ঢাকা, বুধবার, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

উপকূল থেকে উপকূল

উপকূলের জীবন-জীবিকা

দারিদ্র্যের শেকলে বাঁধা তাদের জীবন

শফিকুল ইসলাম খোকন, উপজেলা করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১২৭ ঘণ্টা, মার্চ ১৪, ২০২২
দারিদ্র্যের শেকলে বাঁধা তাদের জীবন

উপকূল ঘূরে এসে: মজিবুর রহমান ও কবির। বাপ দাদার দেখাদেখি সাগরে মাছ ধরার কাজ করছেন।

বিরামহীন এ পেশায় তারা সইয়ে গেছেন। ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, রোদ, শীত যেন মজিবর, কবিরদের কাছে সমান। গভীর সাগরে অসুস্থ হয়ে পড়লে চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা নেই। প্রাথমিক চিকিৎসাও তাদের কপালে জুটেনা।

অপরদিকে, মাছ সংরক্ষণের জন্য বরফ তৈরির শ্রমিক ফারুক মাতুব্বররা তীব্র শীতেও কাজ করে যাচ্ছেন বিরামহীন। এতো ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও কোনো চিকিৎসা সেবা তাদের কাছে পৌঁছায়না। দেশের মৎস্যখাতে সিংহভাগ অবদান থাকা সত্ত্বেও তাদের নিয়ে কেউ ভাবেনা। সরকারি-বেসরকারি অনেকের জন্য প্রকল্প থাকলেও উপকূলের জেলে শ্রমিকদের নিয়ে কোনো প্রকল্প বা গবেষণাও হতে দেখা যাচ্ছেনা।

প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে দারিদ্র্যের শেকলে বাঁধা উপকূলের জেলে জীবন। গভীর সমুদ্রে দস্যু আর দুর্যোগ তাদের পিছু ছাড়েনা। এর মধ্যে আবার সাগরে অসুস্থ হলে চিকিৎসা বঞ্চিত হাজার হাজার জেলে। সাগরে মাছ ধরা অবস্থায় হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে কিনারে আসতেই আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন। কখনো কখনো মৃত্যুর কোলেও ঢলে পড়েন। এদিকে সাগরে ট্রলারের মাছ সংরক্ষণের জন্য বরফ তৈরির কাজের শ্রমিকরাও ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন। অনেক শ্রমিকরা এসব ঝুঁকির কাজে অসুস্থ হয় এবং পঙ্গুত্বও বরণ করে বেকার হতে বাধ্য হয়। উপকূলে এমন দুর্বিষহ ঘটনা হাজারো। উপকূলের জেলে জীবনের হিসেবটা এমনই। নানামুখী সংকটের ভেতর দিয়ে অতিক্রান্ত এই জীবনের হিসেব মেলানোটাই যেন কঠিন। জীবনভর মাছ ধরে কাটানো বেশকিছু মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় তাদের অভিব্যক্তি।

জলবায়ু পরিবর্তন ওলট-পালট করে দিচ্ছে উপকূলের জেলেদের জীবন। ক্রমাগত পরিবর্তন সরাসরি তাদের জীবিকায় প্রভাব ফেলছে। ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের তাণ্ডব, জোয়ারের তীব্রতা, নদী-ভাঙন, নদীতে মাছ কমে যাওয়াসহ বিভিন্ন কারণে বহু জেলে পেশা ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। অথচ এই পেশা জেলেদের জীবিকার একমাত্র অবলম্বন। বিকল্প জীবিকা কিংবা নিরাপত্তায় বিশেষ কোনো ব্যবস্থা নেই। এসব শ্রমিকদের সুরক্ষার জন্য নেই কোনো উদ্যোগ। বিশ্বে ইলিশ উৎপাদনের ৭৫ ভাগই বাংলাদেশের আর জিডিপিতে ইলিশের অবদান ১ শতাংশ। পৃথিবীর সব দেশেই এ মাছের চাহিদা রয়েছে। প্রতিবছর ইলিশ মাছ রপ্তানি করে প্রায় ৩০০ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা আয় হচ্ছে। অথচ এ খাতের জোগানদার জেলেদের নিয়ে কেউ ভাবছেনা।

কথা হয় এফবি নাজমা ট্রলারের মাঝি কবির হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে সাগরে মাছ ধরে জীবিকা-নির্বাহ করছি। ট্রলারের মাঝি হওয়াতে ১৫-১৮ জন জেলের দায়িত্ব বর্তায় আমার ওপর।

২৫ বছরের অভিজ্ঞতার আলোকে কবির বাংলানিউজকে বলেন, এতো বছরে সাগরে মাছ ধরার সময় অনেকবার অসুস্থ হয়ে পড়েছি। মাথা, পেট ব্যথা, ডায়রিয়াসহ প্রাথমিক পর্যায় অসুস্থ হলে সেলাইনসহ কিছু ট্যাবলেট নিয়ে যাই। কিন্তু বড় কোনো সমস্যা হলে কুলে আসতে হয়। কুলে আসতেই একদিন এক রাত সময় লাগে। কখনো তার বেশিও লাগে। সাত বছর আগে কুলে আসার আগেই সাগরে বসে নাড়ে প্যাচ পড়ে শাহজাহান নামে এক জেলে মারা গেছে।  

তিনি বলেন, অন্তত দেশের স্বার্থে এসব জেলেদের বাঁচিয়ে রাখতে বঙ্গোপসাগরে ভ্রাম্যমাণ চিকিৎসা কেন্দ্র স্থাপন করা দরকার। বৃষ্টিতে ভিজে আর রোদে পুড়ে শরীর আর শরীর থাকেনা। সাগরে লবন পানির কারণে শরীর কালো হয়, চামড়া পুড়ে যায় এমনকি ওই পানি চোখে লাগলেও অনেক সমস্যা হয়ে থাকে।

জেলে মজিবর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, দেড় বছর আগে জাল টানার সময় দড়িতে পা পেচিয়ে গিয়ে পা ভেঙে যায়। প্রচুর রক্তরণ হয়। দ্রুত কুলের দিকে রওনা দিলে আসতে দুদিন বরিশালে চিকিৎসা নেয়ার পর চিকিৎসকদের পরামর্শে ঢাকা পঙ্গু হাসপাতালে গেলে পা কেটেই ফেলতে হয়েছে। বর্তমানে আমি পঙ্গু অবস্থায় আছি, সাগরে তো যেতেই পারছিনা এমনকি এখন ভারী কোনো কাজও করতে পারছিনা।

উপজেলার চরলাঠিমারা গ্রামের নকুল মিস্ত্রীর ৪ ছেলের মধ্যে ৩ ছেলে সিডরের বঙ্গোপসাগরে ট্রলারডুবিতে মৃত্যু হয়। অপর ছেলে পরিমল মিস্ত্রী গত বছরের ৭ নভেম্বর সাগরে দড়িতে পেঁচিয়ে পানিতে ডুবে যায়। কয়েক ঘণ্টা পর সহযোগী জেলেরা উদ্ধার করে ট্রলারে উঠানোর সঙ্গে সঙ্গেই মৃত্যু হয়। চলতি বছরের ৪ ফেব্রুয়ারি বঙ্গোপসাগরের ঝড়ের কবলে পড়ে ১৮টি ট্রলার ডুবে যায়। এতে ৮ জনের মরদেহ উদ্ধার হয়। ওই ঘটনায় ওপর একটি মাছ ধরা ট্রলার ডুবে গেলে ৫ জেলেকে ২১ ঘণ্টা পর উদ্ধার করে অপর এক ট্রলারের মাঝি আল আমিন সরদার। প্রচণ্ড শীতে ২১ ঘণ্টা পানিতে থাকায় সকলেই শারীরিক অসুস্থ হয়ে পড়ে। কিন্তু তাদের ট্রলারে কিংবা সাগরে কোথাও কোনো চিকিৎসা ব্যবস্থা না থাকায় তাদের গরম কাপড় দিয়ে শরীরে ঢেকে রাখা এবং আগুনের তাপ দিয়ে শরীর গরম করে। দুদিন পর কুলে এসে চিকিৎসা দেওয়া হয়।  

উদ্ধারকারী মাঝি আল আমিন সরদার বাংলানিউজকে বলেন, ২১ ঘণ্টা পর ভাসমান অবস্থায় উদ্ধার করে ৫ জেলেকে নিজেদের বুদ্ধি অনুযায়ী সেবা দিয়েছি। অথচ সাগরে যদি ভ্রাম্যমাণ চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকতো হয়তো সাগরে বসেই তাদের সেবা দিয়ে সুস্থ করা যেত।

এদিকে সাগর ও কুলে মাছ সংরক্ষণের জন্য বরফ তৈরির শ্রমিকরাও অনেক স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন। কথা হয় বরফ শ্রমিক ফারুক মাতুব্বরের সঙ্গে। ৩০ বছর ধরে বরফ তৈরির কাজ করছেন। বেশিরভাগ সময় রাতেই বরফ তৈরির কাজে থাকতে হয়। শীতের দিনেও কোনো অবসর নেই। একদিকে বরফ তৈরি অপরদিকে বরফ ভাঙার কাজ করছেন।  

ফারুক বলেন, বরফ উঠানো নামানোর কারণে কোমরে প্রচণ্ড চোট লাগে। তারপরেও কাজ করতে হয়। ক্যান প্রতি ১৩ টাকা হারে মজুরি পাই। একবার বরফ পায়ে পরে পা ভেঙে যায়। সেই থেকেই খুব কাজে কষ্ট হয়। এলার্জি, শ্বাসকষ্টসহ ঠাণ্ডাজনিত নানা রোগে আক্রান্ত হতে হয়।

অপর শ্রমিক মো. হারুন মিয়া (৭০) বলেন, বরফ তৈরি কাজ করেছি ৩৫ বছর। ৫ বছর আগে কোমরে ব্যথা পেয়ে এখন হাঁটা-চলাই করতে পারছিনা। বরফ মিলে যারাই কাজ করছে তাদের সকলের বরফের ঠাণ্ডা এবং শীতের ঠাণ্ডায় এক হয়ে শরীরের নানাবিধ বাসা বাধে। এর ফলে এসব শ্রমিকরা অল্প বয়সেই পঙ্গুত্ব বরণসহ নানাবিধ রোগে আক্রান্ত হয়। চরদুয়ানী ইউনিয়নের নুরুল ইসলাম হাওলাদার। গভীর সাগরে মাছ ধরার সময় হঠাৎ মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যায়। কয়েক ঘণ্টা অজ্ঞান থাকার পরে জ্ঞান আসার পর শারীরিক দুর্বলতা দেখা দিলে তাৎক্ষণিক ট্রলারের অন্যান্য জেলেরা দ্রুত কুলে আসার জন্য রওনা দেন। সহযোগিরা তাকে সেবাযত্ন করার কয়েক ঘণ্টার মাথায়ই মারা যায় নুরুল ইসলাম। সাগর থেকে কুলে আসতে দুইদিন সময় লেগে যায়। সাগরে হয়তো জেলেদের উদ্ধারের জন্য দ্রুত যান থাকলে অন্তত চিকিৎসা সেবা দেয়া যেত।

বরগুনা জেলা মৎস্যজীবী ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, সাগরে হাজার হাজার ট্রলার দুর্যোগের ঝুঁকিতেতো থাকেই এর মধ্যে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে কোনো চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই। কুলে আসতে আসতে অনেকে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে এমনকি মারাও যায়।  

তিনি আরও বলেন, সাগরে থাকার সময় জেলেদের খাবারের বিশুদ্ধ পানি ব্যবহারের জন্য পাথরঘাটায় একটি শোধানাগার করা হলে জেলেরা বিশুদ্ধ পানি পেত। এতে অন্তত পানিবাহিত রোগ থেকেও মুক্তি পেত জেলেরা। তাদের তথ্য মতে গত ১০ বছরে প্রায় ৩০০ জেলের সলিল সমাধি হয়েছে বঙ্গোপসাগরে মাছ শিকারে গিয়ে। এদের মধ্যে নিখোঁজের তালিকায় রয়েছে প্রায় ১০০০ হাজারেরও বেশি জেলে।

এ বিষয় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের (ঢামেক) চর্ম রোগ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. রাশেদ মোহাম্মদ খান বাংলানিউজকে বলেন, শরীরে যেকোন সমস্যার সৃষ্টি হলে তাৎক্ষণিক চিকিৎসা নেয়া দরকার। কিন্তু সাগরে যারা দুর্ঘটনার শিকার হয় তাদের জন্য তো আরও ঝুঁকি। এরমধ্যে যদি কাটাছেড়ার মতো কোনো ঘটনা ঘটে তাতে দীর্ঘ সময় হলে রক্তক্ষরণে শূন্যতা দেখা দিবে।

তিনি আরও বলেন, বৃষ্টিতে ভেজা আর রোদের তাপেও তাদের শরীরের অনেক সমস্যা হতে পারে। অনেকদিন ধরে এ অভ্যাসের কারণে শরীরের চামড়া শুষ্ক ও খসখসে হয়ে যায়। যার ফলে ত্বক মোটা হয়ে গিয়ে দীর্ঘমেয়াদী ত্বকের রোগ অ্যাকজিমা সৃষ্টি হয়।

প্রতিকারের বিষয় তিনি বলেন, সাগরে থাকাকালীন যতটা সম্ভব বৃষ্টির পানি এবং রোদ না লাগানো। তাছাড়া সাগরে যাওয়ার পূর্বে প্রতিবার অন্তত একবার হলেও ডাক্তারি চেকআপ এবং পরামর্শ নেয়া উচিত। বরফতো এমনিতেই ঠাণ্ডা, শীতের দিনেতো আরও স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর। এলার্জি, সর্দি, কাশিসহ ঠাণ্ডাজনিত নানা রোগ হয়। তাছাড়া শীতের দিনে হার্টঅ্যাটাকেরও ঝুঁকি রয়েছে।

>>> দারিদ্র্য বাড়াচ্ছে উপকূলের নারীদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি

বাংলাদেশ সময়: ১১২২ ঘণ্টা, মার্চ ১৪, ২০২২
এনটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।