ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিক্ষা

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককে আটকে ইউপি চেয়ারম্যানের নির্যাতন

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৪৪ ঘণ্টা, মে ৬, ২০২৩
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককে আটকে ইউপি চেয়ারম্যানের নির্যাতন অভিযুক্ত চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ্ আল মাহমুদ, নির্যাতনের শিকার প্রফেসর নজরুল ইসলাম (বাঁ থেকে)

খুলনা: খুলনার কয়রায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের প্রফেসর নজরুল ইসলামকে আটকে রেখে তার ওপর নির্মম নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে মহারাজপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ্ আল মাহমুদের বিরুদ্ধে।  

শুক্রবার (৫ মে) সন্ধ্যায় কয়রা উত্তরচক আমিনিয়া বহুমুখী কামিল মাদরাসার সামনে ওই প্রফেসরের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে।

এরপর তাকে মারধর করে একটি বাড়ির ভেতরে নিয়ে আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়।  

ঘটনার পর এদিন রাত ১০টায় মুমূর্ষু অবস্থায় প্রফেসর নজরুল ইসলামকে কয়রা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য পুলিশ পাহারায় গভীর রাতে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।

কয়রা উত্তরচক আমিনিয়া বহুমুখী কামিল মাদরাসা অধ্যক্ষ নিয়োগকে কেন্দ্র করে এ নির্যাতনে ঘটনা ঘটে বলে জানা গেছে।

অভিযুক্ত আব্দুল্লাহ্ আল মাহমুদ ওই মাদরাসার ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি। এছাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদকও তিনি।

অভিযোগ, ফেল করার পরও নিজের পছন্দের প্রার্থীকে পাশ মার্ক দিয়ে চাকরি পাইয়ে দিতে জোরজবরদস্তি করেন আব্দুল্লাহ্ আল মাহমুদ। সে কথা না মানায় ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির প্রতিনিধি হিসেবে সেখানে দায়িত্বে থাকা প্রফেসর নজরুল ইসলামের ওপর হামলা চালান মাহমুদ। এবং জোর করে নিয়োগপত্রে প্রফেসর নজরুলের স্বাক্ষর নেন তিনি।  

শনিবার (৬ মে) সকালে আহত প্রফেসর নজরুল ইসলাম বাংলানিউজকে এসব অভিযোগ করেন।  

তিনি বলেন, কয়রা উত্তরচক আমিনিয়া বহুমুখী কামিল মাদরাসা অধ্যক্ষ নিয়োগ নিয়ে জটিলতা চলছিল। তারপরও আমরা চেষ্টা করছিলাম যাতে স্বচ্ছ নিয়োগ দিতে পারি। ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির প্রতিনিধি হিসেবে ওখানে গিয়ে ২টার সময় লিখিত পরীক্ষা নেওয়া শুরু করি। এরপর ভাইবা নিয়ে খাতা দেখি। মাদরাসার ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি মাহমুদ চেয়ারম্যান আমাকে বার বার একটা খাতা নিয়ে বলছিলেন, এটা আমার কেন্ডিডেট। লিখিত পরীক্ষার সময় তিনি চেষ্টা করেন তার প্রার্থীকে সাহায্য করতে। তাকে বললাম, আপনি এলাকার জনপ্রতিনিধি একটু শান্ত থাকেন। আমরা যখন খাতা দেখি একটা কোড মেনটেইন করি যাতে কোন খাতা কার সেটা না বুঝতে পারি। সেখান থেকে তিনি একটি খাতা দেখিয়ে বলেন, এটা তার প্রার্থীর খাতা। এটা যেন খেয়াল রাখি। আমার সঙ্গে মাদরাসা বোর্ডের ডাইরেক্টর জিয়াউল আহসান ছিলেন। যখন ভাইবা নিচ্ছিলাম তখন চেয়ারম্যান ডাইরেক্টর স্যারকে বলেন, তার প্রার্থীকে ৮ এর মধ্যে ৭ দেওয়া যায় কি না। তখন ডাইরেক্টর স্যার বলেন, না যায় না তবে আপনি বললে ৬ দিতে পারি।  

প্রফেসর নজরুল বলেন, লিখিত পরীক্ষায় ১৪ জনের মধ্যে ৬ জন পরীক্ষা দেয়। সবাই ফেল করে, ৩০ এর মধ্যে পাস মার্ক ১২ কেউ পাননি। তখন ডাইরেক্টর স্যার বললেন ৩ জন পাস না করলে পরীক্ষা বাতিল করতে হবে। এসময় চেয়ারম্যান ৩টি খাতা নিয়ে বলেন, আমরা লিখে দিই। আমি বলি এটা হয় না। এমনিতে এখানে নানা অভিযোগ, বাইরে পুলিশ, শতশত মানুষ সাংবাদিক তার মধ্যে আপনি এ ধরনের প্রস্তাব দেন। এটা করা যাবে না। তখন আমরা যে রুমে ছিলাম তার দরজা বন্ধ করে দেন তিনি।

আহত প্রফেসর আরও বলেন, মাদ্রাসার যিনি প্রিন্সিপাল হতে চান তিনি বর্তমান ভাইস প্রিন্সিপাল। তিনি এ পর্যায় আমার পায়ে ধরে বসলেন। আমি অস্বস্তিকর পরিস্থিতি থেকে একটু স্বাভাবিক হতে রুম থেকে বের হয়ে বাইরে বাতাসে হাঁটাচলা করি। তখন ডাইরেক্টর স্যার বলেন, এখানে আর থাকা যায় না চলেন চলে যাই। এ সময় চেয়ারম্যান এসে বিভিন্ন হুমকি-ধামকি দিচ্ছেন। ডাইরেক্টর স্যারের প্রাইভেটকারের সামনে ডাইরেক্টর স্যার বসলেন। পেছনে আমি ও চেয়ারম্যান। সঙ্গে যে পুলিশ ফোর্স ছিল না এটা খেয়াল করিনি। সভাপতি আমাকে আঘাত করে মোবাইল ফোন নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। চেয়ারম্যানের বাড়ির একটু সামনে গাড়ি থামায়। যেখানে আগে থেকে ২০-৫০ জন লোক ছিল। সেই লোকজন গাড়ির দরজা খুলে আক্রমণ করে আমাকে। মোবাইল ফোন নিয়ে যায়। বাড়ির ভেতর নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে তারা। আমি একটি খুঁটি ধরে রাখতে চেষ্টা করি।

কিন্তু তারা আমার হাতে এত মারে যে আর শক্তি রাখতে পারিনি। ডাইরেক্টর স্যার অনেক চেষ্টা করেছিলেন আমাকে রক্ষা করতে। কিন্তু চেয়ারম্যান বলেন, ওকে দেখিয়ে দেব নিয়োগ দিতে এসে নিয়োগ দেবে না কেন? আমাকে মাটিতে ফেলে রাখে। জ্ঞান ফিরে দেখি সন্ধ্যা হয়ে গেছে। একপর্যায় আমি চিৎকার করি ওরা আমার মুখে গামছা বেঁধে রাখে। আমি প্রেশার হাই হয়ে যায় এ সময়। ডাক্তার এনে আমাকে প্রেশার ও ডায়বেটিকসের ওষুধ খাওয়ানোর চেষ্টা করে। আমি ওষুধ খাইনি। এর মধ্যে তারা বার বার চেষ্টা করে স্বাক্ষর নিতে, না দিলে মেরে ফেলবে। একপর্যায় আমার ওপর পিস্তল ও ছুরি ঠ্যাকায় তারা। রাত ৮টার দিকে কয়রা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক আসেন। তিনি বলেন, ওনাকে হাসপাতালে নিয়ে না গেলে মরে যাবে। তখন আমি জোরে জোরে আমার স্ত্রীর নাম্বার বলতে থাকি। ওই ডাক্তার মোবাইল নিয়ে বের হয়ে আমার স্ত্রীকে ফোন দেন। আমার আঙুল ব্যথা থাকায় নিয়োগপত্রে সই দিতে পারছিলাম না। ওরা বরফ এনে হাতে দেয়। ব্যাথা কমলে ৪-৫ টা কাগজে সই নেয়। সই নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে করে কয়রা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পাঠিয়ে দেয়। ওইখান থেকে ডাক্তারদের সহযোগিতায় সবাইকে বিষয়টি জানাই। আমার সঙ্গে যারা ছিল তারা কেউ কাউকে বিষয়টি জানায়নি। আমি যখন সই করি তখন দেখি ওই নিয়োগপত্রে ডাইরেক্টর স্যারের সই রয়েছে। রাত আড়াইটার দিকে পুলিশ পাহারায় খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আমাকে আনা হয়।

মহারাজপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ তার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ অস্বীকার করেন।

খুলনা জেলা পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মাহবুব হাসান (বিপিএম) বাংলানিউজকে বলেন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের প্রফেসর নজরুল ইসলামকে পুলিশ পাহারায় শুক্রবার রাতে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনা হয়েছে। শিক্ষক অভিযোগ করলে আইনগত সকল পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

খুলনার জেলা প্রশাসক খন্দকার ইয়াসির আরেফীন বাংলানিউজকে বলেন, প্রফেসর নজরুল ইসলামের ওপর হামলার বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। বিষয়টি আমি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে জানিয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি হিসেবে তিনি এসেছেন। এ ঘটনার সুষ্ঠ তদন্তের ব্যবস্থা করা হবে।  

এলাকাবাসীর অভিযোগ, গত ৪ মে জয়পুর শিমলার আইট দারুচ্ছুন্নাহ দা‌খিল মাদ্রাসায় দুটি প‌দে নি‌য়োগ পরীক্ষা হয়। ওই মাদ্রাসার সভাপ‌তি আব্দুল্লাহ আল মাহমুদের স্ত্রী। তার স্ত্রী সভাপতি হলেও সার্বক্ষ‌ণিক নি‌জে উপ‌স্থিত ‌থে‌কে পছ‌ন্দের প্রার্থী‌দের নি‌য়োগ দেন। পরীক্ষা কে‌ন্দ্রে স্বদলব‌লে প্রভাব বিস্তার করায় অ‌ধিকাংশ প্রার্থীরা ভ‌য়ে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ ক‌রেন‌নি। নি‌য়োগ বো‌র্ডে কোন পদে না থাক‌লেও ক্ষমতার দাপ‌টে সব কিছু তি‌নি নিয়ন্ত্রণ ক‌রেন।

এরআগে, গত বছ‌রের ৯ ডি‌সেম্বর ‌বে-‌সিন-‌মিম বায়লারহারা‌নিয়া আলিয়া মাদরাসায় ৫‌টি প‌দে জনবল নি‌য়োগ দেওয়া হয়। ওই মাদরাসার ম‌্যা‌নে‌জিং ক‌মি‌টির বিদ‌্যুৎসাহী প‌দে র‌য়ে‌ছেন চেয়ারম‌্যান আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ। ওই মাদ্রাসায়ও সকল প‌দে তার পছ‌ন্দের প্রার্থী‌দের নি‌য়োগ দেওয়া হয়। আয়া প‌দে অপ্রাপ্ত বয়স্ক একজন‌কে নি‌য়োগ দেওয়া হ‌লে জনম‌নে নানা প্রশ্ন জন্ম দেয়। প‌রে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ ছাড়া ম‌রিয়াম না‌মে একজন‌কে আয়া প‌দে নি‌য়োগ দেওয়া হয় ব‌লে অভিযোগ র‌য়ে‌ছে।

এর আগে ২০২২ সালের ২১ মার্চ সন্ধ্যায় ইউপি সচিব ইকবাল হোসেনকে তার বাড়ি থেকে মোটরসাইকেলে করে তুলে নিয়ে পরিষদের কক্ষে আটকে চেয়ারম্যান ও তার লোকজন পিটিয়ে আহত করে। এ ঘটনায় ইউপি সচিব বাদী হয়ে তার বিরুদ্ধে মারধরের মামলা করেন। পরে মহারাজপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল মাহমুদকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

বাংলাদেশ সময়: ১২৪০ ঘণ্টা, মে ০৬, ২০২৩
এমআরএম/এসএএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।