হাতিয়া (নিঝুম দ্বীপ) থেকে ফিরে: বেশিদিন আগের কথা নয়। বনের গাছ কাটার অপরাধে তাকে প্রকাশ্যে শাস্তি দিয়েছিলেন বন বিভাগের কর্মকর্তারা।
স্থানীয়দের অভিযোগ, ক্ষমতার জোরে পুরো নিঝুম দ্বীপকে গিলে খাচ্ছেন তিনি। মাছ ধরা খাল, নদী, বনের গাছ, পশু সবই তার দখলে।
সম্প্রতি নিঝুম দ্বীপের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে জানা যায় মেহরাজের নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের কথা। তার বিরুদ্ধে স্থানীয়দের অনেক অভিযোগ। মেহরাজের অত্যাচার থেকে বাঁচতে চান তারা। তাদের মতে, নিঝুম দ্বীপের বন রক্ষা করতে হলে থামাতে হবে মেহরাজকে।
স্থানীয় লোকজনের অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেল বন বিভাগের এক কর্মকর্তার কণ্ঠেও। নিঝুম দ্বীপের বন কর্মকর্তা (বিট ইনচার্জ) মোহাম্মদ নুরে আলম
হাফিজ জানালেন, বন কেটে জমি বন্দোবস্ত দেওয়া, হরিণ পাচার, সাগরে জেলেদের সর্বস্ব লুটে নেওয়াসহ হেন অপরাধ নেই যার সাথে মেহরাজের সম্পৃক্ততা নেই।
জানা যায়, মেহরাজের কাছে বন কর্মকতারাও অসহায়। বহিরাগত সন্ত্রাসীদের মাধ্যমে নিয়মিত বন উজাড় করছেন মেহরাজ। সম্প্রতি ইউপি নির্বাচনে জয়ী হয়ে তার ক্ষমতা আরও বেড়েছে।
বন কর্মকর্তা নুরে আলম হাফিজ বলেন, সংরক্ষিত বনও রেহাই পাচ্ছে না মেহরাজের হাত থেকে। তার নামে বন বিভাগ বন-আইনে এ পর্যন্ত ২০টির মতো মামলা করেছে। ফৌজদারি আইনে করা মামলাও রয়েছে তিনটি। সাধারণ ডায়েরির সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি।
২০০১ সালে নিঝুম দ্বীপের নয় হাজার ৫৫০ একরসহ জাহাজমারা রেঞ্জের মোট ৪০ হাজার ৩৯০ একর বনভূমিকে জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা দেয় সরকার। সেসব বন কেটে স্থানীয়দের কাছে জমি বিক্রি করছেন মেহরাজ। ফলে বিলীন হচ্ছে হরিণের অভয়ারণ্য।
মেহরাজের উত্থান কাহিনী
কিছুটা পিছনে ফিরে জানা যায়, ষাটের দশকে জরিপ শেষে ভূমিহীনদের স্থায়ী বসতি গড়তে নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার নিঝুম দ্বীপে বেশ কিছু পরিবারকে আড়াই একর করে ৬২৫ একর জমি বন্দোবস্ত দেওয়া হয়েছিল। তবে সত্তরের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ‘গোর্কি’ এখানকার প্রায় সাড়ে তিনশ পরিবারকেই নিশ্চিহ্ন করে দেয়। পরে হাতিয়াসহ বিভিন্ন উপকূলীয় এলাকার নদীভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ আবারও আশ্রয় নিতে থাকে নিঝুম দ্বীপে। ১৯৮৮ সালে এরশাদ সরকার নিঝুম দ্বীপকে নয়টি গুচ্ছগ্রাম এবং একটি কলোনিতে ভাগ করে ৪৭৯টি পরিবারের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে। সেই সময়েই হাতিয়ার সানন্দীর চর থেকে এসে প্রায় নিঃস্ব অবস্থায় মেহরাজের বাবা আবদুল মান্নান এখানে স্থায়ী হন। পেশায় জেলে হিসেবে জীবন যাপন করলেও ধীরে ধীরে স্থানীয় রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন তিনি। পরে ২০০৯ সালে ‘লগি-বৈঠা’ কাণ্ডে নিহত হন আওয়ামী লীগের কর্মী মান্নান।
স্থানীয়রা জানান, বাবার সঙ্গে নদীতে মাছ ধরতেন মেহরাজ। সাগরে মাছ ধরতে গিয়ে পরিচয় ও সখ্য হয় জলদস্যুদের সঙ্গে। প্রথম অবস্থায় নিজে মাছ ধরার পাশাপাশি জলদস্যুদের লুট করে আনা মাছ বিক্রির ব্যবস্থাও করতেন তিনি। এ অভিযোগে এক-এগারো সরকারের সময় কোস্টগার্ড তাকে আটক করে জেলে পাঠিয়েছিল। ২০০৩ সালেও একই অভিযোগে তাকে কোস্ট গার্ড আটক করে।
বাবার মৃত্যুর পর স্থানীয় আওয়ামী লীগের সহানুভূতি নিয়ে স্থানীয় রাজনীতিতে সক্রিয় হন তিনি। এরপরেই ধীরে ধীরে হয়ে ওঠেন এলাকার ত্রাস। তাকে রাজনীতির পথ দেখানো স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারাও এখন সমীহ করে চলেন তাকে।
হাতিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান মাহবুব মোর্শেদ লিটন বাংলানিউজকে বলেন, ‘‘নৌকা প্রতীক নিয়ে মেহরাজ সম্প্রতি নিঝুম দ্বীপ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছে। কিন্তু দলের নেতা-কর্মীদের সাথে তার সর্ম্পক নেই। বহিরাগত সন্ত্রাসীদের নিয়ে সে নিঝুম দ্বীপে ত্রাসের রাজ্য কায়েম করেছে। তার সন্ত্রাসী বাহিনীর কাছে এখন পুরো প্রশাসন যেন অসহায়। বনের গাছ, হরিন এবং নদীর জেলে কেউই তার কাছে নিরাপদ নয়। ’’
স্থানীয় ইউপি সদস্য কেফায়েত উল্লাহর অভিযোগ, ‘‘নিঝুম দ্বীপে চাঁদাবাজি, বনকাটা আর দস্যুতা চালিয়ে যাচ্ছে মেহরাজ। বনের নিরীহ হরিণগুলোও রক্ষা পাচ্ছে না তার লোভ থেকে। ’’
স্থানীয় মাছব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম জানান, মেঘনা নদীতে চলে মেহরাজের নেতৃত্বে চাঁদাবাজি। ইলিশের মৌসুমে প্রতিদিন নিঝুম দ্বীপে কোটি টাকার মাছের কারবার হয়। পানিতে নামার আগেই জেলেদের গুনতে হয় মেহরাজ বাহিনীর চাঁদার টাকা।
এসব অভিযোগের ব্যাপারে মুঠোফোনে চেয়ারম্যান মেহরাজের সঙ্গে কথা হয় বাংলানিউজের। সব অভিযোগকে মিথ্যা দাবি করে বাংলানিউজকে তিনি বলেন, ‘‘আমি রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের স্বীকার। বিরোধী পক্ষ এসব অপপ্রচার চালাচ্ছে। ’’
স্থানীয় বাসিন্দা মান্নান বলেন, ‘‘আমাদের একটাই দাবি, নিঝুম দ্বীপকে বাঁচাতে হবে। আর তার জন্য মেহরাজকে থামানো দরকার। না হলে নিঝুম দ্বীপে বনের একটি গাছও থাকবে না। তাকে আইনের আওতায় আনা হোক। ’’
বাংলাদেশ সময়: ০৬২০ ঘন্টা, আগস্ট ১৬, ২০১৬
জেপি/জেএম