ঢাকা, শনিবার, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

দিল্লি, কলকাতা, আগরতলা

কলকাতার মতো আপনিও কি ‘বাংলিশ’এ অভ্যস্ত!

ভাস্কর সরদার, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮১৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১৬
কলকাতার মতো আপনিও কি ‘বাংলিশ’এ অভ্যস্ত!

কলকাতা: ‘বাংলিশ’। শব্দটা শুনেই প্রশ্ন জাগতে পারে এটা আবার কেমন ভাষা? কলকাতার ‘নেট’ জগতের তরুণরা আপনাকে এক কথায় বলে দেবে- কিছুটা বাঙলা আর কিছুটা ইংরেজি মিশিয়ে প্রচলিত যে নতুন ভাষা, তাই ‘বাংলিশ’।

অনেকটা সুকুমার রায়ের ‘হাঁসজারু’-এর মতো কিছুটা হাঁস আর বাকিটা সজারু।

আরেকটু জানতে চাইলে আপনাকে ‘বাংলিশ’ শুনতে হবে। যদিও এতে মাথা ব্যথা হওয়ার কিংবা হেঁচকি ওঠার সম্ভাবনা আছে। তারপরও ঝুঁকি নিয়ে শুনলে আপনি দেখতে পাবেন তাতে ইংলিশ আছে ৮০ শতাংশ আর বাঙলা ২০ শতাংশ।

এটা কি তবে বাঙালির বিশ্বায়ন, নাকি বাঙলা ভাষার ইংরেজিওয়ানা- এমন প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে।

‘বাংলিশ’ ভাষার কিছু চিত্র তুলে ধরা হলো বাংলানিউজের পাঠকের জন্য।

আমার এক বান্ধবী, আমায় হোয়াটস অ্যাপ মেসেজ করলো ‘Maa ask korlo J, kaal 2mi maa k ph korlena keno’ ভাষাটা বাংলা হলেও অক্ষর গুলো ইংরেজি। কয়েক দশক আগে বাঙালির কাছে ছিলো এটা এক নতুন পণ্য। সম্প্রতি মোবাইল ফোনের দৌরাত্মে ইমেইলে, এসএমএসে, ফেসবুকে, হোয়াটস অ্যাপে বৈচিত্র্যময় এসব বাক্যবিন্যাস দেখা যাচ্ছে। পড়তে গেলেও পদে পদে বিপদ। ‘hate’ লেখা দেখে বিভ্রান্ত হতে হয় ‘আমি কি এতই ঘৃণ্য’? নতুন প্রজন্মের কাছে ওটা হলো ‘হাতে’। নতুন প্রজন্মের অনেকে বলেন এটা হলো ই-ভাষা।

ফেসবুক কথোপোকথনে আরও বিচিত্র সংক্ষিপ্তকরণের ছড়াছড়ি। o.m.g. দেখলে ভাবতে পারেন বোধ হয় লিখতে চাইছে ‘ও মাগো’, কিন্তু ওটা আসলে বিস্ময়যুক্ত ‘ও- মাই- গড’!

কত সংক্ষেপে লেখা যায়, তারও যেন একটা প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে ই-ভাষায়। আর এই চর্চা যে কত ভয়াবহ আবহ তৈরি করে, তার একটি চিত্র দেওয়া যাক। হাঁটুর বয়সী একটি মেয়ে লিখেছে ‘আঙ্কেল, এই নিয়ে চারটে মেসেজ করলাম, বাট এখনও তুমি আমাকে রেপ করলে না’। আসলে ইংরেজি হরফে ‘rep’ হলো ‘reply’-এর সংক্ষিপ্তকরণ। শুধু ‘u’ অক্ষরটি দিলেই বুঝে নিতে হবে, ওটা আসলে ‘you’।

তবে বাংলা কিছু শব্দের সঙ্গে ইংরেজি বর্ণের উচ্চারণগত মিলও দেখা যায়। যেমন J হলো যে, K হলো কে।

এই রীতিতে লিখলে কেমন হয় দেখুন তবে, ‘O PC ADK SO’। কিছু বুঝলেন? এবার ওই ইংরাজি অক্ষরগুলো উচ্চারণ করুন বাংলা বলছেন ভেবে, দেখুন আপনার শ্রবণে মধু বর্ষণ করে ই-ভাষা বলবে ‘ও পিসি, এদিকে এসো’।

ই-ভাষার মক্কা অধুনা ফেসবুক। গবেষণার অজস্র রসদ মজুত রয়েছে ফেসবুকিয়ানদের ওয়ালে। খ্যাতনামা ব্যক্তির জন্মদিন বা মৃত্যুদিন এলেই হলো। ছবি পোস্ট করার ধুম লেগে যাবে হৃদকমলে। পোস্টটা যদি মৃত্যুদিনের হয়, তাহলেই গেড়ো। খালি কমেন্ট আসবে ‘RIP’। বিপ-বিপ ধ্বনির মতো এই রিপ-রিপ বস্তুটা কি, তা না বুঝলে আপনি যে ই-দুনিয়ায় অর্বাচিন তা প্রমাণ হয়ে যাবে। এই রিপ হলো ‘রেস্ট ইন পিস’। শান্তিতে থাকার অশান্তিকর প্রার্থনা।

শুধু কি ভাষার জটিলতা! ফেসবুকিয়ানরা কেউ লাইক বিশেষজ্ঞ। এরা বেশি কথা না বলে পাইকারি হারে লাইক করে যান। কারও হয়তো বাবা মরেছে, সে বেচারি কাঁদোকাঁদো ভাষায় জানিয়েছে মৃত্যুসংবাদ। ব্যস, লাইক মাস্টার সেটিও দিলেন লাইক করে।

এক কিসিমের ফেসবুকিয়ান আছেন, যাদের বলা হয় স্ট্যাটাসটিয়ান। এরা পাঁচ মিনিট অন্তর অন্তর হেঁচকি তোলার মত স্ট্যাটাস দিতে থাকেন। কারও উত্তর বা মতামতের ধার ধারেন না। স্ট্যাটাসে থাকে ‘ডব্লিউ.টি.এইচ বড্ড মাথা ধরেছে’, পরমুহূর্তেই ‘উফ্ কী দিল!’ কে দিলেন, কাকে দিলেন, কেন দিলেন- তা কেউ জানতেও চায় না। তবু তিনি শুধু স্ট্যাটাস দিয়ে যান।

ই-রাজ্যের আর এক বাসিন্দার নাম বলা যেতে পারে কমেন্টেটার। তিনি যেখানে পারেন, কমেন্ট দিয়ে বেড়ান। চেনা-অচেনার ধার ধারেন না। হয়তো একটি বিমূর্ত ছবি নিয়ে কথা বলছেন দুজন শিল্পী বন্ধু। কমেন্টেটার এদের ভেতরে ঢুকে বলে এলেন – ‘টিএনএক্স’। কাকে ধন্যবাদ জানালেন, কেন জানালেন, এসব প্রশ্নই ই-দেশে অপ্রাসঙ্গিক।

‘আমার ছেলে মেয়ের বাংলাটা ঠিক আসে না’ বা ‘সব সাবজেক্টেই ভালো, ওই বাংলাটায় একটু দুর্বল’। বেশ গর্ব করেই বলেন কিছু কলকাতার মধ্যবিত্ত বাবা এবং মা। ‘মধ্যবিত্ত’ শব্দটি সচেতনভাবেই ব্যবহার করা হয়েছে। কলকাতার উচ্চবিত্ত এবং নিম্নবিত্তদের মধ্যে এই প্রভাব লক্ষণীয় হারে কম।

কলকাতার প্রেক্ষিতে একটু খোঁজ নেওয়া যাক, বাঙলার কেন এমন অবস্থা। নজর ফেলা যাক সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিষয়ে।

গত কয়েক বছর যাবৎ কলকাতায় ইংরেজি মাধ্যমের বিদ্যালয়ের সংখ্যা বেড়েছে কয়েক গুণ। এগুলো মূলত বেসরকারি। সরকারিভাবেও একটি দুটি করা হয়েছে। অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের ইংরেজি মাধ্যমে পড়াতেই বেশি আগ্রহী।

অর্থনৈতিক‍ভাবে দুর্বল এবং কিছু আদর্শবাদী অভিভাবক ছাড়া সন্তানকে বাঙলা মাধ্যম শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াতে কেউ ইচ্ছুক নন। এখানে শিক্ষার মানের থেকে ইংরেজি মাধ্যম বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। কলকাতার অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দ্বিতীয় ভাষার মধ্যে থাকে হিন্দি। ফলে বাঙলা ভাষা চলে যাচ্ছে অবহেলার অন্তরালে।

ভারতের সবগুলো রাজ্যে প্রায় ৬৮৮টি জেলা রয়েছে। অন্যান্য আঞ্চলিক ভাষার মতোই বাঙলাও একটি ভাষা। অন্যান্য জেলার বেশির ভাগ মানুষ নিজেদের ভাষায় প্রাথমিক স্তর পর্যন্ত পড়ালেখা করে।

এছাড়া আছে বাধ্যবাধকতার জায়গা। কলকাতার বই বাজারে ঘুরে উচ্চশিক্ষার জন্য বাঙলা মাধ্যমে ভালো বই একটির বেশি দুটি জোগাড় করা প্রায় অসম্ভব। ফলে উচ্চশিক্ষার কথা ভাবতে হলে ইংরেজি ভাষা জানতেই হবে।

এবার আসা যাক অর্থনৈতিক কারণে দিকে। ভারতের পূর্ব অংশ থেকে পশ্চিম অংশে বসবাস করা অনেক বেশি সহজ। এর ফলে ভারতের অন্যান্য রাজ্য থেকে বহু মানুষ চলে আসেন কলকাতায়। আসেন অনেক ব্যবসায়ী। তাদের সংস্থায় কাজ করা কর্মীরা মালিকের ভাষাতেই কথা বলতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে।

আরেকটি বড় কারণ হলো কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গে অফিস আদালতে প্রচলিত ভাষা এখনও ইংরেজি। তাই সেখানে কাজ করতে গেলে ইংরেজি জানতেই হয়। কলকাতাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা তথ্য প্রযুক্তি সংস্থাগুলোতে ইংরেজি জানা কর্মচারীর চাহিদা অনেক। এ দিকটিকে মাথায় রেখেও শিক্ষার্থীরা ইংরেজিতে তাদের দক্ষতা বাড়াতে চায়।   ধীরে ধীরে তাদের মুখের ভাষা হয়ে উঠছে ইংরেজি।

বাংলাদেশ সময়: ১৮১১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১৬
ভিএস/এটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।