ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

উপকূল থেকে উপকূল

ভাঙা-গড়ার খেলায় শুধু ভেঙেছে আমেনার জীবন, গড়েনি কখনও

শফিকুল ইসলাম খোকন, উপজেলা করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৫১ ঘণ্টা, নভেম্বর ৩০, ২০২২
ভাঙা-গড়ার খেলায় শুধু ভেঙেছে আমেনার জীবন, গড়েনি কখনও আমেনা বেগম

পাথরঘাটা (বরগুনা): পরনের কাপড় কয়েক জায়গায় ছেঁড়া, শরীরের চামড়ায় বার্ধক্যের ছাপ স্পষ্ট। গায়ের রং বলে দেয় রোদ আর বৃষ্টিতে একাকার হয়ে কাজ করার কথা।

এ পর্যন্তই শেষ নয়, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিষখালী নদীর কড়াল গ্রাসে তিন ভাঙা দিয়েছে বসত ঘর। স্বামী হারা হয়ে কপাল ভাঙছে অনেক আগেই।  

বলছি উপকূলীয় উপজেলা পাথরঘাটার বিষখালী নদী সংলগ্ন জিনতলার বেড়িবাঁধের বাসিন্দা আমেনা বেগমের (৬৫) কথা। ভাঙা-গড়ার খেলায় নিজের জীবন শুধু ভেঙেছে কিন্তু গড়ে ওঠেনি আর। মাছ বাছাই করে আর অন্যের বাড়িতে কাজ করে কোনো রকমে পেট চলে তার।

একদিন মাছ বাছাই করে দুদিনের মাছ পায়। একবিংশ শতাব্দীতে এসেও আমেনা বেগম একদিন রান্না করলে দুদিন আর চুলা জ্বলে না। উপকূলের এমন চিত্র শুধু আমেনা বেগমই নয়, অনেক স্বামী হারা ও পরিত্যক্তা নারীর। জলবায়ু বা আবহাওয়া পরিবর্তন কি এখানকার বাসিন্দারা বোঝে না, তারা বোঝে কপালের পরিবর্তন, ঘর ভাঙার পরিবর্তন।  

জানা যায়, ২০ বছর আগে স্বামী ছিদ্দিকুর রহমান আমেনা বেগমকে তালাক দেন। তাদের দাম্পত্য জীবনে দুই ছেলে রয়েছে। ছেলেরা নিজের সংসার নিয়েই আছেন। তাদের নিজেদের সংসার চালানোয় দায়, মায়ের খবর নিতে পারে না। তার নিজের দুই সন্তানের পাশাপাশি ভাইয়ের এক ছেলেকে বড় করেছেন আমেনা। ৪ মাসের শিশু আউয়ালকে রেখে মারা যান ভাইয়ের স্ত্রী, সেই থেকে ওই ছেলেকে নিজের বুকের দুধ খাইয়ে, হাড়ভাঙা কষ্ট করে এসএসসি পর্যন্ত লেখাপড়া করিয়েছেন। নিজের দুই ছেলে দূরে থাকলেও কথা ছিল অন্তত ফুফুকে (আমেনা) ছেড়ে কখনোই যাবে না ভাতিজা আউয়াল! কিন্তু শেষমেশ সন্তান সমতুল্য ভাতিজা আউয়ালও ঠিকই বিয়ে করে তাকে ছেড়ে অন্যত্র থাকে। ভাতিজাকে নিজের সন্তানের মতো লালন পালন করায় এলাকায় আউয়ালের মা বলেই পরিচিত আমেনা। এখন একাই কুঁড়ে ঘরে থাকেন তিনি। ২০ বছর আগে তালাক দেওয়া স্বামী ৪ বছর আগে মারা যান।

কথা হয় আমেনা বেগমের সঙ্গে। কেমন আছেন জানতে চাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কেঁদে ফেলেন তিনি। বলেন, দিন যায় কোনো রকম। নদীতে মাছ শিকার করে আসা জাল থেকে মাছ বাছাই করলে কিছু মাছ পাই। তা দিয়ে দু-তিনদিন চলে, আর অন্যের বাড়িতে কাজ করে যা পাই তা দিয়ে কোনো রকম পেট বাঁচে। প্রতিবেশীরাও সাহায্য করে মাঝে মধ্যে।

এই বয়সে একা ঘরে থাকতে পারেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আরে বাবা ২০ বছর তো স্বামী ছাড়াই থাকলাম। ছেলে দুটো ১৫ বছর ধরে আলাদা থাকে। ‌ শেষ ভরসা ছিল ভাইয়ের ছেলে সেও আমাকে ছেড়ে চলে গেছে, কি আর করার থাকতে তো হবেই। একদিন রান্না করলে দুদিন রান্না হয় না। তারপরেও তো বেঁচে থাকতে হবে। স্থানীয় পর্যায়ে সরকারি কোনো সহযোগিতা পান কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কোনো সহযোগিতা পাই না। ভিজিডি বা বিধবা ভাতাও যদি পেতাম তাহলেও কিছুটা ভালো থাকতাম।

দেশের দক্ষিণাঞ্চলের জেলা বরগুনায় জলবায়ু পরিবর্তন ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলছে। ঘন ঘন দুর্যোগের সম্মুখীন হচ্ছে এই জেলার মানুষ। বঙ্গোপসাগরের উপকূল ঘেঁষে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়া সংকটকে আরও ঘনীভূত করছে। নদীর ভাঙা-গড়া, পানির লবণাক্ততাও প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। উপকূলের অনেক এলাকা এখন এই সমস্যায় আক্রান্ত। অতিরিক্ত গরমও জলবায়ু পরিবর্তনের আরেক ধরনের প্রভাব। এতে মানুষের জীবন-জীবিকা সংকটের মুখে পড়ছে। এসব লোকালয়ের শিশুদের পাশাপাশি বড়দেরও ঝুঁকি বেশি। গরম ও অন্যান্য জলবায়ু সংক্রান্ত সমস্যার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার সক্ষমতা এখানকার বাসিন্দারা দুর্বিসহ অবস্থায় রয়েছে।

পাথরঘাটা সদর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আলমগীর হোসেন বলেন, বঙ্গোপসাগর সংলগ্ন বিষখালী-বলেশ্বর নদ ঘেঁষা পাথরঘাটা উপজেলা। এখানকার বাসিন্দারা যেমন জলবায়ু পরিবর্তন জনিত নানা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে তেমনি অভাবসহ নানা কারণে অসহায় দিনযাপন করছে। প্রায় প্রতিটি পরিবারই কোনো না কোনো রকম কষ্টে দিনযাপন করছে।

তিনি আরও বলেন, আমেনার মতো অনেক নারী স্বামী পরিত্যক্তা ও বিধবা। যার অন্যতম কারণ হলো সাগরে গিয়ে নিহত ও নিখোঁজ হওয়া। আমাদের পরিষদের সামর্থ্য অনুযায়ী সহযোগিতা দেওয়ার চেষ্টা করছি। আমেনা বেগমও এর বাইরে নয়।

বাংলাদেশ সময়: ১১৪৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ৩০, ২০২২
আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।