চট্টগ্রাম: সবেমাত্র মেডিক্যাল কলেজে পড়ার সুযোগ হয়েছিল সারজিনা আক্তারের। চমেক ৩৬তম ব্যাচের সেই ছাত্রীর ব্রেইন স্ট্রোকে মৃত্যু হয় ২০২৫ সালের ২৮ মে।
এমন সব মেডিকেলিয়ানদের স্মৃতি নিয়ে ২০২৫ সালের আগস্ট মাসে যাত্রা শুরু করেছে ‘সিএমসি বোন্স ব্যাংক’। এই উদ্যোগ সেসব শিক্ষার্থীদের জন্য, যাদের সামর্থ্য নেই অধিক মূল্যের মানব কঙ্কাল কেনার।
বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী মানব কঙ্কাল কেনা-বেচা অবৈধ। অথচ মেডিক্যাল কলেজে ১ম ও ২য় বর্ষে অ্যানাটমি বিষয়ে পড়াশোনায় কঙ্কাল ব্যবহার বাধ্যতামূলক। এই চাহিদা পূরণ করে কঙ্কাল চোর চক্র। চক্রের সদস্যরা কবর থেকে লাশ তুলে রাসায়নিক দিয়ে কঙ্কাল তৈরি করে। পরে কয়েক হাত ঘুরে আসে শিক্ষার্থীদের হাতে।
চট্টগ্রামে সরকারি-বেসরকারি ৯টি মেডিক্যাল কলেজে প্রতিবছর ভর্তি হন ৯ শতাধিক শিক্ষার্থী। তারা কঙ্কাল সংগ্রহ করেন সিনিয়র শিক্ষার্থী, মেডিক্যাল কলেজের ৩য়-৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারী থেকে। নগরের আন্দরকিল্লায় বই বিক্রির প্রতিষ্ঠান প্রিমিয়াম মেডিক্যাল বুক সেন্টার ও জেনুইন লাইব্রেরিতে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তারা সরাসরি মানব কঙ্কাল বিক্রি করেন না। তবে চাহিদা থাকলে ব্যবস্থা করে দেওয়া যায়। সেই সূত্র ধরে পাওয়া যায় এক বিক্রেতার সন্ধান। তিনি বাংলানিউজকে জানান, দুই ধরনের কঙ্কাল বিক্রি করা হয় শিক্ষার্থীদের কাছে। ২০৬টি অস্থির পুরো সেট সাদা কঙ্কাল ২৯ হাজার এবং লাল কঙ্কাল ৩০ হাজার টাকায় পাওয়া যায়। লাল-পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তির কঙ্কাল হওয়ায় সেটির চাহিদা বেশি।
ইউএসটিসি’র আইএএইচএস, বিজিসি ট্রাস্ট মেডিক্যাল কলেজ, চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল মেডিক্যাল কলেজ, সাউদার্ন মেডিক্যাল কলেজ, মেরিন সিটি মেডিক্যাল কলেজ ও চট্টগ্রাম ইন্টারন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজে চলতি শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হওয়া বেশ ক’জন এমবিবিএস শিক্ষার্থীর কাছে জানতে চাওয়া হয় মানব কঙ্কাল সংগ্রহের উৎস সম্পর্কে। তারা প্রায় অভিন্ন সুরে বলেছেন, সিনিয়রদের কাছ থেকে এবং ক্যাম্পাসের দেয়ালে সাঁটানো বিজ্ঞাপন দেখে অ্যানাটমি বিভাগের কর্মচারীদের কাছ থেকে কঙ্কাল কিনেছেন। পুরনো কঙ্কাল ১০-১৫ হাজার, নতুন কঙ্কাল ২০-২২ হাজারের মধ্যে কেনা যায়।
সাউদার্ন মেডিক্যাল কলেজের অ্যানাটমি বিভাগের সাবেক এক শিক্ষক জানান, কঙ্কাল বেচাকেনায় সরকারি কোনও বিধি-নিষেধ না থাকায় শিক্ষার্থীরা যে যেভাবে পারে কঙ্কাল সংগ্রহ করে। নিয়মানুযায়ী মৃত্যুর আগে কেউ দেহ দান করলে মর্গে প্রসেসিংয়ের মাধ্যমে কঙ্কাল বের করা হয়। এছাড়া হাসপাতালে আসা বেওয়ারিশ মরদেহের কোনও ওয়ারিশ দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে পাওয়া না গেলে ছবি তুলে রেখে তা ব্যবহারের জন্য হস্তান্তর করা হয়।
চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে (চমেক) প্রতি বছর ২৫০টি আসনে এমবিবিএস কোর্সে ভর্তি হন শিক্ষার্থীরা। ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হয়েছে ৬৭তম ব্যাচ। ডেন্টাল ইউনিটে আসন ৬০টি। চলতি শিক্ষাবর্ষে চলছে ৩৬তম ব্যাচ। ভর্তি ফি ৫০ টাকা, বার্ষিক বেতন ৩০০ টাকা, বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান ফি ৮০০ টাকা এবং অ্যাকাডেমিক ফি ১০ হাজার ২৫০ টাকা সহ মোট ১১ হাজার ৪০০ টাকা পরিশোধ করতে হয় প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে। এর বাইরে আছে হোস্টেল ফি। এ টাকার জোগান দেওয়া সম্ভব হলেও অনেক দরিদ্র শিক্ষার্থীর পক্ষে মানব কঙ্কাল কেনা কষ্টসাধ্য।
তাদের দুর্দশা লাঘবে চমেক ৬৫তম ব্যাচের একদল শিক্ষার্থীর নেতৃত্বে যাত্রা শুরু করে ‘সিএমসি বোন্স ব্যাংক’। শিক্ষক-শিক্ষিকাসহ সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে কঙ্কাল সংগ্রহ করে এই কার্যক্রম চালু করেছেন তারা। প্রথম ধাপে আবেদনকৃতদের মধ্য থেকে এমবিবিএস কোর্সের ৪১ জন ও বিডিএস কোর্সের ১৮ জনের হাতে মানব কঙ্কাল তুলে দিয়েছেন উদ্যোক্তারা।
তারা জানান, বোনস ব্যাংকের মূল লক্ষ্য হলো- মেডিক্যাল শিক্ষার্থীদের জন্য মানব কঙ্কাল সহজলভ্য ও নৈতিক উপায়ে প্রাপ্তিযোগ্য করা। মানবদেহের অঙ্গ কোনো ব্যবসায়িক পণ্য নয়। শিক্ষার প্রয়োজনে এর যথোপযুক্ত ব্যবহারের মাধ্যমে নৈতিকতা ও সহমর্মিতার চর্চা করাটাই জরুরি। শর্তসাপেক্ষে কঙ্কাল সরবরাহ এবং ব্যবহারের পর তা ফেরত দেওয়ার এই ব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের মধ্যে সহযোগিতা ও মানবিক মূল্যবোধ গড়ে তুলবে।
যেভাবে চলবে বোন্স ব্যাংক
প্রথম পেশাগত পরীক্ষায় যারা উত্তীর্ণ হয়েছেন, তারা নিজেদের সংগ্রহে থাকা মানব কঙ্কাল জুনিয়রদের বিনামূল্যে পড়ার জন্য দিয়ে দিচ্ছেন। আবার তাদের পড়া শেষ হলে তারা পরবর্তী ব্যাচকে দিয়ে দিবেন। এই প্রক্রিয়ায় বোন্স ব্যাংকের কার্যক্রম চলমান থাকবে। তবে এখানে একপক্ষকে নিজেদের টাকায় কেনা কঙ্কাল দান করে দিতে হচ্ছে। অর্থাৎ, প্রথম যিনি টাকা দিয়ে কঙ্কাল কিনেছিলেন, তাকে তার টাকাটা দান করতে হচ্ছে বৃহৎ স্বার্থে। নির্ধারিত পরিমাণ অর্থ জামানতের মাধ্যমে কঙ্কাল সংগ্রহ করতে হবে। এই জামানত ১ম পেশাগত পরীক্ষা শেষ হওয়া পর্যন্ত সংরক্ষিত থাকবে। নির্ধারিত সময় শেষে কঙ্কাল সঠিকভাবে জমা দিলে জামানতের সম্পূর্ণ অর্থ ফেরত দেওয়া হবে। হারিয়ে গেলে বা নষ্ট হলে, শিক্ষার্থীকে তা নিজ দায়িত্বে পুনরায় সংগ্রহ করে দিতে হবে অথবা নির্ধারিত আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
উদ্যোক্তারা প্রতি সেট কঙ্কালের বক্সকে বিশেষ নামে নামকরণ করেছেন। যেমন: চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ডা. এস এম মোস্তফা কামাল ২০২১ সালের জুলাই মাসে ৬৭ বছর বয়সে কোভিড আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। ২০২০ সালের ২৪ জুন কোভিড প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল অর্থোপেডিক্স বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. সমিরুল ইসলাম বাবু’র। ১৯তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন অধ্যাপক ডা. রিদওয়ানুর রহমান। ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গুসহ বিভিন্ন সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগ নিয়ে তাঁর গবেষণা সমৃদ্ধ করেছে চিকিৎসাবিজ্ঞানকে।
ঠিক তেমনি ২০২৩ সালের ৮ ডিসেম্বর সাব অ্যারাকনয়েড হেমোরেজে ২০১৭-১৮ সেশনের শিক্ষার্থী রামিসা ফারিহা’র মৃত্যু, কলেজ ছাত্রাবাসে নৃশংস হামলায় আহত ২০তম ব্যাচ বিডিএস শিক্ষার্থী আবিদুর রহমান আবিদের ২০১১ সালের ২১ অক্টোবর মৃত্যুবরণ, অ্যাকিউট রেসপিরেটরি ডিসট্রেস সিনড্রোমে ৫৯তম ব্যাচের ইন্টার্ন চিকিৎসক সিমরান আশরাফের ২০২৩ সালের ১৬ মার্চ আইসিইউতে মৃত্যুর কথা স্মরণ রেখেছেন তারা।
স্মরণে রেখেছেন ডা. শাহ আলম বীর উত্তম, ভাষা আন্দোলনে অবদানের জন্য একুশে পদকপ্রাপ্ত চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. মির্জা মাজহারুল ইসলাম, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগের সাবেক প্রধান এবং সাউদার্ন ও বিজিসি ট্রাস্ট মেডিক্যাল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মরহুম ডা. মো. সুলতান উল আলম, চমেক হাসপাতালের নিউরোসার্জারি বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা বিভাগীয় প্রধান ডা. এল এ কাদেরী (লুতফুল আনোয়ার) সহ গুণী চিকিৎসকদের।
চমেক ৬৫তম ব্যাচের ইমতিয়াজ আহসান জামি জানান, কঙ্কাল ক্রয়-বিক্রয় বন্ধে এটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। চমেকের কিংবদন্তি শিক্ষক ও কৃতি শিক্ষার্থী, যারা অমর হয়ে আছেন এবং যাদের প্রয়াণ বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে অপূরণীয় ক্ষতি করেছে; তাঁদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে শিক্ষার্থীদের প্রদান করা হচ্ছে কঙ্কাল।
চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের (চমেক) নতুন অ্যাকাডেমিক ভবনের দ্বিতীয় তলায় প্রফেসর ডা. মনসুর খলিল স্মৃতি বোনস লাইব্রেরিতে মানবদেহের ১৫টি কঙ্কাল রয়েছে। চমেক এমবিবিএস ১ম ও ২য় বর্ষের কয়েকজন শিক্ষার্থী জানান, বাইরে থেকে এক সেট কঙ্কাল কিনতে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা খরচ হয়। বোনস লাইব্রেরি হওয়ার পর পড়ালেখার সুযোগ বেড়েছে। আইটেম (নির্দিষ্ট বিষয়ের পরীক্ষা) দেওয়ার আগে এখান থেকে নির্দিষ্ট হাড় বাসায় নিয়ে পড়ারও ব্যবস্থা আছে। এখন চালু হওয়া ‘সিএমসি বোন্স ব্যাংক’ পড়ালেখার সুযোগ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের (চমেক) অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. জসিম উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, কঙ্কাল নিয়ে পড়াশোনার জন্য বোনস লাইব্রেরি শিক্ষার্থীদের সহায়ক হয়েছে। পাশাপাশি ৬৫তম ব্যাচের হাত ধরে যাত্রা শুরু করেছে ‘সিএমসি বোন্স ব্যাংক’।
এসি/টিসি