ঢাকা, বুধবার, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১, ০১ মে ২০২৪, ২১ শাওয়াল ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

চট্টগ্রামের বিশেষ প্রতিবেদন

৫০ লাখ গাছ, জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করে শিল্পাঞ্চল!

ইফতেখার ফয়সাল, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮২৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১, ২০১৪
৫০ লাখ গাছ, জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করে শিল্পাঞ্চল!

চট্টগ্রাম: সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ৮৫৩ একর জমি নিয়ে বন বিভাগের আপত্তির মুখে থমকে আছে দেশের সর্ববৃহৎ বিশেষায়িত অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মাণের ভূমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া।

চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে পরিকল্পিত এই অঞ্চলের ৭ হাজার ৭১৬ একর জায়গার মধ্যে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের এই জমিতে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল করা হলে ম্যানগ্রোভ ও নন ম্যানগ্রোভ বনের প্রায় ৫০ লাখ গাছ কাটা পড়বে বলে দাবি করছে বন বিভাগ।



একইসঙ্গে উপকূলীয় এই বনাঞ্চলে বিচরণকারী হরিণ, বানর, সাপসহ বিভিন্ন বণ্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়বে বলে মনে করেছে প্রতিষ্ঠানটি।

সম্প্রতি নিজেদের এক জরিপে সম্ভ‍াব্য এই ক্ষয়ক্ষতির চিত্র উঠে আসার পর বিষয়টি পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়, চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসকসহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরকে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে।


উপকূলীয় বন বিভাগের কর্মকর্তা (ডিএফও) আর এস এম মুনিরুল ইসলাম বাংলানিউজকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

তিনি বলেন, সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ব্যাপারে সরকার সিদ্ধান্ত নেবে।   তবে আমরা যে জরিপ করেছি তাতে মনে হয়েছে এ বনাঞ্চলকে অর্থনৈতিক অঞ্চলের আওতায় নিয়ে যাওয়া হলে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য ব্যাপক হুমকির মুখে পড়বে।

“জরিপের বিষয়টি আমরা আমাদের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি লিখিতভাবে জেলা প্রশাসনকে জানিয়েছি। আমাদের অভিমত কোনভাবেই সংরক্ষিত এই অঞ্চলকে ইকোনমিক জোনের আওতাভুক্ত করা উচিত হবে না। ”

শুধু মিরসরাই নয়, চট্টগ্রামে প্রস্তাবিত অপর বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল আনোয়ারায়ও ২০৫ দশমিক ০৬ একর বনকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

চলতি বছরের ১১ মে এ সম্পর্কে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ে প্রধান বন সংরক্ষক মো. ইউনুছ আলীর পাঠানো এক চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, জাতীয় বননীতি অনুযায়ী সংরক্ষিত বন বনায়ন ব্যতীত ভিন্ন কাজে ব্যবহার করা যায় না।   সংরক্ষিত বনে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা প্রচলিত বন আইন ১৯২৭ এর  পরিপন্থী এবং দণ্ডনীয় অপরাধ।

প্রধান বন সংরক্ষকের পক্ষ থেকে বলা হয়, মিরসরাই ও আনোয়ারা উপজেলার প্রস্তাবিত এলাকায় ইকোনমিক জোন স্থাপন করা হলে সংশ্লিষ্ট বনভূমিতে বিরাজমান পঞ্চাশ লক্ষাধিক ম্যানোগ্রোভ ও নন ম্যানোগ্রোভ গাছ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।   এতে সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রাকৃতিক পরিবেশ, বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্রের ওপর মারাত্মক বিরূপ প্রভাব পড়বে।

উপকূলীয় অঞ্চলে বসবাসরত জনগোষ্ঠীর জীবন-সম্পদ সামু্দ্রিক ঝড় ও জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবেলার জন্য বনাঞ্চল সংরক্ষণের আবশ্যকতা রয়েছে বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়।

বন বিভাগ সূত্র জানায়, মিরসরাইয়ে প্রস্তাবিত বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে উপজেলার সাহেরাখালী মৌজার ৫৮ দশমিক ৭৭ একর, দক্ষিণ মঘাদিয়া মৌজার ৫২১ দশমিক ১৭ একর এবং ডোমখালী মৌজার ১০২ দশমিক ৯৩ একর পূর্ব মৌজার ৪২ দশমিক ৮২ একর এবং পূর্ব ইছাখালী মৌজার ১২৭ দশমিক ৬৮ একর সংরক্ষিত বনভূমিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

অন্যদিকে, আনোয়ারা বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্য অন্তর্ভুক্ত ২০৫ দশমিক ০৬ একর বনভূমি গহিরা মৌজায়।

বন বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, ১৯৯৭ এবং ১৯৯৫ এর গেজেটে ফেনী নদীর পাড় থেকে টেকনাফ উপকূল পর্যন্ত ১ লাখ ৯৫ হাজার একর ভূমি সংরক্ষিত বনাঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বাংলানিউজকে বলেন, ‘রিজার্ভ ফরেস্টে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল করার কোন সুযোগ নেই।   রাষ্ট্র এ ধরণের কিছু করতে চাইলে এর আগে এ ধরণের ভূমিকে সংরক্ষিত বনভূমির আওতামুক্ত করে আদেশ জারি করতে হবে। ’

মিরসরাই ও ‍আনোয়ারা  বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্য প্রকল্পের সামগ্রিক পরিবেশগত ছাড়পত্রের জন্য বিভাগীয় পরিবেশ অধিদপ্তরের কাছে আবেদন করা হয়েছিল।   তবে, এখনো পর্যন্ত কোন ছাড়পত্র দেওয়া হয়নি বলে জানিয়েছেন বিভাগীয় পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক মো. শহীদুল আলম।

তিনি বাংলানিউজকে বলেন, ‘আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রকল্প এলাকা দু’টি পরিদর্শন করা হয়েছে। পরিদর্শন শেষে প্রকল্প দু’টিকে লাল ক্যাটাগরি হিসেবে চিহ্নিত করে পরিবেশ অধিদপ্তরের সদর দপ্তরে পাঠানো হয়েছে।

এদিকে, সংরক্ষিত বনাঞ্চলকে কোনভাবেই অর্থনৈতিক অঞ্চলের আওতাভুক্ত করা উচিত হবে না অভিমত প্রকাশ করেছেন পরিবেশ সংশ্লিষ্টরা।   তারা বলছেন, সংরক্ষিত বনাঞ্চল রেখেই পরিবেশ বান্ধব অর্থনৈতিক অঞ্চল করা যায়।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশবিদ্যা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সফিউল আলম বাংলানিউজকে বলেন, পরিবেশের স্বার্থে দেশে যেখানে নতুন করে বনাঞ্চল সৃষ্টি করার কথা, সেখানে সংরক্ষিত বনাঞ্চলে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল করার সিদ্ধান্ত মোটেও পরিবেশ, প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্যের জন্য সুফল বয়ে আনবে না।

একই ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. আল-আমীন বলেন, ‘বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল দেশের স্বার্থেই খুবই প্রয়োজন। কিন্তু ম্যানগ্রোভ বন যাতে ধ্বংস না হয় সেভাবে করতে হবে।   উপকূলীয় এ বন প্রস্তাবিত অর্থনৈতিক অঞ্চলটির জন্যই প্রয়োজন হবে। কারণ এ জায়গায় অর্থনৈতিক অঞ্চল হলে কোন দুর্যোগের প্রথম ধাক্কাটা প্রথম এর ওপরই আসবে।

“প্রকৃতির এই গ্রিন বেল্টটাকে ইকোনমিক জোনের নিরাপত্তার জন্যই প্রয়োজন” বলেন তিনি।

একইভাবে ম্যানগ্রোভ বন রক্ষার পক্ষেই মত দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের মেরিন অ্যান্ড ফিশারিজ বিভাগের অধ্যাপক রাশেদ-উন-নবী।

“ঘূর্ণিঝড়ের মতো কোন দুর্যোগ আসলে প্রথমে এ উপকূলীয় বনাঞ্চলের উপর দিয়েই প্রথম ধাক্কাটা যায়।   এ ধরণের বন উপকূলের জনগণকে সুরক্ষার চাদরে আঁকড়ে ধরার পাশাপাশি মাটির উর্বরতা বাড়াতে ভূমিকা রাখে। ” বলেন তিনি।

বিপুল পরিমাণ কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দেশে দ্রুত শিল্পোন্নয়ন এবং দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের লক্ষ্যে ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঁচটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার নীতিগত অনুমোদন দেয় সরকার।

এর মধ্যে চট্টগ্রামের মিরসরাই ও আনোয়ারায় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত হয়।

চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে প্রস্তাবিত প্রকল্পটির জন্য প্রাথমিক অবস্থায় ৯টি মৌজার ৬ হাজার ৬১৫৬ একর জমিতে অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দেয় জেলা প্রশাসক।

পরে ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরের (দিয়ারা) জরিপের পর পীরের চর মৌজার ১ হাজার একর জমি প্রস্তাবে অনর্ভুক্ত করে ৭ হাজার ৭১৬ দশমিক ৮৫ একর জমির প্রশাসনিক অনুমোদন দেয়া হয়।

এর মধ্যে বন বিভাগের দাবিকৃত সংরক্ষিত বনাঞ্চলের জমিগুলো রয়েছে।

চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, চলতি বছর জাতীয় অর্থনৈতিক নির্বাহী কমিটির বৈঠকে প্রকল্পটির অনুমোদন দেয়ার পর দ্রুত ভূমি অধিগ্রহণ সম্পন্ন করার জন্য গত ১৬ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসককে চিঠি পাঠানো হয়।

এছাড়া, ভূমি মন্ত্রণালয় পৃথক দুই চিঠিতে জেলা প্রশাসনকে  প্রস্তাবিত মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্য দুই হাজার ১৭০ একর সরকারি জমি সেলামি ব্যতীত হস্তান্তরের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলা হয়েছে।

চিঠি পেয়ে জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের তৎপরতা বাড়লেও বাংলাদেশ ইকোনমিক জোন অথরিটির (বেজা) কোন সুনির্দিষ্ট দিক নির্দেশনা না থাকায় থমকে আছে ভূমি অধিগ্রহণের কাজ।

মূলত, বন বিভাগের আপত্তির মুখেই মূলত ভূমি অধিগ্রহণের কাজ থমকে আছে। এ সমস্যা গড়িয়েছে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে।

গত ৯ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় থেকে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসকের কাছে এ ব্যাপারে একটি চিঠি পাঠানো হয়।   চিঠিতে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের সম্প্রসারণের জন্য রিজার্ভ ফরেস্টের এই ভূমির প্রয়োজন রয়েছে উল্লেখ করা হয়েছে।

বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের ভূমি অধিগ্রহণের বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রামের ভূমি হুকুম দখল কর্মকর্তা শাহাদত হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, বেজার পক্ষ থেকে এখনো পর্যন্ত ভূমি অধিগ্রহণের ব্যাপারে পূর্ণাঙ্গ কোন প্রস্তাব পাইনি।

“সম্ভাব্য এলাকায় বেশ কিছু ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা আছে, রিজার্ভ ফরেস্ট আছে, আমাদের চিহ্নিত করে না দিলে কিসের ভিত্তিতে ভূমি অধিগ্রহণ করবো। ”

বেজার প্রকল্প পরিচালক হারুনুর রশিদের কাছে এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রকল্পের ভূমি নির্ধারণে এখনো জরিপ চলছে।   জরিপ শেষ হলে তবেই আমরা সীমানা নির্ধারণ করে দিতে পারবো।

বাংলাদেশ সময়: ০৮৩০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।