ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিক্ষা

সংকট কাটেনি জাবির

সৈয়দ এলতেফাত হোসাইন, জাবি শিক্ষার্থী | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯২০ ঘণ্টা, জুন ২, ২০১২
সংকট কাটেনি জাবির

টানা পাঁচ মাস আন্দোলনের মুখে পতন হয়েছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) সাবেক উপাচার্য (ভিসি) শরিফ এনামুল কবিরের। প্রত্যেকেরই আশা ছিল, এই ভিসির পতন হলেই জাবি ক্যাম্পাস শান্ত হয়ে আসবে।

কারণ যারা শরিফ এনামুল কবিরের ছত্রছায়ায় নৈরাজ্যে লিপ্ত, তারা হয়তো ভেঙে পড়বে। ফলে আপাতত হলেও ক্যাম্পাস ঠাণ্ডা হবে।

অন্যদিকে যে সব শিক্ষক ভিসিকে রক্ষায় মাঠে নেমেছিলেন, তারাও হয়তো মাঠ ছেড়ে ক্লাস রুমে ফিরে যাবেন। আর যারা ভিসি পতনের আন্দোলন করছিলেন, তারাও আন্দোলন স্থগিত করে ক্লাস রুমে ফিরে যাবেন। শিক্ষার্থীরা নতুন ভিসির আশ্রয়ে আবার ক্যাম্পাসে নির্ভয়ে শিক্ষা-সংস্কৃতির চর্চা করতে পারবেন।  

কিন্তু ভিসি পতনের পর জাবি ক্যাম্পাসে উল্টো চিত্র দেখা গেল। এত দিন যারা আন্দোলনরত শিক্ষকদের দাবিকে অযৌক্তিক বলে ধর্মঘট চলার সময় ক্লাস নিতেন, ভিসির পক্ষে মৌন মিছিলের পাশাপাশি নিজেদের দায়িত্ববান বলে পরিচয় করাতে পরীক্ষা নিতেন, তারাই এখন আন্দোলনে নেমেছেন। কিন্তু তারা যে দাবি নিয়ে মাঠে নেমেছেন, তা নিতান্তই হাস্যকর। তাদের আন্দোলন কোনো প্রশাসনিক কর্মকর্তা বা বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনাকারী কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে নয়। তাদের আন্দোলন ভিসিবিরোধী আন্দোলনের আহ্বায়ক অধ্যাপক নাসিম আক্তারের বিরুদ্ধে। ‘সাবেক ভিসি অনেককে মেধার পরিবর্তে টাকা ও দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ দিয়েছেন’ অধ্যাপক নাসিম আক্তারের এমন বক্তব্যের বিরুদ্ধে তারা আন্দোলনে নেমেছেন। কিন্তু বিষয়টি এতটাই হাস্যকর যে, থলের বিড়াল বের হওয়ার পথে। আন্দোলনরত শিক্ষকরা “বিগত তিন বছরে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকবৃন্দ” নামে একটি প্লাটর্ফমও তৈরি করেছেন। এখন পর্যন্ত তারা কোনো দাবি উত্থাপন করেননি। তারা মূলত এই কথাটিরই প্রতিবাদ করছেন এবং বুঝাতে চাচ্ছেন, তারা টাকা বা দলীয় বিবেচনায় নয় বরং মেধার প্রমাণ দিয়েই শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। তাদের কেউ কেউ নিজেদের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে কৃতিত্বের সঙ্গে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন বলে দাবি করছেন। তাই নাসিম আক্তার হোসাইন নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের মেধাহীন ও টাকার বিনিময়ে নিয়োগ পেয়েছেন বলায় তাদের মানের অপমান হয়েছে বলে দাবি করে আন্দোলনে নেমেছেন। তবে ভিসি হিসেবে নিজ পদে টিকে থাকতে না পেরে নতুন শিক্ষকদের দিয়ে সাবেক ভিসি শরিফ এনামুল কবিরই যে এ আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তা অনেকাংশেই স্পষ্ট।

নাসিম আক্তার হোসাইন ২০১১ সাল থেকেই টাকা ও দলীয় বিবেচনায় অবৈধভাবে শিক্ষক নিয়োগের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে আসছেন। তাহলে ভিসি পতনের এতদিন পর কেন তাদের মাথায় এলো যে, নাসিম আক্তারের বক্তব্যে তারা অপমানিত হয়েছেন। নাকি এতদিন তারা বুঝতে পারেননি নাসিম আক্তারের বক্তব্য মানহানিকর। তারা এতদিন তো শুধু ভিসি পদত্যাগের দাবিকেই অযৌক্তিক বলে আসছিলেন, কোনদিন তো তাদের অপমানের কথা বলেননি! নাকি তাদের আশা ছিল ভিসি টিকে গেলে সুদে-আসলে পুষিয়ে নেওয়ার? কিন্তু যখন ভিসিকে টেকাতে ব্যর্থ হলেন, তখন নতুন একটি ইস্যু তৈরি করে বিশ্ববিদ্যালয়কে অস্থিতিশীল করে রাখার জন্যই এই আন্দোলন।

ড. তারেক শামসুর রেহমান স্যার তার একটি কলামে (অথ: ভিসি কাহিনী) এ বিষয়ে লিখেছেন যে, “... দুশ’ শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছেন, যাদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। তাদের অনেকেই ক্লাসে পাঠদান করতে পারেন না। এটা সর্বকালের রেকর্ড। ... যদিও মিছিল করে শিক্ষকরা এর প্রতিবাদ করেছেন, তারা নতুন উপাচার্যের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছেন। আশ্চর্যের বিষয়, ভিসিবিরোধী আন্দোলন যখন হচ্ছিল, তখন তারা এ প্রসঙ্গে কোন কথা বলেননি! অধ্যাপক নাসিম আক্তারের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ (শিক্ষকদের অযোগ্য বলার), তা এর আগেও পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। তখন এরা কেউ প্রতিবাদ করেনি। ”  
গত ২৫ মে নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকরা তাদের মানহানি করায় অধ্যাপক নাসিম আক্তারের বিরুদ্ধে ১০ দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করে একটি লিফলেট বিলি করেছেন, যাতে ৪ মে ও ১৮ মে এটিএন নিউজে টকশোতে নাসিম আক্তারের বক্তব্য ও ২১ মে প্রথম আলোয় দেওয়া তার এক বিবৃতির প্রতিবাদ করা হয়। কিন্তু প্রশ্ন একটাই, ৪ মে তিনি যে বক্তব্য দিলেন, তার প্রতিবাদ ১৮ ও ২১ তারিখের টকশো ও বক্তব্যের প্রতিবাদের সঙ্গে কেন। এই প্রতিবাদ তো অনেক আগেই করা উচিত ছিল। ৪ মে থেকে ১৭ মে ভিসির পদত্যাগের আগে অনেক নতুন শিক্ষকই তো ভিসির বাসা পাহারায় ছিলেন। গণমাধ্যম কর্মীরা তো তাদের পাশেই ছিলেন সংবাদের আশায়।   তখন কেন এর প্রতিবাদ করা হয়নি? আর ১৭ তারিখ ভিসির পদত্যাগের পরই কেন ১৮ তারিখের টকশোর সঙ্গে ৪ মের টকশোর প্রতিবাদ করা হলো? নাসিম আক্তার এসব টকশো ও বক্তব্যে যা বলছেন, তা পুরনো কথা। তাছাড়া নাসিম আক্তার তো এমন কেউ নন যে তার কথায় বিশ্ববিদ্যালয় চলে। তিনি তো কেবল একটি বিভাগের অধ্যাপক মাত্র। সুতরাং তার বক্তব্যের বিরুদ্ধে দশ দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করে পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণার তারিখ ঠিক করে বিশ্ববিদ্যালয়কে অস্থিতিশীল করার কোন মানে আছে কী?

এদিকে সরকার জাবির ভিসি নিয়োগ দেওয়ার ক্ষেত্রে যে কারিশমা দেখিয়েছে, তা রীতিমতই হতবাক হওয়ার মতো। সংকটাপন্ন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন একজনকে ভিসি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, যিনি জাবির অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত কিছুই জানেন না। আমি ভিসির মানের সমালোচনা করছি না, বরং যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা নানা দলে বিভক্ত, শিক্ষার্থীরা হুমকির সম্মুখীন, তখন অন্য জায়গা থেকে আসা একজন নতুন ব্যক্তি কিসের ওপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নেবেন। জাবিতে ভিসি হওয়ার মতো কেউ নেই, এমন তো নয়। তাহলে কেন সরকার সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে শতভাগ সফল হতে পরল না। সরকারের সফলতা তখনই পূর্ণ হতো, যখন ক্যাম্পাস থেকেই কাউকে ভিসি নিয়োগ দিয়ে সঠিক উপায়ে বিশ্বাবিদ্যালয় পরিচালনা করতে সক্ষম হতো।

এখানে একটি কথা সামনে এসছে, প্রত্যেক সরকারই তার পছন্দের লোককেই ভিসি হিসেবে নিয়োগ দিয়ে থাকে। ফলে পছন্দের লোক বসাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভিসি আনা হয়েছে। এখানেও সরকার প্রশ্নের সম্মুখীন, তাহলে কি জাবিতে সরকারের বিশ্বস্ত কোনো শিক্ষক নেই? যদি এমনই হয়, তাহলে যারা এখানে আওয়ামী পন্থী শিক্ষক হিসেবে পরিচিত, তারা কারা? নাকি তাদেরও জাবির ছাত্রলীগের মতো বিতর্কিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে।

ফলে নতুন ভিসিকে নিয়ে বিপাকে জাবি পরিবার। ভিসি নিজেও অস্বস্তিতে। জাহাঙ্গীরনগরের সব পক্ষ থেকে ভিসিকে লোক দেখানো ফুলেল শুভেচ্ছা দেওয়া হলেও কেউই অন্তর থেকে মেনে নিতে পারেনি। অন্যদিকে নতুন ভিসি নিয়োগের পরপরই সাবেক ভিসিপন্থী নামে চিহ্নিত নতুন শিক্ষকরা নয়া আন্দোলন শুরু করায় ভিসি সত্যিই বিপাকে। তিনি কার কথা রাখবেন, আর কার কথা ফেলবেন? সবাই তো তার জন্য সমান। তাই যে কোনো সিদ্ধান্ত নিতেই এখন তাকে দ্বি-দলীয় শিক্ষকদের উল্টা-পাল্টা মতামতের মুখে পড়তে হবে এবং যে কোনো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে তাকে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে, যা বিশ্ববিদ্যালয়কে সামনে নেওয়ার পরিবর্তে পিছনেই নিয়ে যাবে।

তাই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যে সংকট তৈরি হয়েছিল তা আজও কাটেনি। এই সংকট নিরসনে শিক্ষকদের উভয় পক্ষকেই সমাধানের পথে আসতে হবে। এক্ষেত্রে নতুনভাবে আন্দোলনরত শিক্ষকদের প্রতি অনুরোধ, আপনারা এক জন শিক্ষকের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে ১৫ হাজার শিক্ষার্থী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ঐতিহ্যকে ধ্বংস করবেন না। পাশাপাশি নতুন ভিসি স্যারের প্রতি অনুরোধ, জাবির সমস্যা সমাধানে কারও একপেশে কথায় কান না দিয়ে বিশ্ববিদ্যায়কে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সৎ সাহসই আমাদের কাম্য। আপনি যদি সঠিক পথে হাঁটেন, আপনার সঙ্গে থাকবে জাহাঙ্গীর নগরের ১৫ হাজার শিক্ষার্থী, যারা সর্বদাই অন্যায়ের পথে পাহাড়সম বাধা হয়ে দাঁড়ায়। আপনার আগমনও এমন একটি অন্যায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলনের ফসল। সুতরাং সত্য পথে আপনি একা নন। আপনার সঙ্গী হবে সত্যপ্রেমী প্রতিটি জীব।    

লেখক: শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, সাংবাদিক ও তদন্ত কর্মকর্তা: জাতীয় অপরাধ-পর্যবেক্ষণ (মানবাধিকার) ও আইনি সহায়তা সংস্থা।

বাংলাদেশ সময়: ১৮৪৪ ঘণ্টা, জুন ০২, ২০১২
সম্পাদনা: আহমেদ জুয়েল, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।