ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

উপকূল থেকে উপকূল

মনপুরায় মেঘনা গ্রাস করছে ফাদার টিমের গড়া ‘আশ্রয়’

মফিজুল সাদিক, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৩৩ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৫, ২০১৮
মনপুরায় মেঘনা গ্রাস করছে ফাদার টিমের গড়া ‘আশ্রয়’ মেঘনায় ভাঙছে মনপুরা। ছবি: বাংলানিউজ

মনপুরা থেকে: ভোলার এক বিচ্ছিন্ন উপজেলা মনপুরা দ্বীপ। বঙ্গোপসাগর কোলের এ দ্বীপের পুরোটাই নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি। সরকারি ভবন বাদে কংক্রিটের বাড়ি নেই বলা চলে। অধিকাংশ বাড়িই টিন দিয়ে বানানো।
 
 

মনপুরা ১ নং ইউনিয়নের আন্দির পাড় ইউনিয়নে আছে বেশ কিছু কংক্রিট ও ইটের বাড়ি। একতলার বাড়িগুলো আবার একটি মাত্র কক্ষের।

খসে খসে পড়ছে বালি-সিমেন্ট। বের হয়ে আসছে লাল ইট। বাড়িগুলো দেখেই বোঝা যায় বেশ পুরনো।
 
১৯৭০ সালে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে সন্দ্বীপ, হাতিয়া ও মনপুরা দ্বীপে প্রাণ হারায় কয়েক লাখ  মানুষ। এক রাতে এতো মৃত্যু আগে দেখেনি দ্বীপবাসী। সেদিনের মানবিক বিপর্যয়ে মনপুরা দ্বীপবাসীর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন ফাদার রিচার্ড উইলিয়াম টিম। ঢাকার নটরডেম কলেজের প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম ও ষষ্ঠ অধ্যক্ষ। মাথা গোঁজার ঠাঁই করে দেন দ্বীপবাসীকে। গড়ে দেন ১০০টি বাড়ি। প্রতিটা বাড়িই বানিয়ে দেওয়া হয় ইট ও কংক্রিটে।
 
‘আশ্রয়’ হিসেবে ফাদার টিমের গড়ে দেওয়া সেই শতাধিক বাড়িরই অর্ধেক গিলে খেয়েছে মেঘনা। বাকিগুলোও বালি-সিমেন্ট খসে, ইট ধসে ধ্বংসের পথে।
 
আন্দির পাড়ের বাসিন্দা জমেলা বিবি কথা বলেন বাংলানিউজের সঙ্গেমনপুরা দ্বীপে ফাদার টিম মানেই বিপদের বন্ধু বলে পরিচিত এক নাম। অকৃত্রিম বন্ধুর গড়ে দেওয়া বাড়িগুলো নিয়ে ভয়ে আছেন আন্দির পাড়ের বাসিন্দা জমেলা বিবি। তার বাবা ছমির মিয়া ওই ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণ হারান। এরপর তাদের একটি কংক্রিটের বাড়ি নির্মাণ করে দেন ফাদার টিম। জমেলা বিবি’র মতো আরও অনেকে ফাদার টিমের বানিয়ে দেওয়া বাড়িতে দিন-দুনিয়া দেখছেন।

আন্দির পাড়ের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ভাঙনই মনপুরাবাসীর একমাত্র শত্রু। মেঘনা নদীতে অনেকের ঘর-বাড়ি থেকে শুরু করে সহায়-সম্বল বিলীন হয়ে গেছে।  

‘আমাদের এখানে ভাংগাডাই মেন সমেসসা (প্রধান সমস্যা)। ভাংগাতে ঘরবাড়ি নিয়া কুলান যায় না। একটা হাসপাতাল আছে ঠিকমতো সব চিগিসসা (চিকিৎসা) নাই। লবণ পানি বেশি ভাঙে। লবণ পানিতেই মেন সমেসসা। এই যেখানেই ভিজে সেখানের মাটিটা গইলা যায়। আমার এমন একটা দ্যাশ, চারোদিকে ভাংগে। মিডিওম (মাঝারি ধরনের) ভাংগনে পারা যায়, বেশি বেশি হইলে পারান যায় না। ’
 
আক্ষেপ করে কথাগুলো বলছিলেন মনপুরার অদূরের কলাতলী দ্বীপের বাসিন্দা ওয়াজি উল্লাহ। মনপুরার রামনেয়াজের বাসিন্দা ছিলেন তিনি। ১৪ বছরের ব্যবধানে তার দু’টি বাড়ি মেঘনায় বিলীন হয়ে গেছে। এখন মনপুরা থেকে ১৭ কিলোমিটার দূর কলাতলী দ্বীপে বসবাস করেন তিনি।

মেঘনায় ভাঙছে মনপুরাওয়াজি উল্লাহর মতো সব হারানোর ভয়ে থাকেন ৩৭৩ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এই দ্বীপের সোয়া লাখ বাসিন্দাই। আবার কোন দুর্যোগ এসে কেড়ে নেয় সর্বস্ব।  
 
রঙিন পর্দার শান্ত ‘মনপুরা’ ঘুরে দেখা যায়, মেঘনার উত্তাল ঢেউ বিভিন্ন সময়ে গিলেছে ফসলি জমি, গাছপালা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ, মন্দির, দোকান, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। নদীগর্ভে গেছে মাঝ গ্রাম, কলাতলী। আন্দির পাড়, সীতাকুন্ড ও ঈশ্বরগঞ্জ গ্রামও বিলীন হওয়ার পথে।
 
মেঘনা ত্রাস হয়ে দাঁড়িয়েছে দ্বীপ উপজেলার ২ নং হাজিরহাট ইউনিয়নের সোনার চর, চরঞ্জান, দাসেরহাটেও। উপেজেলা পরিষদের স্থাপনা হাজিরহাটে। কিন্তু তীব্র ভাঙনের মুখে কয়েকবার স্থানান্তর করা হয় পরিষদ। বর্তমানে পরিষদ থেকে নদীর দূরত্ব মাত্র তিনশ’ মিটার। নদী থেকে কয়েকশ’ মিটার দূরে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে বন বিভাগের কার্যালয়, হাজিরহাট মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয়, মনপুরা থানা এবং হাজিরহাট বাজারও।  

দ্বীপ ঘুরে এবং স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দ্বীপের ভাঙন উত্তরে, যেখানে মেঘনার উত্তাল ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে। দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের উপকূলে ভাঙন নেই বলা চলে। বরং ওই এলাকায় নতুন আশার আলো নিয়ে জাগছে নতুন নতুন চর।

স্থানীয় প্রশাসনিক কর্মকর্তারা জানান, বিচ্ছিন্ন দ্বীপ মনপুরার ভাঙন রোধে ১৯২ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে সরকারের। এই ব্যয়ে রামনেওয়াজ ও ঘোষের হাট এলাকা রক্ষা প্রকল্পের কাজ এগিয়ে চলেছে। ভাঙনরোধে মনপুরার চারপাশে সিসি ঢালাইও দেওয়া হবে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন ঘিরে মনপুরাবাসীও আশা বুক বাঁধছেন।

বাংলাদেশ সময়: ১৮২৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৫, ২০১৮
এমআইএস/এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।