ঢাকা, সোমবার, ২৫ ফাল্গুন ১৪৩১, ১০ মার্চ ২০২৫, ০৯ রমজান ১৪৪৬

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

ছেলের দাম বেশি, মেয়ের কম

নিউজরুম এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৩০ ঘণ্টা, মার্চ ১০, ২০২৫
ছেলের দাম বেশি, মেয়ের কম ...

চট্টগ্রাম: নিঃসন্তান দম্পতির সন্তানের আকাঙ্ক্ষা পূরণে গড়ে ওঠা শিশু চোর চক্রের কাছে ছেলে শিশুর দাম লাখ টাকার বেশি। এর চেয়ে কিছুটা কম দামে বিক্রি হয় মেয়ে শিশু।

এই চক্রে হাসপাতাল-ক্লিনিকের আয়া, রোগী ভাগিয়ে নেওয়া দালাল, কতিপয় চিকিৎসক ও আইনজীবী, গৃহকর্মী, একাধিক সন্তানের জনক, সৎ মা-বাবা, মাদকসেবী, মানব পাচারকারীর সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। শিশু চুরির যেসব ঘটনা জানাজানি হয়, মামলা হয় বা গণমাধ্যমে আসে, তার চেয়েও বেশি খালি হয় মায়ের বুক।

২০১৮ থেকে ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ২২টি শিশু চুরির তথ্য পাওয়া যায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাধ্যমে। জানা গেছে এসব শিশু চুরির ঘটনায় জড়িতদের সম্পর্কে অবাক করা খবরও। শ্রমিক অধ্যুষিত নগরের বাকলিয়া ও ইপিজেড, হালিশহর, চকবাজার, লালখান বাজার, মোহরা-কালুরঘাট এলাকায় শিশু উদ্ধারের মাধ্যমে ধরা পড়ে ১০-১২টি চক্রের বেশ কয়েকজন সদস্য।

শিশু চুরি করতে গিয়ে আটক হওয়া ব্যক্তিদের স্বীকারোক্তি মতে, দলে মূল ভূমিকায় থাকে হাসপাতাল কেন্দ্রিক সদস্যরা। তারা টাকার ভাগ পায় বেশি। এরপর আছে হাত বদলকারী। চক্রের কেউ খোঁজে ক্রেতা, কারো দায়িত্ব দর-দাম করা। ক্রেতা পেলে কারও কাছ থেকে নেওয়া হয় অগ্রিম টাকা। শিশু চোরদের কাছে নবজাতক ছেলের সাংকেতিক নাম ‘জামাই’, মেয়ে শিশুর নাম ‘বউ’।

শিশু চোর চক্রের অধিকাংশই চট্টগ্রামের বাইরের বিভিন্ন জেলার বাসিন্দা। তাদের মধ্যে যারা গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে যায়, তাদের জামিনের জন্য এই চক্রই ঠিক করে রাখে আইনজীবী। এছাড়া শিশু কেনার পর দম্পতিরা কতিপয় আইনজীবীর মাধ্যমে অভিভাবকত্ব অর্জন ও ছেলেশিশু দত্তক নেওয়ার জন্য স্ট্যাম্প করে নেন।

স্বামী-স্ত্রী মিলে সন্তান বিক্রি

স্বামী-স্ত্রী মিলে সিদ্ধান্ত নেন অনাগত সন্তানকে বিক্রি করবেন। গর্ভাবস্থায় আলট্রাসনোগ্রাম করে জানতে পারেন- যমজ সন্তান আসছে। সন্তানদের বিক্রি করার জন্য লোকও পেয়ে যান। পাঁচলাইশের পলি হাসপাতালে সন্তান জন্মদানের পরপরই ছেলে শিশুকে ৩ লাখ আর কন্যা শিশুকে ১ লাখ টাকায় বিক্রি করে দেন এক দম্পতি।

হাসপাতালে ঝামেলা ছাড়াই সন্তানদের বিক্রি করলেও বিপত্তি বাধে টাকা ভাগাভাগি নিয়ে। পরে সন্তানদের চুরির অভিযোগ এনে চট্টগ্রামের মানবপাচার অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালে মামলা করেন স্ত্রী। মামলায় তিনি অভিযোগ করেন, ‘২০২৪ সালের ৩ জানুয়ারি পলি হাসপাতালে তার যমজ সন্তান (১ ছেলে ও ১ মেয়ে) হয়। ডাক্তার ও তার স্বামী মিলে সন্তানদের অজ্ঞাতনামা মহিলাদের হাতে তুলে দেয়। তার বড় মেয়ে ও ছেলে প্রতিবাদ করলে তাদের বাথরুমে আটকে রাখা হয়। পরে এসব বিষয়ে হাসপাতালের ডাক্তারকে জানালে নবজাতক দুটি অসুস্থ থাকায় অন্য হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে জানানো হয়’।  

মামলা তদন্তের দায়িত্ব পেয়ে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) চট্টগ্রাম মেট্রো ইউনিট গত বছরের ৮ জুন রাঙ্গুনিয়ার রাজানগর ও নগরের অক্সিজেন এলাকায় অভিযান চালিয়ে বিক্রি করা ওই দুই শিশুকে উদ্ধার করে।  

মামলার তৎকালীন তদন্ত কর্মকর্তা এসআই মো. শাহেদুল্লাহ বলেন, স্বামী-স্ত্রী মিলে স্ট্যাম্প করে যমজ সন্তানদের বিক্রি করেন। কিছুদিন পর বিক্রির টাকা থেকে ৫ হাজার টাকা দাবি করে স্বামী। কিন্তু টাকা না দিলে বাসায় গিয়ে মারধর করে স্ত্রীর কাছ থেকে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা ছিনিয়ে নিয়ে যায় স্বামী। এ ঘটনায় স্ত্রী ক্ষিপ্ত হয়ে মামলা করেন। তিনি বাবুর্চির সহকারী ও বিভিন্ন বাসা-বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ করেন।  

‘যমজ সন্তানকে বিক্রির সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সীতাকুণ্ডের রাশেদা বেগমের সঙ্গে স্বামী-স্ত্রীর পরিচয় হয়। রাশেদা বেগম তাদের আশ্বস্ত করেন, নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা দিলে পছন্দমত নবজাতক ছেলে-মেয়ে বিক্রি করে দিতে পারবেন। পরে রাশেদা বেগম সন্তান নেওয়ার জন্য দুই নারীর সঙ্গে তাদের পরিচয় করিয়ে দেন। নবজাতক ছেলের বিনিময়ে শিরু আকতার ৩ লাখ টাকা এবং রুনা আকতার নবজাতক মেয়ের বিনিময়ে ১ লাখ টাকা রাশেদা বেগমকে দিতে রাজি হন। এছাড়াও প্রসবকালীন চিকিৎসা বাবদ টাকা দিতেও রাজি হন তারা। রাশেদা বেগম মধ্যস্থতাকারী হিসেবে পেয়েছেন ১ লাখ টাকা’।

সিএনজি অটোরিকশা চালিয়ে সংসার চালান রাঙ্গুনিয়ার মরিয়মনগর ইউনিয়নের বাসিন্দা মো. সাদ্দাম। সংসারে আছে স্ত্রী ও দুই কন্যা। পুত্র সন্তানের আশায় তৃতীয়বারও জন্ম নেয় কন্যা সন্তান। পরপর তিন কন্যার জন্ম হওয়ায় সদ্যোজাত কন্যা সন্তানকে বিক্রি করে দেন সাদ্দাম।

এ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় পারভেজ হোসাইন বলেন, চন্দ্রঘোনা জেনারেল হাসপাতালে বন্ধুর মাকে রক্ত দিতে যাই। পাশে সুমি নামের এক নারী কান্না করছিল। কারণ জিজ্ঞেস করতেই তিনি জানালেন, তার স্বামী বাচ্চা বিক্রি করে দিয়েছে। বাচ্চার বাবার (সাদ্দাম) সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি, হাসপাতালের বিলের টাকা দিতে না পারায় এ কাজ করেছেন।  

২০২৪ সালের ২৭ জুন রাতে অন্তঃসত্ত্বা সুমি ভর্তি হন চন্দ্রঘোনা জেনারেল হাসপাতালে। ২৯ জুন দুপুরে সিজারের মাধ্যমে কন্যাসন্তান জন্ম দেন। চিকিৎসা শেষে ২ জুলাই বাড়ি যাওয়ার ছাড়পত্র দেয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।  

মো. সাদ্দাম জানান, হাসপাতালের বিল আসে ১২ হাজার। ওষুধ খরচ ও ডাক্তারের বিল বাবদ আরও ১০ হাজার টাকা লেগেছে। তার আরও দুটি কন্যা রয়েছে। তৃতীয়টাও কন্যা হওয়ায় নিঃসন্তান আত্মীয়কে দিয়ে দিয়েছেন।  

গত বছরের ২২ জুন বান্দরবানের রুমা সদর ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা চাইসিংনু মারমা মদ পানের টাকা জোগাড় করতে আড়াই বছরের সন্তানকে ৩ হাজার টাকায় বিক্রি করে দেন।

ফেনীর পরশুরাম উপজেলার মনিপুর গ্রামের বাসিন্দা নাসিমা আক্তার। ২০২৩ সালের ১৯ ডিসেম্বর যমজ ছেলে-মেয়ে জন্ম দিয়েছিলেন নাসিমা। জন্মের পরই ছেলে মারা যায়। নবজাতক মেয়ে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছিল। অসুস্থ সেই শিশুকে হাসপাতালের নবজাতক ওয়ার্ডে ফেলে রেখে আরেক প্রসূতি আসমা উল হুসনার নবজাতক নিয়ে পালিয়ে যান নাসিমা। হাসপাতালের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে তাকে শনাক্ত করা হয়। পুলিশ অভিযান চালিয়ে ৫ দিন বয়সী ওই নবজাতককে উদ্ধারের পাশাপাশি নাসিমা ও তার মাকে গ্রেপ্তার করে।

হাসপাতালকেন্দ্রিক ভয়ঙ্কর চক্র

হাসপাতাল-ক্লিনিকে নবজাতক চোর চক্রের সদস্যরা প্রসূতিদের প্রতি নজর রাখে সার্বক্ষণিক। যেসব প্রসূতি খুব গরীব কিংবা দেখাশোনার লোক নেই, তারা লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয় সহজেই। এই চক্রের নারী সদস্যরা আয়া, চিকিৎসকের সহকারী সেজে সহানুভূতি লাভের জন্য প্রসূতির পাশে থাকে। কখন সিজারিয়ান বা স্বাভাবিক প্রসব হবে-সে সময় অনুযায়ী তারা প্রস্তুতি নেয়। এই চক্রের আরেক দল প্রসূতিকে বাথরুমে পাঠিয়ে, সন্তানকে দুধ খাওয়ানোর কথা বলে বা ঘুমের সময়কালে নবজাতককে হাসপাতালের বাইরে পাঠিয়ে দেয়। এরপর আরেক দল ক্রেতার হাতে পৌঁছে দেয়।

অনেক সময় চক্রের সদস্যরা প্রসূতির মৃত সন্তান হয়েছে বলে প্রচার চালায়। এদের কথা বিশ্বাস করে অনেকে হাসপাতাল-ক্লিনিক ছাড়েন। অথচ তারা ঘুণাক্ষরেও টের পান না, তাদের সন্তানকে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে।

২০১৮ সালের ১৭ এপ্রিল। জীবিত কন্যা শিশুর বদলে মৃত ছেলে শিশু গছিয়ে দেওয়া হয়েছিল নগরের গোলপাহাড় এলাকার বেসরকারি চাইল্ড কেয়ার হাসপাতালে।

নোয়াখালীর মাইজদি এলাকার রোকসানা আক্তার ফেনীর এক ক্লিনিকে কন্যা সন্তান জন্ম দেন ওই বছরের ১৪ এপ্রিল। জন্মের পর নিউমোনিয়া আক্রান্ত শিশুর উন্নত চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রামের চাইল্ড কেয়ারে ভর্তি করা হয়। ১৭ এপ্রিল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ শিশুটিকে মৃত ঘোষণা করে মরদেহ প্যাকেট করে মায়ের কাছে বুঝিয়ে দেয়। বাড়িতে নিয়ে গিয়ে জানাযার পূর্বে প্যাকেট খোলা হলে দেখা যায়, সেটি ছেলে শিশু।

ঘটনার শিকার রোকসানা আক্তার বলেন, ‘ডাক্তারদের কথা মেনে নিয়ে আমরা প্যাকেট করা মরদেহ নিয়ে বাড়ি চলে যাই। গোসল করানোর সময় ছেলে শিশু দেখে আবার রাতেই ওই হাসপাতালে গিয়েছিলাম। আমার কন্যাকে ফেরত দিতে ডাক্তার আর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে আকুতি করি। কিন্তু তারা শুনেনি। এরপর পাঁচলাইশ থানায় ডায়েরি করি। ১৮ এপ্রিল পুলিশের চাপে বুকের ধন ফেরত পেয়েছি। ওদের আইসিইউতে সিসিটিভি ক্যামেরা ছিল না। ওরা আমার সন্তানকে মোটা অঙ্কের টাকায় বিক্রি করে দিতে চেয়েছিল। যখন মরদেহ প্যাকেট করে দেওয়া হয় তখন তারা বলেছিল-মা যেন বাবুর চেহারা না দেখে। মুখে রক্ত লেগে আছে। দেখলে হার্ট অ্যাটাক করতে পারে। যদি অন্য কোনো কন্যার মরদেহ দেওয়া হতো, আমি বুঝতেই পারতাম না’।

পাচঁলাইশ থানার তৎকালীন ওসি জানান, অভিযোগ পাওয়ার পর পুলিশ তদন্তে নামে। প্রথমে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বিষয়টি অস্বীকার করে। পরে আদালতের অনুমতি নিয়ে মৃত শিশুর ডিএনএ টেস্ট করানোরও উদ্যোগ নেন। শেষ পর্যন্ত হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রোকসানা আক্তারকে তার জীবিত কন্যা সন্তানটি ফেরত দেয়।

ওই সময় চাইল্ড কেয়ার হাসপাতালের পরিচালক ডা. ফাহিম হাসান রেজা বলেছিলেন, রেজিস্ট্রার ও ডেথ সার্টিফিকেটে ছেলে লেখা ছিল। প্রতিটি শিশুর শরীরে ট্যাগ লাগানো থাকে। এটা অনিচ্ছাকৃত ভুল।

এ সময়েই গায়ে অ্যাপ্রন জড়িয়ে ডাক্তার সেজে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে শিশু চুরি করতে এসেছিল মীরসরাইয়ের নিজামপুর কলেজ এলাকার মো. জাফরের ছেলে রাজু ও বরিশালের বাকেরগঞ্জের শাহরিয়ার মাহমুদের স্ত্রী ফারজানা আক্তার মনি।  

হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির সদস্যরা জানান, চিকিৎসকের অ্যাপ্রন পরে ২০১৮ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি হাসপাতালের গাইনি ও শিশু ওয়ার্ডে ঢুকে পড়েছিল তারা। সেখানে ফারজানা নিজেকে গাইনি বিশেষজ্ঞ হিসেবে পরিচয় দেয়। তাদেরকে ডাক্তারের মতো মনে হলেও কথাবার্তা ও গতিবিধি সন্দেহজনক হওয়ায় দায়িত্বরতরা চ্যালেঞ্জ করেন। পরে ভুয়া পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর তাদের আটক করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে শিশু চুরির লক্ষ্যে তারা হাসপাতালে ঢুকে বলে স্বীকার করে। এর আগে তারা কয়েকবার শিশু চুরির মিশন সফল করেছিল। শেরশাহ বাংলা বাজার এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে তারা চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালসহ নগরের কয়েকটি হাসপাতাল থেকে শিশু চুরির সঙ্গে জড়িত বলে জানায়।  

চুরি করা শিশু পাচার

বায়েজিদ বোস্তামি থানাধীন রউফাবাদ রাজা মিয়া কলোনি থেকে চুরি করা দেড় বছর বয়সী শিশু আরজুকে পাচারের সময় ভারত সীমান্তবর্তী হবিগঞ্জ জেলা থেকে উদ্ধার করে পুলিশ। এ কাজে জড়িত তিনজন কুলসুম বেগম কুসুম ও তার কথিত স্বামী মো. সোহেল, সোহেলের মা খোরশেদা বেগমকে ২০২২ সালের ১৫ এপ্রিল রাতে হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলার খবরা এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে বায়েজিদ বোস্তামি থানা পুলিশ।

হাটহাজারী পৌরসভা এলাকায় ৬ বছরের এক শিশুকে অপহরণের পর পাচারের চেষ্টাকালে ২০২৪ সালের ১২ জুলাই নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলার সাইফুল ইসলাম, রামগতি উপজেলার জান্নাতুল ফেরদৌস, রাউজান পৌরসভা এলাকার জাহাঙ্গীর আলম ও বায়েজিদ এলাকার হীরা আকতার টুনিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এক কিশোরীকে মা সাজিয়ে লেগুনায় করে শিশুটিকে পাচার করার সময় যাত্রীদের সন্দেহের কারণে ধরা পড়ে তারা।  

২০১৯ সালের ৩০ আগস্ট আবিদা সুলতানা নামের এক বছর বয়সী শিশুকে চুরি করে নিয়ে যায় বাবা মনির হোসেন ও সৎ মা রোজিনা বেগম। ঢাকার যাত্রাবাড়ি এলাকা থেকে পতেঙ্গা থানা পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করে। ১৬ সেপ্টেম্বর নগরের কাজির দেউড়ি সার্কিট হাউজের পাশে ফুটপাতে পড়ে থাকা বাজারের ব্যাগ থেকে একমাস বয়সী এক শিশু কন্যাকে উদ্ধার করে পুলিশ। শিশুটি চট্টগ্রাম গ্রামার স্কুলের (সিজিএস) শিক্ষক মানিক চক্রবর্তীর। মেহেদীবাগের বাসা থেকে শিশুটি চুরি হয়। এ ঘটনায় জড়িতদের শনাক্ত করতে পারেনি পুলিশ।

২০২৩ সালের ২৫ এপ্রিল চান্দগাঁও মধ্যম মোহরা এলাকা থেকে আড়াই বছর বয়সী শিশু চুরির ঘটনায় নুর ইসলাম মুরাদ, মো. জুয়েল, মো. রাসেল ও রীমা আক্তারকে হাটহাজারী ও বায়েজিদ বোস্তামি এলাকা গ্রেপ্তার করে চান্দগাঁও থানা পুলিশ। হাটহাজারীর ছিপাতলী এলাকায় নিঃসন্তান রীমা আক্তারের হেফাজত থেকে শিশুটিকে উদ্ধার করা হয়। পুলিশ জানিয়েছে, শিশুটিকে চুরি করে নিয়ে দুই লাখ ২০ হাজার টাকায় নিঃসন্তান ওই নারীর কাছে বিক্রি করেছিল তারা।

২০২৩ সালের ১৯ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের নবজাতক ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন পাঁচদিন বয়সী এক নবজাতক চুরি হয়। লোহাগাড়ার আধুনগর এলাকার বাসিন্দা নবজাতকের বাবা মো. নোমান ও মা আসমা বলেন, নগরের একটা বেসরকারি হাসপাতালে সন্তানের জন্মের পর শ্বাসকষ্ট থাকায় চমেক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। দালাল চক্র তাদের সন্তানকে চুরি করে নিয়ে যায়, যা সিসিটিভির ফুটেজ দেখে জানা গেছে। এই দম্পতি সন্তানকে আর ফিরে পাননি।

নগরের ইপিজেড এলাকা থেকে ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে চুরি হওয়া তিন বছর বয়সী এক শিশুকে ফেনী থেকে উদ্ধার করার পর পুলিশ জানিয়েছে, ১৫ দিনের মধ্যে শিশুটি চারবার হাতবদল হয়েছে এবং তিনবার বেচাকেনা হয়েছে। প্রতিবার হাত বদলে দাম বেড়েছে শিশুটির। এ ঘটনায় শিশু পাচারকারী সুমি, লাকী আক্তার, মো. আকিব, বেলাল হোসেন, হাবিবুর রহমান মজুমদার ও রোজিনা আক্তারকে গ্রেপ্তার করে ইপিজেড থানা পুলিশ।  

সিএমপির তৎকালীন উপ-কমিশনার (বন্দর) শাকিলা সোলতানা বলেন, গ্রেপ্তার ছয়জন সংঘবদ্ধ চক্রের সদস্য। তারা মূলত নিম্ন আয়ের লোকজনের সন্তানদের টার্গেট করে তাদের বাচ্চা চুরি করে এবং নিঃসন্তান দম্পতিদের কাছে বিক্রি করে। যেসব শিশু ছোট এবং কথা বলতে পারে না, তাদের টার্গেট করে, যাতে সহজেই চুরি করে বিক্রি করে দেওয়া যায়। চুরি হওয়া অনেক শিশু রাস্তাঘাট বা দোকানের পাশে খেলাধুলা করে। অপহরণকারীরা তখন চিপস-চকলেটের লোভ দেখিয়ে বাচ্চা চুরি করে। অপহৃত অনেক শিশুকে ফেনী, নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুর সহ সীমান্তবর্তী জেলায় নিয়ে পাচারের চেষ্টাও হয়।  

বাংলাদেশ বর্ডার গার্ডের (বিজিবি) হিসাব অনুযায়ী, গত আগস্ট থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত অবৈধভাবে পাচারের সময় পাচারকারীসহ ১৪৫ জন আটক হয়। এর মধ্যে নারী ও শিশু ৫৫ জন। জাস্টিস অ্যান্ড কেয়ারের হিসাব মতে, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১৪ মাসে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত দিয়ে ১৮৬ জন নারী ও শিশুকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। সীমান্ত থেকে উদ্ধার করা হয়েছে ১৩৩ জনকে। এর মধ্যে গত আগস্ট থেকে ফেব্রুয়ারি সময়ে ভারত থেকে ফেরত আনা হয়েছে ৮৭ জনকে। পাচারের সময় উদ্ধার করা হয়েছে ৮৮ জনকে। মানব পাচার বিষয়ে জাতিসংঘের বৈশ্বিক প্রতিবেদন বলছে, ২০২৩ সালের এপ্রিল থেকে ২০২৪ সালের মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে ৪৫২ জন (২২৮ জন বিদেশে পাচার) নারী ও ৬৩টি মেয়ে শিশু পাচারের শিকার হয়েছে।  

চলতি বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি ছেলের আশায় শিশু চোর চক্রে জড়িয়ে ধরা পড়েন ৫ মেয়ের বাবা। নগর থেকে চুরি হওয়া ১৫ মাস বয়সী ছেলে শিশুকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এক দম্পতির হেফাজত থেকে উদ্ধার করে র‌্যাব এ তথ্য জানায়। যাদের কাছ থেকে শিশুটিকে উদ্ধার করা হয়, তাদের নিজেদের পাঁচটি মেয়ে আছে। শুধুমাত্র একটি ছেলের আশায় তারা চোরের কাছ থেকে ১ লাখ টাকায় শিশুটিকে কিনে নেয়।

এ ঘটনায় গ্রেপ্তার দুলাল মিয়া ও মোরশেদ মিয়ার বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সরাইল উপজেলায়। দুলাল শিশুটিকে চুরি করে ১ লাখ টাকায় মোরশেদের কাছে বিক্রি করেছিল। দুলাল ও তার স্ত্রী রুনা বেগম পেশাদার শিশু চোর। তারা চট্টগ্রাম, কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে শিশু চুরি করে বিক্রি করে। কিশোরগঞ্জের ভৈরব থানার এ সংক্রান্ত একটি মামলায় রুনা বর্তমানে কারাগারে আছে। চুরির শিকার ১৫ মাস বয়সী শিশু রাব্বির মা-বাবা চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার বাসিন্দা।

র‌্যাব-৭ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মাহবুব আলম বলেন, হাসপাতাল ও রেলওয়ে স্টেশন এলাকায় ঘুরাঘুরি করে দুলাল। শিশুর স্বজনদের নানাভাবে ভুলিয়ে আটকে রাখে। এরপর শিশুর ছবি পাঠায় প্রত্যাশিত ক্রেতার কাছে। তাদের পছন্দ হলে শিশু চুরি করে তাদের কাছে বিক্রি করে দেয়। এভাবে ক্রেতার পছন্দমতো শিশু চুরি করে বিক্রি করতো দুলাল মিয়া।  

শিশুর খোঁজে আদালতে

পরিচয়হীন উদ্ধার হওয়া শিশু প্রশাসনের হাত ধরে আসে সেফ হোমে। অনেক নিঃসন্তান দম্পতি এরকম শিশুর দায়িত্ব নিতে আসেন আদালতে। আইনি প্রক্রিয়া পরিচালনায় আইনজীবী, আদালত ফি, প্রতি শুনানিতে হাজির হওয়া এবং আরও অনেক বিষয় জড়িত থাকে। আদালত শিশুর সর্বোচ্চ স্বার্থ ও কল্যাণের কথা বিবেচনা করে শিশুর অভিভাবকত্ব নির্ধারণ করে দেন।

আদালত সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন সময় শিশু চোর চক্রের সদস্যরা গ্রেপ্তার হয়ে আদালতে আসার পর বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি পাচ্ছে। আবার অনেকে ভুক্তভোগীর সাথে দফারফা করে নিচ্ছে। তথ্য-প্রমাণের অভাবেও অনেকে ছাড় পেয়ে যাচ্ছে। দীর্ঘ সময় পর বিচারের রায় হওয়ার নজিরও আছে।

প্রায় ১৪ বছর আগে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক) হাসপাতাল থেকে দুই শিশু চুরির মামলায় হাসপাতালের আয়া দীপালি দাসকে ২০২২ সালের ৩১ মার্চ যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭ এর বিচারক বেগম ফেরদৌস আরা।  

২০০৭ সালের ৩ জুলাই নগরের বাকলিয়া ডিসি রোড এলাকায় রাত সাড়ে ১১টার দিকে তিন মাস বয়সী এক ছেলে ও দেড় মাস বয়সী এক কন্যাশিশুকে বিক্রির জন্য নিয়ে আসে দীপালি। এরপর ধরা পড়ে বাকলিয়া থানা পুলিশের হাতে।

২০১৯ সালের ২৭ মে কাজীর দেউরি এলাকা থেকে শেফালী বেগম নামে এক নারীর দুইমাস বয়সী শিশু চুরি হয়। এক যুবক ওই শিশুকে নতুন পোশাক কিনে দেওয়ার কথা বলে রিয়াজ উদ্দিন বাজারে নিয়ে পরে সেখান থেকে বিক্রি করে দেয়। বাচ্চাটি চুরি করে ইকবাল ও আফসার। এরপর শিশুটিকে পারভীন আক্তারের হেফাজতে রাখা হয়। পরে সুজিতের মধ্যস্থতায় শিশুটিকে নিঃসন্তান পবনের কাছে ১ লাখ ৩০ হাজার টাকায় বিক্রি করে দেয় আফসার। বাচ্চাটি নেওয়ার সময় আফসারের সঙ্গে ১০০ টাকার স্ট্যাম্পে পবনের চুক্তি হয়।  

এসময় নগরের বিভিন্ন হাসপাতালের আয়া-নার্স, হাসপাতালের আশপাশে থাকা দালাল এবং বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টারের কর্মচারী মিলে একটি সিন্ডিকেটের সন্ধান মিলে। চক্রের সদস্যরা সড়কে-ফুটপাতে থাকা হতদরিদ্র ভাসমান নারীদের শিশু সন্তান চুরি করে নিঃসন্তান দম্পতির কাছে বিক্রি করতো বলে জানায় পুলিশ।

চট্টগ্রাম ইপিজেড এলাকার মমতা মাতৃসদন-২ হাসপাতালে ২০২২ সালের ২৬ আগস্ট সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে এক শিশুর জন্ম হয়। ২৯ আগস্ট নার্স সেজে ওয়ার্ডে যান এক নারী। ইনজেকশন দেওয়ার কথা বলে শিশুটিকে নিয়ে হাসপাতালের নিচে নেমে পালিয়ে যান তিনি। এ ঘটনায় জড়িত হাসপাতালের সুপারভাইজার মোরশেদ আলম, সিকিউরিটি গার্ড সেলিম ও আবুল কাশেম এবং দালাল আনোয়ারার পূর্ব বারখাইনের রিমন মল্লিক ও চুরিতে অভিযুক্ত নারী শিমুকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পাশাপাশি ৩০ আগস্ট আনোয়ারার বারখাইন এলাকা থেকে নবজাতককে উদ্ধার করা হয়।

পুলিশ জানায়, গর্ভধারণের পাঁচ মাসের মাথায় গ্রেপ্তার শিমুর গর্ভপাত হয়। এরপর থেকে তিনি শিশু দত্তক নেওয়ার জন্য বিভিন্ন হাসপাতালে ঘুরতেন। সেদিন হাসপাতালটির কর্মচারীদের সহায়তায় নবজাতক চুরি করে আনোয়ারায় নিয়ে যান তিনি।

২০২৪ সালের ৫ এপ্রিল রাতে নগরের বন্দর থানাধীন নিমতলা এলাকা থেকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে ভোলা সদর থানার চর চটকিমারা এলাকার আবুল কাশেমের ছেলে মো. হেলাল (৩৬) নামের এক যুবক ও তার সহযোগী মো. ইব্রাহিমকে। মাইলের মাথা এলাকায় একটি কলোনিতে বন্ধুর ২ বছর বয়সী মেয়েকে চুরি করেছিল তারা।

এ ঘটনার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই কিশোর মজুমদার জানান, হেলাল ও ইব্রাহিম মিলে শিশুটিকে চুরি করে বিক্রির পরিকল্পনা করেছিল। শিশুটি মায়ের বুকের দুধ ছাড়া আর কিছু না খাওয়ায় তাকে হেফাজতে রাখা নিয়ে বিপাকে পড়তে হয়। শেষে বিক্রির পরিকল্পনা বাদ দিয়ে শিশুর মায়ের কাছ থেকে এক লাখ টাকা মুক্তিপণ আদায়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।

যুদ্ধশিশুদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে ১৯৭২ সালে বিশেষ আইন প্রণয়ন করা হয়। সেই আইনে এতিম ও পরিত্যক্ত শিশুদের দত্তক নেওয়া যেত। পরে শিশু পাচার বা ধর্মান্তরিত হওয়ার ঘটনায় ১৯৮২ সালে সরকার আইনটি বাতিল করে।  

চট্টগ্রাম জজ কোর্টের আইনজীবী সুজন কান্তি দে বলেন, ১৯৮৫ সালের পারিবারিক আইনে একজন অভিভাবক আইনি প্রক্রিয়ায় একটি শিশুর দায়িত্ব নিতে পারেন। মুসলিম আইনে সন্তান দত্তক নেওয়া যায় না, নেওয়া যায় অভিভাবকত্ব। তবে হিন্দু আইনে পুত্রসন্তানের ক্ষেত্রে দত্তক নেওয়া যায়। হিন্দু পুরুষ বিবাহিত, অবিবাহিত বা বিপত্নীক, দত্তক নিতে পারবেন। আবার একজন অবিবাহিত নারী সন্তান দত্তক নিতে পারেন না। বিবাহিত নারীর ক্ষেত্রে স্বামীর অনুমতি দরকার হয়।  

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. সাখাওয়াত হোসেন বলেন, অনেক সময় অভাব ও সন্তান লালন-পালনের মতো আর্থিক দুরবস্থার কারণে মা-বাবাও নবজাতককে অন্যের হাতে তুলে দেন। এছাড়া যাদের পারিবারিকভাবে বিয়ে হয় না, যারা অবৈধ সম্পর্কে জড়িত হয়ে গর্ভপাত ঘটায় কিংবা বহুবিবাহ করে, যারা সন্তানহীন, কর্মহীন বা নেশাগ্রস্ত-তারাই শিশু বেচাকেনায় সম্পৃক্ত হয়।  

তিনি বলেন, সরকারি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে প্রসূতি ওয়ার্ডে যে ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকা দরকার, তা নেই। অদক্ষ নার্স-আয়া সহ দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে কর্মরত লোকজন বাড়তি আয়ের লোভে এ কাজে জড়ায়। তাই সেখানে নজরদারি বাড়ানো দরকার। এক্ষেত্রে সিসি ক্যামেরার সংখ্যা বৃদ্ধি, ওয়ার্ড ইনচার্জ ও অন্য স্টাফদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। সর্বোপরি প্রসূতি ও তার সঙ্গে থাকা অভিভাবকের সাবধানতার বিকল্প নেই।

বাংলাদেশ সময়: ১৪১৪ ঘণ্টা, মার্চ ১০, ২০২৫ 
এসি/টিসি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।