ঢাকা: বাজারে যখন দফায় দফায় পল্ট্রি বা ব্রয়লার মুরগির দাম বাড়ছে, ঠিক সেই সময় শুরু হয় আন্তর্জাতিক পল্ট্রি শো অ্যান্ড সেমিনার-২০২৩। পল্ট্রি মেলায় অংশগ্রহণ করা বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে, আধুনিক পদ্ধতিতে পল্ট্রি খামার করতে পারলে লোকসান হবার সম্ভাবনা কম থাকে, একইসঙ্গে উৎপাদনও বৃদ্ধি পায়।
পাশাপাশি দেশের চলমান যে সংকট চলছে ফার্মের মুরগি ও ডিম উৎপাদনের, তা আগামী কয়েক মাসের মধ্যে কেটে যাবে বলে আশা করছেন এ খাত সংশ্লিষ্টরা।
শনিবার (১৮ মার্চ) ঢাকার কুড়িলে ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সিটি বসুন্ধরায় (আইসিসিবি) ১২তম আন্তর্জাতিক পল্ট্রি শো অ্যান্ড সেমিনারের শেষ দিনে মেলা প্রাঙ্গণ ঘুরে এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বলে এমনটাই জানা গেছে।
মেলার শেষ দিনে পল্ট্রি সেক্টরের উৎপাদন থেকে শুরু করে বাজারজাতকরণ পর্যন্ত কাজে যুক্ত সব স্টেকহোল্ডার এবং তরুণ উদ্যোক্তাদের মিলনমেলায় পরিণত হয় পোল্ট্রি শো। পাশাপাশি এই সেক্টরের আধুনিক প্রযুক্তি ও নতুন কী পণ্য এসেছে এবং দাম সম্পর্কে খোঁজ নিতে দেখা গেছে তরুণ উদ্যোক্তাদের।
পল্ট্রি মেলার শেষ দিনে ঘুরতে এসে বাসার ছাদ বাগানের জন্য জৈব সার কিনছিলেন সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় পাস করা শিক্ষার্থী নাসিফ খান। পাশাপাশি নিজেই উদ্যোক্তা হয়ে গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইলে অ্যাগ্রো ব্যবসা শুরু করবেন। পল্ট্রি শো মেলায় এসেছেন অ্যাগ্রো সেক্টরের সার্বিক পরিস্থিতি এবং এর আধুনিক টেকনোলজি সম্পর্কে সামগ্রিক ধারণা নিতে।
এ ধরনের মেলা বিশেষ করে তরুণ উদোক্তাদের জন্য কেমন সম্ভাবনাময় জানতে চাইলে নাসিফ খান বাংলানিউজকে বলেন, বিশ্বে এখন সবকিছুই খুব আধুনিক হয়েছে। তাই কৃষি খাতে কেউ যদি উদ্যোক্তা হয়ে লাভবান হতে চায় তাকে অবশ্যই আধুনিক হতে হবে। এ ধরনের মেলা যা অনেকটাই পূরণ করে।
বর্তমানে অধিক রাসায়নিক সার ব্যবহারের ফলে জমির উর্বরতা হারিয়ে যাচ্ছে। ফলে অনেকে এই রাসায়নিক সার ব্যবহার করতে অনাগ্রহ প্রকাশ করছেন। যে কারণে দেশে এখন জৈব সারের চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। জৈব সার ব্যবহারের ফলে মাটির কোনো ধরনের গুণাগুণ নষ্ট হয় না। মেলায় এমনই জৈব সার নিয়ে এসেছে ডায়মন্ড গ্রুপ।
ডায়মন্ড গ্রুপের সিনিয়র রিজিওনাল ম্যানেজার শহিদুল ইসলাম বলেন, আমাদের প্রধান প্রোডাক্ট হচ্ছে ডিম। কিন্তু এর পাশাপাশি জৈব সারও তৈরি করা হচ্ছে। আর এই জৈব সার তৈরির প্রক্রিয়াটি হচ্ছে, আমাদের বাণিজ্যিক লেয়ার ফার্মে পালনকৃত লেয়ার মুরগির বিষ্ঠা সংগ্রহ করি। তার সাথে কাঠের গুঁড়া, ছাই এবং বিভিন্ন কার্যকরী অনুজীব একত্রে মিশিয়ে ব্যাকটেরিয়া এবং ছত্রাক দ্বারা বায়বীয় পচন প্রক্রিয়ায় করা হয়। তারপর সম্পূর্ণ অটোমেটিক স্কলারি এজিটেটর মেশিনের মাধ্যমে পচে যাওয়া জৈব পদার্থ দিয়ে ডায়মন্ড জৈব সার তৈরি করা হয়।
তিনি বলেন, আর এবারের মেলাটাকে আমরা মূলত ব্যবহার করছি জৈব সারের লঞ্চিং প্রোগ্রাম হিসেবে। আমাদের জৈব সার ব্যবহারে একই মাটিতে বহুবার চাষ করা যায়। কিন্তু রাসায়নিক সার ব্যবহারের ফলে এক থেকে দুই বার ফলনের পর সে মাটিতে আর কোনো কিছু চাষাবাদ করা যায় না। মূলত যারা ছাদ বাগান করে এ ধরনের ক্রেতারাই এই সার বেশি সংগ্রহ করছেন। আগামী দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে দেশের বেশির ভাগ কৃষক জৈব সার ব্যবহারে বেশি আগ্রহী হবে।
অন্যদিকে দেশে অনেক প্রান্তিক খামারি জানেন না যে, শেডের ভেতর ভার্টিক্যাল খাচায় (টেকনো কেস) বাণিজ্যিকভাবে পোল্ট্রি খামার করা যায়। ভার্টিক্যাল খাচার মাধ্যমে একজন খামারি সম্পূর্ণ সয়ংক্রিয়ভাবে মুরগি পালন থেকে শুরু করে খাবার দেওয়া, মুরগিকে পানি খাওয়ানো এবং খামারের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন। মেলায় ভার্টিক্যাল কমার্শিয়াল লেয়ার কেস বা খাচা নিয়ে এসেছে এজিসিও অ্যাগ্রো কোম্পানি।
প্রতিষ্ঠানটির সার্ভিস ইঞ্জিনিয়ার আশিকুর রহমান বলেন, এই টেকনো কেসটি ইতালি থেকে আমদানি করা। দুই ফুট বাই দুই ফুট খাচার মধ্যে ৯টি করে মুরগি পালন করা যাবে। এখানে খাবার এবং পানীয় স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা করা। এই খাচার প্রতি দুই ফুট বাই দুই ফুটের জন্য খরচ হবে ৫ ডলার করে। এই মেশিন সম্পূর্ণ গ্যালভানাইজ করা, যা দশ বছর ব্যবহারেও কোনো প্রকার হাত দিতে হবে না।
পোল্ট্রি প্রদর্শনীতে আধুনিক টেকনোলজি নিয়ে এসেছে অনেক কোম্পানি। সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তি ও কাঁচামাল ব্যবহার করে ডিম থেকে বাচ্চা তোলার যন্ত্র ইনকিউবেটর নিয়ে মেলায় এসেছে দ্য সাডেন লিংক ইনকিবিউট। এর স্বত্বাধিকারী শহীদুল হক বাপ্পী হাজারী ইনকিউবেটর মেশিনটি নিজেই তৈরি করেছেন।
বাংলানিউজকে তিনি বলেন, বাংলাদেশের যারা ইনকিউবেটর মেশিন তৈরি করে আসছে তাদের সকলের মধ্যে আমরা সবচেয়ে পুরাতন এবং প্রথম। ১৯৯৭ সাল থেকে আমি ইনকিউবেটর বানিয়ে বাজারজাত করছি। অন্যান্য কোম্পানির ইনকিউবেটরে দেখা যায়, বেশির ভাগ জিনিসপত্র বাংলাদেশের থাকলেও প্রযুক্তিটা থাকে চায়নার বা অন্য দেশের। তবে আমার তৈরি করা ইনকিউবেটরে যে কন্ট্রোলার ব্যবহার হয়, সেটা আমি নিজেই কোডিং করে বানিয়েছি। দেশের প্রতিটি জেলাতেই আমাদের ইনকিউবেটর আছে।
তিন দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক পোল্ট্রি শো যৌথভাবে আয়োজন করেছে ওয়ার্ল্ড’স পোল্ট্রি সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ শাখা (ওয়াপসা-বিবি) এবং বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল (বিপিআইসিসি)। বাংলাদেশসহ বিশ্বের ২০টি দেশের ২৫০টি প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৫০০টির অধিক স্টল এবারের পোল্ট্রি শোতে অংশ নিয়ে।
আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে এবারের পোল্ট্রি শো ও সেমিনারটি অনেক বেশি তাৎপর্যময় এবং জাঁক-জমকপূর্ণ হয়েছে বলে মনে করছে আয়োজক সংগঠনগুলো।
বাংলাদেশ সময়: ১৯০৪ ঘণ্টা, মার্চ ১৮, ২০২৩
ইএসএস/এমজেএফ