ঢাকা, শনিবার, ২১ বৈশাখ ১৪৩১, ০৪ মে ২০২৪, ২৪ শাওয়াল ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

বাল্যবিবাহ রোধে সাইকেল নিয়ে দেশ ঘোরেন আনোয়ার

সৈয়দ বাইজিদ ইমন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৩১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০২২
বাল্যবিবাহ রোধে সাইকেল নিয়ে দেশ ঘোরেন আনোয়ার ছবি: বাংলানিউজ

চট্টগ্রাম: ‘হতে চাই না বিয়ের পাত্রী, হতে চাই স্কুল ছাত্রী’ স্লোগানে সাইকেল চালিয়ে টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া ঘুরে বেড়াচ্ছেন তিনি। সঙ্গে ঘোষণা দেওয়ার মাইক।

 

চলাচলের একমাত্র বাহন সাইকেলটির রং লাল। বাল্যবিবাহকে ‘না’ বলতে ছুটে চলছেন মো. আনোয়ার হোসেন তালুকদার।

বয়স পঞ্চাশ পেরিয়েছে অনেক আগেই। এই বয়সেও সাইকেল চালিয়ে বাল্যবিবাহ রোধে জনসচেতনতা সৃষ্টি করছেন। বাড়ি বগুড়ার বারবাকপুর গ্রামে।

পড়ালেখায় বেশি দূর এগুতে না পারলেও, যেটুকু আয়ত্ত করেছেন সেটুকু নিয়েই ২০১৫ সাল থেকে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধের যুদ্ধে নেমেছেন তিনি। এই সময়ের মধ্যে জেলা প্রশাসকসহ বিশিষ্টজনদের কাছ থেকে লিখিত মন্তব্য সংগ্রহ করেছেন। সিএমপি কমিশনার সালেহ মোহাম্মদ তানভীর সম্প্রতি নিজ কার্যালয়ে ডেকে নিয়ে তার হাতে তুলে দিয়েছেন অ্যান্ড্রয়েড ফোন।

বয়স বাধা হতে পারেনি। রয়েছে ইচ্ছাশক্তি, মনে দৃঢ় প্রত্যয়। এবার তিনি চট্টগ্রামের উপজেলাগুলো ভ্রমণ করার ইচ্ছা পোষণ করেছেন। মার্চের প্রথম সপ্তাহেই তিনি ভ্রমণে বেরিয়ে পড়বেন বলে জানালেন।  

আনোয়ার হোসেন ৬ মাস চাকরি করেন আর ৬ মাস দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে বেড়ান। সেই সঙ্গে ওই এলাকার জনসাধারণকে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে সচেতন করেন। এছাড়াও যেখানে বাল্যবিবাহ হয় সেখানেই প্রতিরোধে ছুটে যান আনোয়ার।  

আনোয়ারের দুই ভাগনি শিউলি আখতার ও মনোয়ারা বেগম। তাদের ১৪ বছর বয়সে বিয়ে হয়। কম বয়সে বিয়ে হওয়ায় অল্পতেই ভেঙে যায় সংসার। মেয়েদের এমন কষ্টে মানসিক ভারসাম্য হারান বাবা। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতেন তিনি। পরে মারা যান সড়ক দুর্ঘটনায়। এ ঘটনার পর থেকেই আনোয়ার বাল্যবিবাহ রোধে শপথ নেন।

বাংলানিউজকে আনোয়ার হোসেন বলেন, অভাব-অনটনের কারণে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছি। এরপর কাজ নেই বগুড়া শহরের একটি রেস্তোরাঁয়। দুই বছর পর চলে আসি চট্টগ্রামে। আগ্রাবাদ এলাকায় একটি দোকানে কাজ করেছি। বিয়ে করেছি কদমতলী এলাকায়। থাকতাম পাঠানটুলি রোডে। সেখানে থাকতেই আমার স্কুলপড়ুয়া দুই ভাগনির বিয়ে হয়ে যায়। তখন ওদের বয়স ছিল ১৪ ও ১৫ বছর। পরে দুই বোনই স্বামীহারা হয়ে ঢাকায় পোশাক কারখানায় চাকরি নেয়। ওদের কষ্ট দেখে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে প্রচার চালাতে উদ্যোগ নিয়েছিলাম।

উপজেলার বিভিন্ন অলি-গলি মাড়িয়ে রাতে সরকারি বাংলো কিংবা দফতরে রাত্রিযাপন করেন আনোয়ার। এরপর দিনের বেলা পুরো উপজেলায় ঘুরে বেড়াতেন। বিভিন্ন স্কুলে গিয়ে শিক্ষার্থীদের বোঝান বাল্যবিবাহের কুফল সম্পর্কে। পথচারীদেরও বাল্যবিবাহের কুফল সম্পর্কে জানাতে হাতে তুলে দেন লিফলেট।  

৬৭দিনে ৬৪ জেলা বাইসাইকেলে ভ্রমণ করেছেন আনোয়ার। বগুড়ার ১১টি, নওগাঁর ১১টি, নাটোরের ৭টি, সিরাজগঞ্জের ৯টি, পাবনার ৬টি, মেহেরপুরের ৪টি, কুষ্টিয়ার ৬টি, চুয়াডাঙ্গার ৪টি ও ঝিনাইদহের ৪টি উপজেলায় প্রচারণা চালিয়েছেন। আনোয়ার হোসেন স্বপ্ন দেখেন, বাংলাদেশ একদিন বাল্যবিবাহ মুক্ত হবে।  

দুই যুগ পর চট্টগ্রাম ছেড়ে কুমিল্লার দাউদকান্দিতে আসবাবের দোকান দেন আনোয়ার। সেখানেও বাল্যবিবাহের নানা ঘটনা ঘটতে দেখে তাঁর মন খারাপ হয়। এরপর দোকান বিক্রি করে পুরোনো একটি সাইকেল কেনেন। কিছু প্রচারপত্রও ছাপান। ২০১৪ সালের নভেম্বর মাসে সেই সাইকেলে চেপে বেরিয়ে পড়েন। কুমিল্লা, ফেনী ও চট্টগ্রাম শহর ঘুরে মানুষের হাতে তুলে দেন বাল্যবিবাহ বিরোধী প্রচারপত্র।

আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘রাস্তাঘাটে অনেকেই প্রশ্ন করেছেন, আমার সবকিছু লাল কেন? জবাবে বলেছি, বাল্যবিয়ে পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্র সবার জন্যই বিপজ্জনক। লাল পোশাক-সাইকেল-পতাকার মাধ্যমে আমি বোঝাতে চেয়েছি, বাল্যবিয়ে আসলেই বিপজ্জনক’।

আনোয়ার হোসেন বলেন, বাল্যবিবাহের শিকার দুই ভাগনির করুণ পরিণতি তাঁকে কষ্ট দেয়। এরপর থেকে খবরের কাগজে বাল্যবিয়ের সংবাদ দেখলেই খুব মনোযোগ দিয়ে পড়েন, সংগ্রহ করে রাখেন।  

বাংলাদেশ সময়: ১২২২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০২২ 
বিই/এসি/টিসি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।