সাভার-আশুলিয়া ঘুরে: ব্রয়লার-লেয়ার মুরগির ছোট বাচ্চা ও পোল্ট্রি ফিডের হঠাৎ চড়া দামে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন খামারিরা। ফলে ব্যহত হচ্ছে মাংস ও ডিম উৎপাদন।
সাভার ও আশুলিয়া ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে।
মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে ব্রয়লার ও লেয়ারের ছোট বাচ্চার দাম বেড়েছে। সঙ্গে বেড়েছে মুরগির খাদ্যের দামও।
সাভারের আউকপাড়ার লেয়ার মুরগির খামারি আনিসুর রহমান। প্রায় ৮ বছর ধরে এ ব্যবসায় জড়িত তিনি। কিন্তু লেয়ারের(ডিম উৎপাদনকারী মুরগি) ছোট বাচ্চার দাম প্রতিনিয়ত বৃদ্ধির কারণে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন তিনি। এছাড়া ছোট মুরগির বাচ্চা সঙ্কটের কারণে খামারে মুরগির ডিম উৎপাদনও ব্যহত হচ্ছে বলে জানান তিনি।
আনিসুর রহমানের আয়শা পোল্ট্রি ফার্মে সাড়ে তিন হাজার মুরগি রয়েছে। প্রতিদিন গড়ে দেড় হাজার থেকে ১৬শ’ ডিম উৎপাদিত হয়। প্রতিটি ডিম বিক্রি হয় ৭ টাকা ২৫ পয়সা দরে। সাড়ে তিন হাজার মুরগির জন্য প্রতিদিন ৭ বস্তা( প্রতি বস্তা ৫০ কেজি)খাবারের প্রয়োজন পড়ে।
বাচ্চার বয়স পাঁচ মাস হওয়ার পর ডিম দেয়। প্রায় দেড় বছর একটি মুরগি ডিম দেয়।
৭০ টাকা দরের লেয়ারের বাচ্চা সপ্তাহের ব্যবধানে ৯০ টাকা হয়েছে। এছাড়া অনেক সময় বাচ্চা হ্যাচারিতে পাওয়া যায় না। একশ’ টাকা বাড়তি দিয়ে ৫০ কেজি লেয়ার খাবার দেড় হাজার টাকায় কিনতে হচ্ছে।
আয়শা পোল্ট্রি ফার্মের মালিক আনিসুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, একমাসের ব্যবধানে প্রতিটা বাচ্চার দাম ২০ টাকা করে বাড়ছে। যারা(হ্যাচারি) বাচ্চা উৎপাদন করছে তারাই খাবার দিয়ে বসে থাকছে। অনেক সময় বেশি দাম দিয়ে ভালো বাচ্চা মেলে না।
অন্যদিকে সাভার ও আশুলিয়ার পোল্ট্রি খামারিরা উভয় সঙ্কটে পড়েছেন। পোল্ট্রি খাবার ও বাচ্চার দাম দুটোই চড়া। এতে করে অনেকে খামারি পোল্ট্রি খামার বন্ধ করে দেওয়ার পরিকল্পনাও কষে ফেলেছেন। এক মাসের ব্যবধানে প্রতিটা পোল্ট্রি মুরগির বাচ্চায় ২৩ টাকা বেড়ে ৫৬ টাকায় কিনতে হচ্ছে। অন্যদিকে প্রতি বস্তা(৫০ কেজি) খাবারে ২০০ টাকা বেড়ে হয়েছে ২২শ’ টাকা।
সাভারের বিরুলিয়া ইউনিয়নের আইঠর এলাকার টাটা গরু ও পোল্ট্রি কৃষি ফার্ম। এখানে পোল্ট্রি মুরগির মাংস উৎপাদনের জন্য মোট চারটি ইউনিট রয়েছে। কিন্তু বাচ্চা ও খাবারের দাম বৃদ্ধির কারণে এখানে একটি মাত্র ইউনিটে ১৭শ’ মুরগির বাচ্চা তোলা হয়েছে। বাকিগুলো রয়েছে বন্ধ।
৮ দিন বয়সী ১৭শ’ বাচ্চার দৈনিক ৬৫ কেজি খাবারের প্রয়োজন পড়ে। নবম দিনে ৭০ কেজি। এমন করে ২০ দিন পযর্ন্ত এ বাচ্চাগুলোর জন্য প্রতিদিন ৫ কেজি করে অতিরিক্ত খাবার দরকার হবে। বাচ্চার বয়স ২০ দিন পার হলে ৮ থেকে ৯ কেজি খাবার অতিরিক্ত লাগবে। প্রতিটি বাচ্চা ৩০ দিন পার হলে এক কেজি ৭০ থেকে ৮০ গ্রাম ওজনে বিক্রি করা হয়।
খামারিরা অভিযোগ করে বলেন, কয়েক মাস ধরে খামার থেকে প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি ১২০ থেকে ১২৪ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। অথচ বেড়েই চলেছে ব্রয়লার মুরগির বাচ্চা ও খাবারের দাম।
সাভারের টাটা গরু ও পোল্ট্রি কৃষি ফার্মের ম্যানেজার জাকির হোসেইন বাংলানিউজকে বলেন, ‘কোম্পানি প্রতি মাসেই ব্রয়লার মুরগির বাচ্চা ও খাবারের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। যে কারণে আমার চারটি ইউনিটের মধ্যে একটি চালু রেখেছি। দাম না কমলে পরের চালানে এটাও বন্ধ করে দেবো। বড় বড় কোম্পানি নিজেই খামার দিয়ে রেখেছে। যেন আমরা খাবারগুলো বন্ধ করে দেই, সেজন্য বিনা কারণে বাচ্চা ও খাবারের বাড়তি দাম রাখা হয়। সরকারের কাছে অনুরোধ, আমাদের বাঁচানোর জন্য পোল্ট্রি মুরগির খাবার ও ব্রয়লারের বাচ্চার দাম চূড়ান্ত করে দিক’।
ব্রিডার্স অ্যাসোসিয়েশনের এক তথ্যে দেখা গেছে, একদিন বয়সী একটি মুরগির বাচ্চার সাপ্তাহিক চাহিদা এক কোটি পিস। অথচ উৎপাদিত হচ্ছে এক কোটি ৫ লাখ পিস। চাহিদার চেয়ে উৎপাদন বেশি হলেও প্রতিনিয়তই বেড়ে চলেছে মুরগির বাচ্চার দাম।
মুরগির মাংসের দৈনিক চাহিদা ১ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন। অথচ উৎপাদিত হয় এক হাজার ৬০০ মেট্রিক টন। ডিমের দৈনিক চাহিদা এক কোটি ৬০ লাখ পিস, সেখানে দৈনিক উৎপাদন হয় এক কোটি ৭০ লাখ পিস। বর্তমানে সারাদেশে প্রায় ৬৫-৭০ হাজার ছোট-বড় খামার রয়েছে। বাচ্চা ও খাবারের দাম কমে গেলে উৎপাদন কমিয়ে দিতে পারেন খামারিরা।
অন্যদিকে বাংলাদেশ পোল্ট্রি শিল্প সমন্বয় কমিটি(বিপিঅাইসিসি) জানায়, ছোট বাচ্চার উৎপাদন কমেনি। কিন্তু হঠাৎ করে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় সাত দিনের ব্যবধানে বেড়েছে বাচ্চার দাম। তবে যা এক বছরের মধ্যে এতো বেশি দাম ছিল না। তবে কিছুদিন পর কমে যাবে ছোট বাচ্চা ও খাবারের দাম।
দাম বৃদ্ধি প্রসঙ্গে বিপিআইসিসি’র সমন্বয়ক মশিউর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, ‘ছোট বাচ্চার উৎপাদন কমে নাই। চাহিদার চেয়ে ৪ থেকে ৫ লাখ বাচ্চা অধিক তৈরি করা হচ্ছে। কিন্তু চলতি সপ্তাহে হঠাৎ করে চাহিদা বাড়ায় দাম বেড়েছে। তবে কিছুদিন গেলে আবারও স্বাভাবিক হয়ে যাবে। এখন বাচ্চা যে দামে বিক্রি হচ্ছে গত এক বছর এতো বেশি দাম ছিল না’।
খাদ্যের দাম বৃদ্ধি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমরা তো তাদের(খামারি) কেনা খাবার খাওয়াতে বলছি না। তারা(খামারি) ইচ্ছা করলেই গম ও ভূট্টা দিয়ে খাবার তৈরি করে খাওয়াতে পারেন’।
বাচ্চা ও খাদ্যের অতিরিক্ত দামে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন খামারি- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সারা বছর তারা (খামারি) কম দামে মুরগির বাচ্চা কিনেছেন, তখন কোনো কথা হয়নি। খামারিরা কাউকে বলেননি যে, কম দামে বাচ্চা কেনা হচ্ছে। সপ্তাহখানেক হলো বাচ্চার দাম বেড়েছে, এতেই তারা সমস্যার কথা বলছেন। এসব কথা খামারিরা বলেই থাকেন’।
বাংলাদেশ সময়: ০৭৪৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১০, ২০১৬
এমআইএস/এএসআর