ঢাকা: ২০২১ সালের মধ্যে দেশকে মধ্যম আয়ের দেশে কিংবা ২০৪১ সালের মধ্যে দেশকে উন্নত দেশের কাতারে উন্নীত করতে সবার প্রথমে নিশ্চিত করতে হবে টেকসই জ্বালানি নিরাপত্তা। আর এর জন্য গুরুত্ব দিতে হবে ‘প্রাইমারি ফুয়েল সোর্সিং’ এর ওপর।
সম্প্রতি এক সেমিনারের আলোচনায় উঠে এলো আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের এমনই মতামত। বাংলানিউজের কনফারেন্স রুমে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হয় ‘চ্যালেঞ্জেস অব মেগা ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইমপ্লিমেন্টেশন’ শীর্ষক সেমিনার।
পদ্মা সেতু, গভীর সমুদ্রবন্দর সহ সরকারের প্রণীত উন্নয়নকল্পগুলো বাস্তবায়নের পথে বাধাগুলো কি কি এবং সে সব বাধা উত্তরণে প্রয়োজনীয় কর্মপন্থার নানা দিক সেমিনারে পাওয়ার পয়েন্ট প্রজেকশনের মাধ্যমে তুলে ধরেন আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ার মোনাশ ইউনিভার্সিটির প্রজেক্ট ম্যানেজার প্রকৌশলী খন্দকার সালেক সূফী।
শনিবার (২৮ জানুয়ারি) বেলা এগারোটার দিকে শুরু হওয়া এই সেমিনারের আলোচনায় আরও অংশ নেন ‘বাখরাবাদ-সিদ্ধিরগঞ্জ গ্যাস পাইপলাইন নির্মাণ’ প্রকল্পের পরিচালক আয়নুল কবির, বাংলানিউজের হেড অব নিউজ মাহমুদ মেনন খান, আউটপুট এডিটর জাকারিয়া মন্ডল, সালাহউদ্দিন আহমেদ সহ অন্যান্য সাংবাদিকরা।
মধ্য ও উচ্চ আয়ের দেশে উন্নীত হতে আগামী কয়েক দশকে জ্বালানি খাতের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং বিষয় বলে উঠে আসে সেমিনারের আলোচনায়।
এ ব্যাপারে মূল আলোচক সালেক সূফী বলেন, বাংলাদেশের বর্তমান প্রবৃদ্ধি ছয় থেকে সাড়ে ছয় শতাংশ। কিন্তু দেশকে ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যে মধ্যম আয় এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উচ্চ আয়ের দেশে পরিণত করতে হবে প্রবৃদ্ধি হতে হবে কমপক্ষে দশ শতাংশ। আর প্রবৃদ্ধি দশ শতাংশে নিতে হলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই বাংলাদেশকে কমপক্ষে ২৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। এই বিপুল বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজন নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহের নিশ্চয়তা।
অথচ এই জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতে এখনও মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ। এজন্য দেশে বিদেশে জ্বালানির উৎস খুঁজে বের করতে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে এখনই। বিদেশের পাশাপাশি দেশেও জ্বালানির বিভিন্ন খাত অনুসন্ধান করতে হবে। খুঁজতে হবে নতুন গ্যাস ক্ষেত্র। তুলতে হবে মাটির নিচে থাকা কয়লাও। এছাড়া পরমাণু বিদ্যুৎ প্রকল্পও হতে পারে টেকসই জ্বালানির উৎস।
এ ব্যাপারে সালেক সূফী বলেন, কুইক রেন্টাল প্রজেক্ট দিয়ে হয়তো আপাততভাবে দেশের জ্বালানি সঙ্কট সামাল দেয়া যাবে কিন্তু ভবিষ্যতের কথা ভেবে এখনই বিদ্যুৎ খাতে কয়লা ও পরমাণু শক্তি ভিত্তিক মেগা প্রজেক্ট হাতে নিতে হবে।
এসব প্রজেক্ট বাস্তবায়নের জন্য গভীর সমুদ্রবন্দর সহ অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণও দ্রুত এগিয়ে নেয়ার ব্যাপারে মত দেন তিনি।
বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান জ্বালানি উৎস প্রাকৃতিক গ্যাস। বাংলাদেশ গ্যাসের ওপর ভাসছে এক সময় ইত্যাদি কথা বলা হলেও, উপযুক্ত অনুসন্ধানের অভাবে দ্রুত ফুরিয়ে আসছে গ্যাসের মজুদ। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন ২০২৫ সর্বোচ্চ ২০৩০ সালের মধ্যেই ফুরিয়ে যাবে দেশের বর্তমান মজুদ।
এ ব্যাপারে সালেক সুফী বলেন, দেশের একমাত্র বিবিয়ানা গ্যাস ক্ষেত্রে থেকেই মোট চাহিদার ৫০ ভাগ আসছে। কোনো কারণে এই গ্যাসক্ষেত্র বসে গেলে কিংবা অন্য কোনো কারণে সেখান থেকে গ্যাস সরবরাহ বিঘ্নিত হলে দেশের সম্পূর্ণ গ্যাস সরবরাহ নেটওয়ার্কই বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে ।
অদূর ভবিষ্যতেই দেশ ভয়াবহ গ্যাস সঙ্কটে পড়তে যাচ্ছে উল্লেখ করে সালেক সূফী বলেন, বর্তমানে দেশে যে পরিমাণ গ্যাস মজুদ আছে তা দিয়ে ২০২৫ সাল পর্যন্ত চলতে পারে।
অথচ দেশে আরও গ্যাস ক্ষেত্র থাকার সম্ভাবনার কথা জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা, যেগুলো এখনও রয়ে গেছে অনাবিষ্কৃত। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন দেশের ভূগর্ভে এখনও প্রচুর গ্যাস রয়েছে। সঠিকভাবে অনুসন্ধান করলে আরও কমপক্ষে ১০ টিসিএফ গ্যাসের মজুদ আবিষ্কৃত হতে পারে।
এ ব্যাপারে সালেক সূফী বলেন, বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক জোন থেকে শুরু করে দেশের মাটির নিচে এখনও প্রায় ১০ টিসিএফ গ্যাস থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। শুধু প্রয়োজন সেগুলো অন্বেষণের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ। এজন্য তিনি বাপেক্স ও পেট্রোবাংলাকে আরও শক্তিশালী করার পক্ষে মতামত দেন।
মূলত প্রয়োজনীয় ব্যবহারের থেকে অপ্রয়োজনীয় ব্যবহারই হয়েছে দেশের প্রাকৃতিক গ্যাস সম্পদের। বসতবাড়িতে পাইপলাইনে গ্যাস সরবরাহ কিংবা গণহারে দেশের সব পরিবহণে রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহও ছিলো ভুল একটি সিদ্ধান্ত । সস্তায় গ্যাস পাওয়ার সুবিধার কারণে ঢাকা শহরে ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা বেড়ে গেছে বহুগূণ, ফলাফলে বেড়েছে যানজট। অথচ গ্যাসের অভাবে বর্তমানে উৎপাদন বন্ধ করে বসে আছে অনেক কারখানা।
এ ব্যাপারে সালেক সুফী বলেন, পাইপ লাইন দিয়ে বাসা বাড়িতে গ্যাস সরবরাহ ভুল সিদ্ধান্ত। তাছাড়া এটি বৈষম্যজনকও বটে। দেশের সুবিধাভোগী শহুরে মানুষই পাচ্ছে এর সুযোগ। অথচ বঞ্চিত থাকছে দেশের বেশিরভাগ মানুষ, যাদের অধিকাংশই দরিদ্র।
বাসা বাড়িতে রান্নার জন্য পাইপ লাইনে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে এলপিজি সিলিন্ডার ব্যবহারের পক্ষে মত দেন তিনি। পাশাপাশি যানবাহনে ব্যাপক ও গণহারে সিএনজি সরবরাহেরও সমালোচনা করেন তিনি।
এছাড়া দেশের জ্বালানি খাতের নিরাপত্তা নিশ্চিতে প্রয়োজন উপযুক্ত দেশীয় প্রফেশনাল। যারা বিদেশি কোম্পানি ও সরকারগুলোর সঙ্গে দর কষাকষিতে রাখবেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
এ ব্যাপারে সালেক সূফী বলেন, জ্বালানি খাতে দক্ষ প্রফেশনাল তৈরি করতে হবে। উপযু্ক্ত ও দেশপ্রেমিক জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও প্রফেশনাল ছাড়া আন্তর্জাতিক তেল গ্যাস কোম্পানিগুলোর সঙ্গে দরাদরিতে সুবিধা করে উঠতে পারবে না বাংলাদেশ। কারণ জ্বালানি মন্ত্রণালয়ে এবং জ্বালানি বিষয়ে সরকারের পরামর্শক হিসেবে যারা কাজ করেন তাদের বেশিরভাগেরই জ্বালানি খাতে উপযুক্ত অভিজ্ঞতার অভাব রয়েছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশি মেধাবী ছাত্রদের বৃত্তি দিয়ে প্রয়োজনে বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়তে পাঠানোর কথা বলেন তিনি।
সালেক সুফি বলেন, বড় বড় প্রজেক্ট করে কোনো লাভ হবে না যদি না এগুলো চালানোর মত বাংলাদেশি প্রফেশনাল না থাকে। এক্ষেত্রে দেশের গার্মেন্টস খাতের উদাহরণ দেন তিনি। তিনি বলেন, গার্মেন্টস কারখানার মালিকরা যোগ্য বাংলাদেশি প্রফেশনাল না থাকায় গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে বিদেশিদের উচ্চ বেতনে নিয়োগ দিতে বাধ্য হচ্ছেন। একই পরিস্থিতি দেশের জ্বালানি খাতেও। এজন্য দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্বালানি, খনি ও পেট্রোলিয়াম সংশ্লিষ্ট বিভাগ খোলার পরামর্শ দেন সালেক সুফী।
দেশের জ্বালানি খাতের সমস্যা ও সম্ভাবনার নানা বিষয়ে দায়িত্ব রয়েছে সংবাদ মাধ্যমেরও। জ্বালানি খাতের বিভিন্ন দুর্বলতা লেখনীর মাধ্যমে সরকার ও জনগণের সামনে তুলে ধরতে পারেন সাংবাদিকরা। এর জন্য জ্বালানি খাতের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সম্যক ধারণা রাখতে হবে সাংবাদিকদেরও।
এ ব্যাপারে সালেক সূফী বলেন, দেশের জ্বালানি নীতি কি হবে সে ব্যাপারে সংবাদমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এজন্য সংশ্লিষ্ট সাংবাদিকদের আরও বেশি করে জ্বালানি খাত সংক্রান্ত বিষয়গুলো চর্চার আহ্বান জানান তিনি।
বাংলাদেশ সময়: ১৪৩৪ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১, ২০১৬
আরআই/