্কুলে যাওয়াই হয়ে উঠে না।

বাড়তি উপার্জন, আর কাজে দক্ষ করে তুলতেই স্কুলগামী শিশুদের কাজে পাঠায় অবিভাবকরা। সন্তান পড়ালেখা শিখুক এটা তারা যেমন চান, আবার সংসার চালানোর বিদ্যা শিখুক- সেটাও চাওয়া তাদের।

তবে সবচেয়ে বড় কথা পেটের দায়! নয়ন জলদাস জানান, পেট চলে না। স্কুলে পাঠাই ঠিকই, কিন্তু বেশিদিন তো আর পড়াতে পারবো না। তাই ছেলেবেলা থেকেই বাপ দাদার পেশায় তাদের দক্ষ করে তুলি।

ফেনীর চর চান্দিয়া ঘুরে দেখা যায়, নরম হাত থেকে বই নামিয়েই চলে আসে জাল টানটে, মাছ ধরতে, কেউবা গরু চরাতে। পরিবারের সদস্যরা তাদের ওপর ভরসাও করেন।

স্থানীয়রা বলছেন, পরিবারের অভাব-অনটনের কারণে এ অঞ্চলের অধিকাংশ শিশু লেখা-পড়া থেকে ঝরে পড়ছে। চরাঞ্চলের অসংখ্য শিশু স্কুলে না গিয়ে ঝুঁকে পড়ছে রোজগারের দিকে।

দক্ষিণপূর্ব চর চান্দিনায় দেখা হয় সাত বছর বয়সী মাদ্রাসা ছাত্র আরাফাতের সঙ্গে। কড়া রোদের মধ্যে একপাল গরু নিয়ে মাঠ থেকে ফিরছিলো সে। গরুর পালের মধ্যে প্রায় হারিয়ে যাওয়া ছোট্ট ছেলেটি অদ্ভূত এক ক্ষমতায় তাদের শৃঙ্খলিত করে ফেললো। প্রায় প্রতিটি গরুর গলায় দড়ি পরিয়ে আটকে রাখলো।

বাংলানিউজের সঙ্গে আলাপে বাড়িতে প্রায় ১০টি গরু আছে জানায় আরাফাত। সেগুলো নিয়মিত মাঠে নিয়ে আসা-যাওয়ার কাজ
তাকেই করতে হয়। মাদ্রাসা শুরুর আগে গরুগুলোকে মাঠে দিয়ে মাদ্রাসা শেষে ফেরে। বিকেল দিকে রোদে তীব্রতা কমে এলে ফের গরু নিয়ে মাঠে। এ তার নিত্য দিনের দায়িত্ব।

রাজেশের (৯) গল্প আরেকটু আলাদা। ২০১০ সালে নদী ভাঙনে বাড়ি-ঘর হারিয়ে যাওয়ায় পরে সরকারি একটি বস্তিতে আশ্রয় নেয় তার পরিবার। সংসারের হাল ধরতে পিছিয়ে নেই সেও। জোয়ার এলে বাবার সঙ্গে মাছ ধরতে যায়, আবার ভাটায় ফিরে আসে। এভাবেই কাটছে তার শৈশব। এখন সে দক্ষ জেলে বলা চলে। তবে পড়াশুনা করতে না পারার দুঃখ তার রয়েই গেছে।

বিষণ্ন মুখে বলে, পড়ার ইচ্ছা আছিলো-কিন্তু নদী ভাঙনে বাপের সব গেছে- তাই আর পড়া হয় নাই।

সুজিতের পড়ালেখার বিষয়ে তার বাবা হরি শংকর বেশ সচেতন। নিজে ফেনী নদীতে মাছ ধরলেও ছেলেকে নিয়মিত পাঠান পাশের গ্রামের একটি
স্কুলে।

শংকর বলেন, নিজে পড়তে পারি নাই বইলা আমার ছেলেও অশিক্ষিত থাকবো! সারা জীবন জাইল্লা দিবো! কষ্ট কইরা হলেও ছেলেরে মানুষ করতে চাই।

এসব প্রসঙ্গে কথা হয় স্থানীয় শিক্ষক শেখ আবদুল হান্নানের সঙ্গে। তিনি বলেন, পড়ালেখার চেয়ে নদীতে মাছ ধরা বা অন্যান্য কাজে সন্তানদের দক্ষ করতেই বেশি পছন্দ চরাঞ্চলের অভিভাবকদের। জল দস্যু ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে সব হারিয়ে ফেললে বাধ্য হয়েই তারা সন্তানদের নানা পেশায় যুক্ত করে। এনজিও থেকে নেওয়া ঋণ পরিশোধ করতেও অনেক শিশুর পড়া বন্ধ হয়ে যায়।

স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সামছুদ্দিন খোকন জানান, অস্বচ্ছলতার কারণে এখানকার অনেক অভিভাবকই তাদের সন্তানকে স্কুলে পাঠাতে চায় না।

বাংলাদেশ সময়: ০৩১৫ ঘণ্টা, জুন ২৮, ২০১৬
জেপি/এটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।