বাংলাদেশের জার্সিতে আর না খেলার কথা জানিয়ে দিয়েছেন তামিম ইকবাল। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশের অন্যতম সফল এই ব্যাটারকে শুভেচ্ছা ও বিদায় জানাচ্ছেন জাতীয় দলের ক্রিকেটাররা।
জাতীয় দলে তামিমের দীর্ঘদিনের সতীর্থ মুশফিকুর রহিম। দুজনে একসঙ্গে ৭২ ইনিংসে ব্যাট করেছেন। ১৮ বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের ইতি টানা প্রিয় সতীর্থ ও বন্ধুর বিদায়বেলায় নিজের ভেরিফায়েড পেজে মুশফিক লিখেছেন, ‘তামিম, তোমার এই অবসরের সময়ে তোমার অর্জনের জন্য আমি কতটা গর্বিত, সেটি বলছি। দোস্ত, তুমি বাংলাদেশ ক্রিকেটের অসাধারণ এক দূত এবং বিশ্বমানের ব্যাটার। দুবাইয়ে আমাদের জুটিটি আমি সব সময় মনে রাখব, বিশেষ করে তুমি যখন ভাঙা আঙুল নিয়ে ব্যাট করেছিলে। এতে দেশের প্রতি তোমার নিবেদন ও খেলার প্রতি ভালোবাসাটা বোঝা যায়। অবসর শুভ হোক, দোস্ত। মাঠে তোমাকে মিস করব। তবে ক্রিকেটের মাধ্যমে অসাধারণ এক বন্ধু পাওয়ার জন্য আমি কৃতজ্ঞ। ’
জাতীয় দলে তামিমের আরেক সতীর্থ মাহমুদউল্লাহ লিখেছেন, ‘তামিম, দীর্ঘ এবং দুর্দান্ত আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে সুন্দর সব অর্জনের জন্য তোমাকে অনেক অভিনন্দন। তোমার অর্জন অনেক এবং বাংলাদেশ দলে অবদানও প্রচুর। আমার মনে হয়, বাংলাদেশ দলের হয়ে এটাই আমাদের শেষবার একসঙ্গে ব্যাট করার ছবি (পোস্টের ছবি)। তোমার সঙ্গে খেলাটা ছিল আনন্দের এবং মাঠ ও মাঠের বাইরে অনেক স্মৃতি আমাদের। অবসর সুখের হোক এই কামনা করি এবং ভবিষ্যতের জন্যও শুভকামনা রইল। তোমার অবদান সব সময় মনে রাখা হবে। ’
তামিমের দীর্ঘদিনের ওপেনিং সঙ্গী ছিলেন সৌম্য সরকার। ২০১৫ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত সব সংস্করণ মিলিয়ে ৮১ ইনিংস ওপেন করেছেন দুজনে। ফেসবুকে তামিমের অবসর নিয়ে সৌম্য লিখেছেন, ‘নতুন শুরুর জন্য শুভকামনা। অবসর মানে শেষ নয়, এটা সুন্দর এক নতুন অধ্যায়ের শুরুও। সামনের অভিযাত্রা উপভোগের। অবসর শুভ হোক, ভাই। মাঠে আপনাকে মিস করব। ’
জাতীয় দলের বাইরে থাকা ওপেনার মোহাম্মদ নাঈম তামিমের অবসর নিয়ে ফেসবুক পেজে লিখেছেন, ‘আপনার অবসরের মাধ্যমে বাংলাদেশের ক্রিকেটে একটি যুগের অবসান ঘটল। দেশের অন্যতম সেরা ওপেনার হিসেবে নিজের দক্ষতা, নিবেদন ও নেতৃত্বগুণ দিয়ে আপনি এই খেলায় অমোচনীয় ছাপ রেখে গেলেন। বড় সেঞ্চুরি কিংবা চাপের মুখে দারুণ সব পারফরম্যান্সের অবদান আপনাকে বাংলাদেশ ক্রিকেটের সত্যিকারের আইকন বানিয়েছে। ’
ফেসবুকে জাতীয় দলের অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্ত লিখেছেন, ‘প্রিয় তামিম ভাই, আপনার নেওয়া সিদ্ধান্তকে আমি আন্তরিকভাবে স্বাগত জানাই। ২০১৬ সালে আবাহনীর হয়ে প্রথমবার আপনার সঙ্গে ড্রেসিংরুম শেয়ার করা থেকে শুরু করে জাতীয় দলে একসঙ্গে খেলার সুযোগ, আপনার কাছ থেকে শিখেছি অসংখ্য কিছু। আপনার ক্রিকেটীয় মেধা, সহ-খেলোয়াড়দের প্রতি আপনার যত্নশীলতা ও উদারতা আমাকে বারবার মুগ্ধ করেছে। ’
শান্ত আরও লিখেছেন, ‘আপনার আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানানোর সিদ্ধান্ত অবশ্যই আপনাকে ভাবতে হয়েছে, এবং সেটিকে আমি শ্রদ্ধা জানাই। তবে ড্রেসিং রুমে এবং ২২ গজে আপনার সঙ্গ আমরা ভীষণভাবে মিস করব। আমি গর্বিত যে এমন এক কিংবদন্তি ব্যাটারের সঙ্গে ড্রেসিং রুম ভাগ করে নেওয়ার সুযোগ পেয়েছি এবং জাতীয় দলে আপনার সঙ্গে খেলতে পেরেছি। দোয়া করি, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে বিদায়ের সময়গুলো আনন্দময় হোক। ভালো থাকবেন, তামিম ভাই।
এর আগে গতকাল রাতে ফেসবুক স্ট্যাটাসে তামিম জানিয়ে দিয়েছেন, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আর ফিরছেন না তিনি। নিজের সিদ্ধান্ত জানিয়ে তামিম লিখেছেন, ‘অনেক দিন ধরেই এটা নিয়ে ভাবছিলাম। এখন যেহেতু সামনে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির মতো বড় একটি আসর সামনে, আমি চাই না আমাকে ঘিরে আবার আলোচনা হোক এবং দলের মনোযোগ ব্যাহত হোক। এটা অবশ্য আগেও চাইনি। চাইনি বলেই অনেক আগে নিজেকে বিসিবির কেন্দ্রীয় চুক্তি থেকে সরিয়ে নিয়েছি। ’
‘যদিও অনেকেই বলেছেন, অনেক সময় মিডিয়ায় এসেছে, আমিই নাকি ব্যাপারটি ঝুলিয়ে রেখেছি। কিন্তু বিসিবির কোনো ধরনের চুক্তিতে যে নেই, এক বছরের বেশি সময় আগে যে নিজ থেকে সরে দাঁড়িয়েছে, তাকে পরিকল্পনায় রাখা বা তাকে নিয়ে আলোচনারও তো কিছু নেই। তারপরও অযথা আলোচনা হয়েছে। অবসর নেওয়া বা খেলা চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত একজন ক্রিকেটার বা যে কোনো পেশাদার ক্রীড়াবিদের নিজের অধিকার। আমি নিজেকে সময় দিয়েছি। এখন মনে হয়েছে, সময়টা এসে গেছে। ’
ক্রিকেট ক্যারিয়ারের ইতি টানার কথাই তামিম জানিয়ে দিয়েছেন। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সবশেষ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে মাঠে নামেন তামিম। এর কিছুদিন আগেই আফগানিস্তান সিরিজের মাঝপথে অবসরের ঘোষণা দেন তামিম। পরে অনুরোধে ফিরেও আসেন।
২০২৩ সালের ডিসেম্বরে বিসিবির কেন্দ্রীয় চুক্তি থেকেও নিজের নাম সরিয়ে নেন। তবুও তাকে নিয়ে জল্পনা চলছিলই। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির আগে শুধু যে বোর্ড থেকে নয়, প্রস্তাব পেয়েছিলেন অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্তর কাছ থেকেও; সেটিও জানিয়েছেন তিনি।
তামিম লিখেছেন, ‘অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্ত আন্তরিকভাবেই আমাকে ফেরার জন্য বলেছে। নির্বাচক কমিটির সঙ্গেও আলোচনা হয়েছে। আমাকে এখনও উপযুক্ত মনে করার জন্য তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা। তবে আমি নিজের মনের কথা শুনেছি। ’
২০২৩ বিশ্বকাপের আগে নানা নাটকীয়তা তৈরি হয়। এরপর তাকে বিশ্বকাপের স্কোয়াডেও রাখা হয়নি। টুর্নামেন্টে খেলতে যাওয়ার আগে এক টেলিভিশনে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তাকে নিয়ে সমালোচনা করেন তখনকার অধিনায়ক সাকিব আল হাসান। ওসব ঘটনার অভিমান যে আছে, তাও স্পষ্ট করেছেন তামিম।
তিনি লিখেছেন, ‘২০২৩ বিশ্বকাপের আগে যা হয়েছে, আমার জন্য তা বড় ধাক্কা ছিল, যেহেতু ক্রিকেটীয় কারণে আমি দলের বাইরে যাইনি। তারপরও আমি যেখানেই গিয়েছি, ক্রিকেট ভক্তদের অনেকে বলেছেন, আমাকে আবার জাতীয় দলে দেখতে চান। তাদের ভালোবাসার কথা ভেবেছি আমি। ’
‘‘আমার ঘরেও একজন অনুরাগী আছে। আমার ছেলে কখনও আমাকে সরাসরি বলেনি, কিন্তু তার মাকে বারবার বলেছে, বাবাকে আবার দেশের জার্সিতে খেলতে দেখতে চায়। ভক্তদের হতাশ করার জন্য আমি দুঃখিত। ছেলেকে বলছি, ‘তুমি যেদিন বড় হবে, সেদিন বাবাকে বুঝতে পারবে। ’’
দেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা ব্যাটার হিসেবেই বিদায় নিলেন তামিম ইকবাল। ওয়ানডেতে বাংলাদেশের হয়ে সবচেয়ে বেশি রান (৮৩৫৭) তার। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশের হয়ে সবচেয়ে বেশি (২৫টি) সেঞ্চুরির মালিক তিনি। তার ঝুলিতে আছে ওয়ানডেতে বাংলাদেশের হয়ে সবচেয়ে বেশি সেঞ্চুরি (১৪)। তিনিই আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের একমাত্র সেঞ্চুরিয়ান। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশের হয়ে সবচেয়ে বেশি ৫০ ছাড়ানো ইনিংস (১১৯টি) আছে তার নামের পাশে। এছাড়া দেশের অসংখ্য জয়ে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি।
বাংলাদেশ সময়: ১৩০২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১১, ২০২৫
এমএইচএম