নীলডুমুর, শ্যামনগর, সাতক্ষীরা থেকে: ঘূর্ণিঝড় বাড়তে থাকে, দুপুর ২টার দিকে বাতাস আর পানির স্রোত আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করে। ৮৫ বছর বয়সী মাকে কোলে করে বাড়ি থেকে বিজিবি’র টাওয়ারে রেখে আসেন শাহাদাত হোসেন।
বড় ছেলে জয়নাল আবেদিনের স্ত্রী গর্ভাবস্থায় তখন নিজ গ্রাম চাঁদনীমুখোতে। এরই মধ্যে খবর আসে, সেই গ্রাম তখন পানিতে তলিয়ে গেছে। নিজের বিজিবির চাকরির আগের পরিচয় দিয়ে একটি স্টিডবোটের সঙ্গে ছেলেকে চাঁদনীমুখোতে পাঠান শাহাদাত।
শ্বশুর বাড়ি গিয়ে দেখতে পান চৌকির ওপর তার গর্ভবতী স্ত্রী শুয়ে আছেন, চারদিকে থৈ থৈ পানি। শ্বশুরের পরিবারের সবারই একই অবস্থা। ঝড়ের প্রকোপে কাঁপছে ঘরের খুঁটি। বিজিবি সদস্যদের অনুরোধ করে স্পিডবোটে বৌ’কে নীলডুমুর নিয়ে অাসেন জয়নাল।
পরের দিন পুকুর ঘাটে গোসল করতে গেলে প্রসব বেদনা ওঠে স্ত্রীর। দ্রুত বাড়ি ফেরার পথেই প্রসব হয়ে যায়। তখন তুমুল বৃষ্টি, নদীর পাড়ে আছড়ে পড়ছে ঢেউ। বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ বুকের ভেতর খাঁমচি দিয়ে ধরছিল। আইলার ঝড়ের মধ্যেই জন্ম নেয় আয়েশা খাতুন। সেদিন ছিল ২৬ মে, ২০০৯ সাল।
২০১০ সালের মে মাসে প্রথম যখন বুড়িগোয়ালীনি ঘাটে আসি তখন এখানে খাবারের হোটেল বলতে ছিল শুধু শাহাদাতের এ দোকান। ৬ বছর পর আবারো এসে চিনতে ভুল হয়নি ৬২ বছর বয়সী শাহাদাতকে। মলিন জরাজীর্ণ এ ভাতের হোটেলের সবকিছুই অাগের মতো রয়েছে, শুধু খাবারের মূল্য বৃদ্ধি ছাড়া।
স্রোতস্বিনী নদী খোলপেটিয়া তিনটি ডালে ভাগ হয়েছে এখানে। বুড়িগোয়ালীনির পূর্ব পাড়ে গাবুড়া, দক্ষিণে সুন্দরবন। আইলায় বুড়িগোয়ালীনির বাঁধের ওপর পানি সরে গিয়েছিল দ্রুত। তাই ২০ বছরের পুরনো এ ভাতের দোকান সেবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি।
সোমবার (২৭ জুন) রাত ৯টার দিকে ভাত খাওয়ার কাস্টমার শুধুই আমি। খাওয়ার টেবিলে বাংলানিউজের সঙ্গে গল্প জুড়েন শাহাদাত। এই বন আর নদীকে এড়িয়ে গিয়ে একসময় বাঁচতে চেয়েছিলেন শাহাদাত। সুবেদার মোয়াজ্জেমের সঙ্গে খাতিরের সুবাদে ১৯৭৮ সালে খুলনায় লস্কর হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন বিজিবি, তৎকালীন বিডিআর।
তবে সেই আয়ে ১২ ভাই বোন, বাব-মা, স্ত্রী এবং নিজের তিন ছেলেমেয়ের ব্যয় মেটানো যাচ্ছিল না। ১৯৮৪ সালে বিজিবির চাকরি ছেড়ে দিয়ে আবারো উপকূলে এসে জীবনযুদ্ধে নামেন শাহাদাত।
তিনি বলেন, বনের মধ্যে নদীগুলোতে প্রচুর কাঁকড়া পাওয়া যেতো। দড়িতে কামুট, চড়ফাদা, সুছলি মাছ বেঁধে রাখা হতো। কাঁকড়া সেসব মাছ খেতে আসলে আটকে যেতো। কাঁকড়া ধরায় আয় ভাল ছিল। বলতে থাকেন তিনি।
৩ নৌকায় ৩৯ জনের বহাদ্দার হিসেবে ছিলাম আমি। তখনো বনের ভেতর ডাকাত ছিল। তবে তাদের মধ্যেও ভাল-খারাপ ছিল। মানুষ প্রতি আমাদের ২০০ টাকা করে দিতে হতো। সে সময় সুন্দরবনের এ অংশে বড় ডাকাত ছিল শাহাবুদ্দিন চেয়ারম্যানের ভাই শওকত ডাকাত।
একদিন আমার অগোচরেই ডাকাতি করা জামাকাপড় অামার নৌকার ছেলেপেলেদের দেয় ডাকাত দল। পরে জানতে পেরে এসব কাপড় আমি নদীতে ফেলে দিতে বলি।
শাহাদাত জানান, ১৯৯৫ সালে ১১৮০ টাকা পুঁজি দিয়ে এ ব্যবসা শুরু করেন তিনি। তখন থেকেই অামার স্ত্রী রান্না করেন অার অামি বিক্রি করি ও পরিবেশন করি। আয় ভাল বলতে হবে।
মাঝখানে কিছুদিন ট্রলারের ব্যবসাও করেছেন। এখন আর করছেন না। বলেন, এই খোলপেটুয়া নদী আর সুন্দরবন ছাড়তে চাইলেও, তারা অামাকে বেঁধে রেখেছে।
একটু পরেই বড় আপা বলে ডাক দেন শাহাদাত। সাত বছরের আয়েশা প্রবেশ করেন ফ্রেমে। বাংলানিউজকে জানান, স্থানীয় রাইফেলস সীমান্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়ে 'বড় ওয়ান' শ্রেণিতে পড়ছে সে। ২০০৯ সালের ২৫ মে সাতক্ষীরার উপকূলে অাঘাত হানে আইলা। ঘূর্ণিঝড় আইলা আর আয়েশার বয়স সমান।
**পুকুরের পানি খেয়েই অসুস্থ
**সরকারি হাসপাতালেই আস্থা
**ক্লিনিকের নাম ঝুলিয়েই ব্যবসা!
বাংলাদেশ সময়:০৯৫৪ ঘণ্টা, জুন ২৮, ২০১৬
এমএন/জেডএস