ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি): দেশব্যাপী চলমান নারী নিপীড়ন ও ধর্ষণের ঘটনায় নারী উপদেষ্টাদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক তাসনীম মাহবুব সিরাজ। একইসঙ্গে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদচ্যুতি চেয়েছেন তিনি।
রোববার (৯ মার্চ) বেলা ১১টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার সামনে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক আয়োজিত ‘নারীর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ’ সমাবেশে তিনি এসব জানান। সমাবেশের বক্তব্যে ধর্ষণের দৃষ্টান্তমূলক বিচার, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তা, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদচ্যুতি, ধর্ষণের পেছনের কারণসহ একাধিক বিষয় উঠে আসে।
সমাবেশে তাসনীম মাহবুব বলেন, নারী উপদেষ্টারা কোথায়? তারা তো স্বপ্রণোদিত হয়ে মামলা করতে পারেন। নারী বিচারক, আইনজীবীরা এটা করতে পারেন। কিন্তু কজন করছেন। নারী উপদেষ্টারা কী আদৌ আছেন? দেশে কী ঘটছে, ওনারা কী সে ব্যাপারে সচেতন? ওনারা তো এগিয়ে আসতে পারেন, সরকারকে চাপ প্রয়োগ করতে পারেন। কিন্তু সেরকম কোনো উদ্যোগ দেখছি না।
তিনি বলেন, অনেকে এখন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগ চাচ্ছেন। আমি চারমাস ধরে উনার পদত্যাগ চাচ্ছি। পদত্যাগ একটা সম্মানজনক প্রস্থানের উপায়। কিন্তু উনি সম্মানজনক কোনো কাজ করেননি; করছেনও না। আমি বারবার লিখছি, আমি উনার পদচ্যুতি চাই। এছাড়া আইন উপদেষ্টা; উনার ব্যাপারে যত কম বলা যায়, ততই ভালো। উনারা কী করছেন? আমরা একটা জবাবদিহিমূলক সরকার কেন পাচ্ছি না?
সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নারী শিক্ষার্থীকে হেনস্তার ঘটনায় তিনি বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন নারীকে হেনস্তা করার যে ঘটনা, সেটি আমাদের প্রক্টরের দেখা উচিত ছিল। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি যৌন নিপীড়ন বিরোধী সেল আছে। কিন্তু উনি তা করেননি। যখন কোনো শক্তিশালী পদে রাজনৈতিক বিবেচনায় পদ দেওয়া হয়, তখন এমনই হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক গীতি আরা নাসরীনের সভাপতিত্বে সমাবেশে আরও বক্তব্য দেন উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক কাজী মারুফুল ইসলাম, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ফাহমিদুল হক, অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রায়হান, কবি ও লেখক ফেরদৌস আরা রুমি, সাফওয়ান আদনান প্রমুখ। সমাবেশে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সামিনা লুৎফা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক কাজী মারুফুল ইসলাম বলেন, নারীর প্রতি সহিংসতা যখন ঘটে, এটা এত নিষ্ঠুর যে আমরা কেবল ওই ঘটনার বিচার চাই। কিন্তু কেন এ ধরনের অপরাধ ঘটছে, তাতে আমরা নজর দিই না। এর কারণ হলো রাজনীতি, বৈষম্যমূলক অর্থনীতি ও নিপীড়নমূলক মনস্তত্ব। জুলাইয়ের পরে আমরা যে নতুন যে নতুন রাজনীতির সম্ভাবনা দেখছি, তা কিন্তু আসেনি। এটি ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর কাছে বেদখল হয়ে যাচ্ছে।
কবি ও লেখক ফেরদৌস আরা রুমি বলেন, আমাদের অনেক ভালো ভালো আইন আছে। কিন্তু তার কার্যকারিতা নেই। গবেষণায় এসেছে, একটি ধর্ষণের বিচার হতে ১৩ থেকে ১৫ বছর লেগে যায়। আবার যে ধর্ষণ করেছে, তার সাথে বিয়ে দেওয়ার প্রবণতাও আছে। এ সময় তিনি মাগুরায় ধর্ষণের শিকার শিশুর কথা তুলে বলেন, আমরা জানি না সে বেঁচে থাকলে তার পরের জীবন কেমন হবে।
সাফওয়ান আদনান বলেন, আমাদের পরিবারের ভেতরে মেয়েদের আশ্রয়টা ভেঙে যাচ্ছে। আগেও যে তারা একেবারে নিরাপদ ছিল, তা নয়। তবে বিষয়টি খুব স্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে। এই সমস্যার শিকড় অনেক গভীরে। এরজন্য একদিকে আন্দোলন যেমন হবে, তেমনি মনোজগৎ পরিবর্তনের দিকেও নজর দিতে হবে।
অধ্যাপক গীতি আরা নাসরীন বলেন, পরিবার থেকে শুরু করে জনপরিসরে নারীদের ওপর যে নিপীড়ন, তা হঠাৎ করা হয়েছে বলার সুযোগ নেই। সমাজ এই নির্যাতনকে নরমালাইজ করে। নির্যাতন হচ্ছে একধরনের ক্ষমতার বিস্তার। আমাদের গৃহাভ্যন্তরে সবচেয়ে বেশি নির্যাতন হয়। নির্যাতন করে চুপ করিয়ে রাখতে চাওয়া হয়। নারীদেরকেই প্রশ্ন করা হয়, তারা কেন পথে বের হলো। এটা নির্যাতনকারীদের সাহস দেয়।
সমাবেশে আরও উপস্থিতি ছিলেন পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন, বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জোবাইদা নাসরীন, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কাজলী শেহরীন ইসলাম, সহকারী অধ্যাপক মার্জিয়া রহমান, সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের প্রাধ্যক্ষ আব্দুল্লাহ আল মামুন প্রমুখ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়, ইন্ডিপেন্ডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগাম বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা একইসাথে এই কর্মসূচি পালন করছেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৪৪০ ঘণ্টা, মার্চ ৯, ২০২৫
এফএইচ/এমজে