উপকূল থেকে ফিরে: পটুয়াখালী জেলার রাঙ্গাবালি উপজেলার ৫টি ইউনিয়নেই আছে ৫টি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্র। ২০১৪ সালের ৫ আগস্ট এক যোগে এই স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোতে মেডিকেল অফিসার হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন ৫ জন এমবিবিএস চিকিৎসক।
এমনিতেই পটুয়াখালীর এই বিচ্ছিন্ন দ্বীপ উপজেলায় নেই কোন উপজেলা স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্র। যদিও গলাচিপা উপজেলা থেকে এই উপজেলা আলাদা হয়ে স্বতন্ত্র উপজেলার মর্যাদা পেয়েছে বছর পাঁচেক আগে। তাই ইউনিয়ন স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রই প্রমত্তা নদী ও সাগর বেষ্টিত এই উপজেলার মানুষের একমাত্র স্বাস্থ্য সেবার আশ্রয়। কিন্তু চিকিৎসক না থাকায় ঝাড়-ফুঁক, সনাতনী কবিরাজি চিকিৎসা ও হাঁতুড়ে ডাক্তারই এখানকার মানুষের এক মাত্র রোগ নিরাময়ের ভরসা।
রাঙ্গাবালি সদর উপজেলার ইউনিয়ন স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রে গিয়ে পাওয়া গেলো উপ-সহকারী মেডিকেল অফিসার রেজাউল করিমকে। স্যাঁতস্যাঁতে ঘরের মধ্যে অন্ধকারেই বসে আছেন একা। উপকূলে তখন চলছে ঘূর্ণিঝড় পূর্বাভাস কেন্দ্র ঘোষিত তিন নম্বর বিপদ সংকেত। এর প্রভাবে হচ্ছে প্রচণ্ড ঝড় বৃষ্টি। ফলে স্বাস্থ্য কেন্দ্রে রোগীর দেখা নেই। তবে কিছুক্ষণ পরই বৃষ্টিতে ভিজে ছাতা মাথায় এখানে আসেন এক নারী। ওষুধের সাপ্লাই না থাকায় (!) তাকে ব্যবস্থাপত্র দিয়েই বিদায় করলেন রেজাউল।
বাংলানিউজকে এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের অবস্থা জানাতে গিয়ে তিনি বলছিলেন, ২০১৪ সালের ৫ আগস্ট এই কেন্দ্রে নিয়োগ পেয়েছিলেন একজন মেডিকেল অফিসার। কিন্তু আদতেই তিনি কর্মস্থলে যোগ দেননি। তবে অনিয়মিত ভাবে কখনো কখনো কয়েকবার এসেছিলেন। মূলতঃ তিনি গলাচিপা বা পটুয়াখালীতে থাকতেন। বর্তমানে এই কেন্দ্রের দায়িত্বরত স্বাস্থ্যকর্তাও পটুয়াখালীতে থাকেন বলে শুনেছি। কোনদিনই তার চেহারা দেখিনি।
এর কারণ কি; এই প্রশ্নের জবাবে রেজাউল জানান, এটা মানসিকতার বাপার। ভালো থাকার স্থান নেই, পরিবেশ নেই, যোগাযোগ ব্যবস্থা বলতে পায়ে হাঁটা বা মটর সাইকেল। উপজেলা সদর হলেও উপজেলা স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র না থাকায় এখনো আমাদের কাগজে কলমে লিখতে হয়, উপজেলা গলাচিপা। সেখানে যাওয়ার জন্য খেয়ায় পেরুতে হয় আগুনমুখোর মতো ভয়ংকর নদী। এসব কারণেই হয়তো বিদ্যুৎহীন এই জনপদে আসলে বিসিএস অফিসাররা থাকতে চান না।
রেজাউল জানান, এই কেন্দ্রে গত এক বছর হলো কোন ওষুধ সরবরাহ নেই। ‘কেন্দ্রটি পরিচালিত হয় গলাচিপা উপজেলা স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রের মাধ্যমে। ওষুধ সেখানেই আসে। আমরা ওষুধ সরবরাহ পাচ্ছি না। জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর সরবরাহও বন্ধ আছে ৭ মাসের ওপরে’ বলেন তিনি।
এই কেন্দ্রেই উপ সহকারী কমউনিটি হেলথ অফিসার হিসেবে কাজ করেন আরো একজন। নাম অনুতোষ চন্দ্র দাস। বাংলানিউজকে তিনি বলছিলেন, ‘এই কেন্দ্রে ২৪ ঘণ্টাই গর্ভবতী নারী ও শিশুদের স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার কথা। এজন্য থাকার কথা একজন মেডিকেল কর্মকর্তা (এমবিবিএস) ২ জন উপ-সহকারী কমউনিটি হেলথ অফিসার, একজন টেকনোলজিস্ট, একজন ফার্মাসিস্টসহ আয়া, ধাত্রী ও পিয়ন। কিন্তু এগুলো কেবল কাগজে কলমেই। বাস্তবে তার কিছুই নেই। ’
তিনি বলেন, উপকূলের সবচেয়ে বড় ব্যবসা হলো মেডিকেল ব্যবসা। গলাচিপা বা পটুয়াখালীতে থাকলে চিকিৎসকরা দ্রুতই এ ব্যবসার পসার জমাতে পারেন। তাই হয়তো এই অন্ধকার জনপদে আসতে চান না।
তবে পসার জমাতে যে কেবল উপজেলা বা জেলা সদরেই যেতে হয় না তারও প্রমাণ মিললো অনুতোষের দোতলার রুমে গিয়ে। সরকারি এই অফিসেই তিনি জমিয়েছেন হোমিওপ্যাথির জমজমাট কারবার।
এ বিষয়ে তিনি বলেন, উপকূলীয় এই জনপদের মানুষ আসলে দরিদ্র। আমি তাদের সস্তায় স্বাস্থ্য সেবা দেওয়ার চেষ্টা করি। চেষ্টা করি এলোপ্যাথি না খেয়ে যেন কেবল অভ্যাস পরিবর্তনের মাধ্যমে তারা সুস্থ থাকেন।
এতো গেলো এখানকার মানুষের স্বাস্থ্য সেবার চিত্র। কিন্তু স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রের নিজেরই স্বাস্থ্য ব্যবস্থা বড় করুণ। দেখে বোঝারই উপায় নেই মাত্র কয়েকমাস আগেই ৮ লাখ টাকায় এই ভবনটির সংস্কারের কাজ হয়েছে। দোতলার প্রায় প্রতিটি ঘর ভাসছে বৃষ্টির পানিতে। ছাদ ও দেওয়াল চুঁইয়ে পড়ছে পানি।
বাংলাদেশ সময়: ২০০৩ ঘণ্টা, আগস্ট ১৭, ২০১৬
আরএম/আরআই