ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

দিল্লি, কলকাতা, আগরতলা

মসনদ ধরে রাখতে মমতা, ফিরে পেতে মরিয়া বাম-কংগ্রেস

সুকুমার সরকার, সিনিয়র স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৩০ ঘণ্টা, এপ্রিল ২, ২০১৬
মসনদ ধরে রাখতে মমতা, ফিরে পেতে মরিয়া বাম-কংগ্রেস ছবি: সুজিৎ সিংহ - বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

কলকাতা থেকে ফিরে: সোমবার (০৪ এপ্রিল) থেকে শুরু হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার ২৯২ আসনের নির্বাচন।

হারানো মসনদ ফিরে পেতে বামপন্থী সিপিআই-এম হাত মিলিয়েছে কংগ্রেসের সঙ্গে।

আর ধরে রাখতে বসে নেই ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেস দলনেত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ও। তার ভরসা রাজ্যের সংখ্যালঘু মুসলিম ভোট। এ সমর্থন অক্ষুন্ন রাখতে তিনি জোরালো প্রচেষ্টা শুরু করেছেন। ছুটে চলেছেন রাজ্যের নানা প্রান্তে। কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপি জোটও এ রাজ্যে ক্ষমতার ভাগ বসাতে চালাচ্ছে জোর প্রচেষ্টা।

বাংলাদেশ সংলগ্ন পশ্চিমবঙ্গ সব দলের কাছেই গুরুত্বপূর্ণ।

বেনাপোল-পেট্রাপোল সীমান্ত পার হয়েই মহকুমা শহর বনগাঁওমুখী রাস্তায় ভোট কামনা করে লেখা হয়েছে বিশাল বিশাল দেয়াল লিখন। প্রার্থীদের পক্ষে শত বছর আগে ঝিনাইদহের উপজেলা কালীগঞ্জের কালীবাবুর রোপন করা শিশু (রেনট্রি) গাছে সাঁটানো হয়েছে বিশাল বিশাল পোস্টারও।

প্রভাবশালী কালীবাবু তার মায়ের ভারতের বিভিন্ন স্থানে তীর্থভ্রমণে যাওয়ার পথে এসব শিশু গাছ রোপণ করেছিলেন, যেন তার মা প্রখর রৌদ্র ও ঝড়-বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা পান। কালীবাবু নেই। কিন্তু তার পরম শ্রদ্ধার কীর্তি কালের স্রোতে বহমান।

পেট্রাপোল সীমান্তের সাত কিলোমিটারের মাথায় উত্তর চব্বিশ পরগণা জেলার মহকুমা শহর বনগাঁও। শহরে ঢোকার মুখে মতিগঞ্জ সংলগ্ন ইছামতি নদীর ওপর সেতু পার হলে মূল বনগাঁও শহর। এ ইছামতিকে নিয়ে আবার প্রবল নস্টালজিয়ায় ভুগতেন সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। তার অধিকাংশ লেখায় স্থান পেয়েছে তাই ইছামতী।
 
বনগাঁও রেলস্টেশনে যাওয়ার দুই কিলোমিটার পথেও দেখা যাচ্ছে হাজারো দেয়াল লিখন ও পোস্টার। এক দশক আগে পশ্চিমবঙ্গে তেমন নির্বাচনী পোস্টার চোখে পড়তো না। সবটাই ছিল দেয়াল লিখন।
 
বনগাঁও থেকে কলকাতা যেতে দু’ঘণ্টার ট্রেন ভ্রমণে যাত্রীদের মুখে মুখে ফিরছে নিজ নিজ এলাকার প্রার্থীদের কাজের খতিয়ান ও নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার হিসাব-নিকাশ।
 
আর পাড়ায় পাড়ায় চায়ের দোকানগুলোতেও চলছে গরম চায়ের মতো নির্বাচনের গরম আলোচনা। বিকেলের পরেই বিভিন্ন দলের সমর্থকরা বেড়িয়ে পড়ছেন ভোট চাইতে। ছাপানো ভোটার তালিকা হাতে করে বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে কুশল বিনিময় শেষে বিনীতভাবে ভোট কামনা করছেন তারা।
 
গত সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়ে  গেছেন পশ্চিমবঙ্গে। বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ’ও কয়েক দফা পশ্চিমবঙ্গ সফর করেছেন। দফায় দফায় বৈঠক করেছেন রাজ্যের দলীয় নেতাদের সঙ্গে।

কেন্দ্রে বিজেপি ক্ষমতাসীন হওয়ার পর পশ্চিমবঙ্গে দলটির কর্মী সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। পাড়া-মহল্লায় এখন প্রায় প্রতিদিনই মিছিল বের করে ভোট চাইছেন বিজেপি সমর্থকরা। যা আগে তেমনটা চোখে পড়েনি।  

আর তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তো প্রতিদিনই রাজ্যের কোনো না কোনো প্রান্তে ছুটে যাচ্ছেন নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণায়। তাকেই সামলাতে হচ্ছে পুরো দলটি। তৃণমূল কংগ্রেস বলতে অবশ্য মমতাকে বোঝায়। তাকে বাদ দিয়ে তৃণমূলকে একদমই কল্পনা করা যায় না।  
 
তাই তো তিনি দলের সবার কাছে এক নামে দিদি বলেই পরিচিত। এমনকি বাবা-ছেলে-মেয়ে সবাই তাকে দিদি নামেই উল্লেখ করেন।

মসনদ ধরে রাখতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ফুরফুরা শরীফের পীরজাদা ত্বহা সিদ্দিকি, জমিয়তে ওলামায়ে হিন্দ তথা রাজ্য এআইইউডিএফ প্রধান মাওলানা সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরী এমনকি দিল্লি জামে মসজিদের ইমাম মাওলানা সাইয়্যেদ আহমদ বুখারির সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন। ইতোমধ্যে মাওলানা সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন তিনি।
 
এমনকি মমতার জেতা আসনে প্রার্থী করে সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরীকে মন্ত্রী করারও আশ্বাস দেওয়া হয়েছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। যদিও তৃণমূল বা এআইইউডিএফ-এর পক্ষ থেকে এ সংক্রান্ত খবরের সত্যতা নিশ্চিত করা হয়নি।
 
অন্যদিকে অতীতের বিরোধ ভুলে সিপিএম ও কংগ্রেস নেতারা কয়েকদফা বৈঠক করে অবশেষে জোট বেঁধেছেন। তাদের বক্তব্য- রাজ্যে গণতন্ত্র বাঁচলে আদর্শগত বিরোধ নিয়ে চুলচেরা তর্ক অনেক করা যাবে।
 
অতীতে কী হয়েছে না হয়েছে, গ্রামে-গঞ্জে শহরে-শহরতলীতে দলীয় কর্মী-সমর্থকদের ওপর সিপিএমের ক্যাডার বাহিনী কতো অত্যাচার-নিপীড়ন করেছে, দলের কতোজন তাদের হাতে প্রাণ দিয়েছেন, সেসব হিসেব এখন সিন্দুকে পুরে ফেলেছেন প্রদেশ কংগ্রেস নেতৃত্ব।

আবার এর আগে বিহার বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের ফল দেখে ‘উজ্জীবিত’ হাইকমান্ডও আরও বড় লাভের আশায় প্রদেশ কংগ্রেসকে বামেদের সঙ্গে জোট গড়তে উৎসাহিত করেছেন।      

দুই দলের কাছে এখন শুধু বাম-কংগ্রেস জোট সত্য, তার বাইরে সব মিথ্যা!
 
কারণ, এ রাজ্যের কংগ্রেস নেতৃত্বের দৃঢ় বিশ্বাস, সিপিএমের সঙ্গে জোট গড়ে ভোট লড়লে তাদের প্রধান দুটি স্বপ্ন সফল হবে। সেগুলো হচ্ছে- বামেদের সঙ্গে মিলে ভোটের অঙ্কে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে হারানো এবং সেই সূত্রে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে নিজেদের প্রাসঙ্গিকতা পুনরুদ্ধার!
 
তবে এ দুই স্বপ্নের বাস্তবায়ন নিয়ে সিপিএম-কংগ্রেস  দ্বিধান্বিত। কেননা, মমতা ব্যানার্জি পশ্চিমবঙ্গের মানুষের কাছে সাধা-সিধা নারী হিসেবে ক্ষমতার পাঁচ বছর পার করলেও এখনও বেশ জনপ্রিয়।
 
কংগ্রেস-বাম জোটের বিষয়েও দারুণ সরব মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কংগ্রেসের যেসব কর্মী-সমর্থক জোট মানতে পারেননি, তাদেরকে কাছে টানার বার্তা দিয়েছেন তৃণমূল নেত্রী।   তার কথায়, সিপিএম আর কংগ্রেস পরস্পরের কাছে বিকিয়ে গেছে। যেসব বামপন্থী ও কংগ্রেস কর্মীরা এটা মানতে পারছেন না, তাদের একজোট হতে বলেছেন তিনি।

মমতা বলেছেন, তৃণমূল কংগ্রেস আপনাদের সঙ্গে আছে। জোট বেঁধে এ অনৈতিক ঘোঁটের বিরুদ্ধে ভোট দিন।    
 
তবে নারদ-কাণ্ড এবং ‘ঘুষ-কাণ্ড’ নিয়ে বেশ বেকায়দায় পড়েছেন তৃণমূল নেত্রী।
 
বিজেপির প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি তথা দলের অন্যতম সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক রাহুল সিনহাকে ঘুষ দিতে চাওয়ার অভিযোগ উঠেছে খোদ কলকাতা পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের এক এএসআই এবং এক কনস্টেবলের বিরুদ্ধে।
 
মুর্শিদাবাদ  সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে গরু পাচারে সহযোগিতা করলে রাহুল সিনহাকে বড় অঙ্কের টাকা উৎকোচের প্রস্তাব দেওয়া হয়। রাহুল সিনহা তাদের জোড়াসাঁকো থানার পুলিশের হাতে তুলে দেন। তখনই জানতে পারেন যে, তারা কলকাতা পুলিশেরই স্পেশাল ব্রাঞ্চের কর্মী।  
 
এ রকম একটি ঘটনার পেছনে রাহুলের অভিযোগই সত্যি নাকি আরও গভীর কোনও ‘মোটিভ’ রয়েছে, তা নিয়ে জল্পনা শুরু হয়েছে রাজনৈতিক মহলে। একজন ডিসি’র নেতৃত্বে তদন্ত চলছে।
 
তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, যতো খারাপ কাজ, সব তৃণমূল করে- মানুষ এটা বিশ্বাস করে না। আগামী ১৯ মে ঘোষিত নির্বাচনের ফলাফলে মানুষ এর জবাব দেবে।
 
এদিকে ভোটের মুখে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রচারণায় উঠে এসেছে সদ্যবিলুপ্ত ছিটমহল প্রসঙ্গও। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘ছিটমহল হস্তান্তর হয়ে গেছে গত বছরের ৩১ জুলাই রাত থেকে। অনেকে অনেক কথা বলেন, কিছু করে দেখাতে পারেন না। স্বাধীনতার পর সবাই বলেছেন, হবে, হবে। কিন্তু হয়নি। আমাদের মা-মাটি-মানুষের সরকার ক্ষমতায় এসেছে বলেই আজ ওপার বাংলার মানুষ, এপার বাংলার মানুষ নতুন মুক্তির স্বাদ পেয়েছেন। নতুন করে স্বাধীনতা পেয়েছেন। মুক্তির এই আনন্দ জীবনে আরও অনেক আনন্দ বয়ে আনুক। মনে রাখবেন, এজন্য বাংলাদেশে গিয়েছিলাম। বাংলাদেশ যাওয়ার পর আমি নিজে ছিটমহলে এসেছিলাম। এই চুক্তি হয়ে গেছে। শুধু তাই নয়, হস্তান্তর হয়ে গেছে’।
 
‘এবার যেটা লক্ষ্য, সেটা হচ্ছে দেশের সাম্প্রদায়িকতা, শান্তি, মৈত্রী, ভ্রাতৃত্ব উভয় দেশের সম্পর্ক রেখেই উন্নয়নের কাজে এগিয়ে যেতে হবে’ বলেও মন্তব্য মমতার।
 
তবে নির্বাচন বিশ্লেষকরা বলছেন, ভোটে হিসেবে কংগ্রেস ও বাম বোঝাপড়ার মোকাবেলা করেও তারকা-কেন্দ্রে এগিয়ে থাকছে  তৃণমূল। তবে পতন হতে পারে কিছু তারকার!

এমনই ইঙ্গিত দিচ্ছে এবিপি আনন্দ-এ সি নিয়েলসেনের যৌথ জনমত সমীক্ষাও। সমীক্ষা চালানো হয়েছে যে ৪৯টি আসনে, তার মধ্যে ২৩টিতে জয়ী হতে পারেন তৃণমূল প্রার্থীরা। কংগ্রেস ও বামেদের গণতান্ত্রিক জোট জিততে পারে ১৪টিতে। বিজেপি ও গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার একটি করে আসনে জেতার ইঙ্গিত দিচ্ছে সমীক্ষা।
 
১০টি আসনে তৃণমূল প্রার্থীদের সঙ্গে বিরোধীদের লড়াই হাড্ডাহাড্ডি! শেষ বিচারে এসব কেন্দ্র থেকে জয়ী হতে পারেন যেকোনো প্রার্থীই। গত ১০ থেকে ২১ মার্চের মধ্যে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটারদের সঙ্গে মুখোমুখি কথা বলে এ সমীক্ষা করা হয়েছে।
 
বাংলাদেশ সময়: ১৩০৯ ঘণ্টা, এপ্রিল ০২, ২০১৬
এসএস/এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।