ছেলের এ সাফল্য মমতাময়ী মায়ের কাছে হয়ে এসেছে অনেকটাই আনন্দ-বেদনার কাব্যের মতো।
বাবার স্বপ্ন পূরণে অবিরাম ছুটে চলা মোসাদ্দেককে জীবনে লড়াই করতে শিখিয়েছেন মা।
এ কঠিনকে জয় করেই জীবনে এগিয়ে যেতে হয়। মায়ের মমতার ছায়ায় বেড়ে ওঠা মোসাদ্দেক সাদা পোশাকে অভিষেকেই রেকর্ড বুকে নাম লিখিয়েছেন।
ছেলের এ কীর্তিতে সকাল থেকে রাত অবধি তার বাসায় গণমাধ্যমকর্মীদের ভিড়, তাদের সঙ্গে অনুভূতি প্রকাশ, স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি করে নেওয়ার ঘটনা প্রবাহের মধ্য দিয়ে অন্যরকম সময় কাটছে হোসনে আরা বেগমের।
তবে খুশির এদিনে তার খুব বেশি মনে পড়ে যায় মোসাদ্দেকের প্রয়াত বাবা, জেলা ক্রীড়া সংস্থায় চাকরি করা আবুল কাশেমের কথা। মূলত তার অনুপ্রেরণাতেই ময়মনসিংহের ছেলে মোসাদ্দেক ক্রিকেটার হিসেবে এতোদূর এসেছেন।
প্রায় ৯ বছর আগে তিনি হারিয়ে গেছেন দূর আকাশে। অথচ তিনি বেঁচে থাকলে আজ ভীষণ খুশি হতেন বলছিলেন হোসনে আরা।
সোমবার (২০ মার্চ) বিকেলে নগরীর কাঁচিঝুলি গোলাপজান রোডের নিজ বাসায় বাংলানিউজের সঙ্গে আলাপকালে ছেলে মোসাদ্দেককে নিয়ে অনেক স্মৃতিই মনে পড়লো তার। অকপটে সেই গল্পই তিনি বলে গেলেন বাংলানিউজের কাছে।
শৈশব থেকেই ক্রিকেটের প্রতি প্রবল আগ্রহ ছিল মোসাদ্দেকের। ছেলের এ আগ্রহ দেখেই ওর বাবা ময়মনসিংহের একটি ক্লাবে ওকে ভর্তি করিয়ে দেন। তখন মোসাদ্দেক সপ্তম শ্রেণির ছাত্র।
নিয়মিত মাঠে গিয়ে ছেলের প্র্যাকটিস দেখতেন। আর ক্লাবের খেলা হলে নিজে উপস্থিত থেকে ছেলেকে বাড়ি নিয়ে আসতেন, স্মৃতি হাতড়ে বলছিলেন মা হোসনে আরা।
বলতে থাকেন, মোসাদ্দেকের বাবা স্বপ্ন দেখতেন ছেলে একদিন বড় ক্রিকেটার হবে। দেশ-বিদেশে সুনাম কুড়াবে। দেশের জন্য সাফল্য বয়ে আনবে। আমার সন্তান ওর বাবার স্বপ্ন পূরণ করেছে’ উচ্ছ্বাসের আতিশয্যে বলছিলেন এভাবেই।
ক্রিকেটার হয়ে ওঠার পেছনে সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা ছিলেন ওর বাবাই। কিন্তু হঠাৎ একদিন ওর মাথার ওপর থেকে সেই ছায়া সরে যায়। সংসারে শুরু হয় আর্থিক অনটন।
‘মোসাদ্দেকসহ সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে শহরতলী তালতলা এলাকার ২ কাঠা জমি বিক্রি করেছি। সেই টাকা দিয়েই ছেলেদের মানুষ করেছি। আজ আমার ছেলে পুরোদস্তুর ক্রিকেটার,’ দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন মা।
হোসনে আরা বেগমের যমজ দু’ছেলে মোসাব্বেক হোসেন সান ও মোসাব্বের হোসেন মুনও ক্রিকেটার। তারাও স্বপ্ন দেখেন বাবার প্রত্যাশা পূরণে।
বড় ভাই মোসাদ্দেক হোসেন সৈকতকে জীবনের ‘রোল মডেল’ মেনে বড় ক্রিকেটার হওয়ার। সান খেলছেন ঢাকায় চলমান প্রিমিয়ার লীগে কলাবাগানের হয়ে। আর মুন ময়মনসিংহ প্রিমিয়ার লীগে এসট্রো ফার্মার হয়ে।
মিডল অর্ডারে ব্যাটিং’র পাশাপাশি অফ স্পিন বোলার মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত। ২০১৪-১৫ মৌসুমে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট তার ঝুলিতে রয়েছে তিনটি দ্বিশতক এমন তথ্য জানান ছোট ভাই মোসাদ্দেক হোসেন মুন।
বলেন, অল্প বয়সেই ঘরোয়া ক্রিকেটে আমার ভাই রেকর্ড গড়েছেন। লঙ্কানদের বিপক্ষে অভিষেকেই হাফ সেঞ্চুরির বিস্ময়কর রেকর্ডের জন্ম দিয়েছেন। আমার ভাই একদিন দেশের সেরা ক্রিকেটার হবেন। ’
কলম্বোর পি সাবা ওভালে বাঘের থাবায় কুপোকাত হয়েছে লঙ্কানরা। আর এ ম্যাচে দ্যুতি ছড়িয়েছেন ময়মনসিংহের মোসাদ্দেক। সেই থেকে সন্তানের ফোনের অপেক্ষায় রয়েছেন মা হোসনে আরা।
বললেন, ‘আমি আরো খুশি হবো যেদিন আমার ছেলে হবে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের ভরসার প্রতীক। ’
ছেলে আউট হয়ে গেলে বুকের ভেতর চিলিক মারে উল্লেখ করে তিনি বলেন, মোসাদ্দেক ক্রিজে থাকলে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে ওর ব্যাটিং দেখি। ছেলে আউট হয়ে গেলে মনটা খারাপ হয়ে যায়। ’
হোসনে আরা বলছিলেন, আমার ছেলে আজ তারকা ক্রিকেটার। ছেলের সাফল্যের সুবাদেই সংবাদকর্মীরা আমার সাক্ষাতকার নিচ্ছেন। গর্বে আমার বুকটা ভরে যাচ্ছে। বাসা থেকেও বের হতে পারছি না। স্থানীয় লোকজন এসে শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন। ’
**‘আমি গর্বিত, আমি মোসাদ্দেকের মা’
বাংলাদেশ সময়: ১৮৩০ ঘণ্টা, মার্চ ২০, ২০১৭
এমএএএম/জেডএস