ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিক্ষা

সন্তানের সাফল্যে মায়ের সাহসী উদ্যোগ জরুরি

নুরুল ইসলাম নাহিদ, শিক্ষামন্ত্রী | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৪৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৪, ২০১৪
সন্তানের সাফল্যে মায়ের সাহসী উদ্যোগ জরুরি নুরুল ইসলাম নাহিদ

‘মা’ অতি ছোট্ট একটি শব্দ। পৃথিবীতে এটিই মধুরতম সম্বোধন।

সকল মা-ই সন্তানের কাছে পরম আপন, পরম শ্রদ্ধার। সকল সন্তানই তার মায়ের কাছে অতি আদরের ধন। এ এক অতুলনীয় ভালোবাসার সম্পর্ক। মা-বাবার সর্বাত্মক প্রত্যাশা সত্ত্বেও সকল সন্তান সুসন্তান হয় না, আবার সবাই দেশ-জাতি-সমাজের মাথাও হয় না। সন্তানকে উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে মায়েদের দূরদর্শিতা, সাহস, অসীম ত্যাগ আর কঠোর পরিশ্রম প্রয়োজন। এগুলো যারা করতে পারেন সমাজে তাঁরাই সফল মা। তাঁরা সবার সম্মানের, সবার শ্রদ্ধার।

শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল তাঁর মা সদ্য প্রয়াত আয়শা ফয়েজ-কে নিয়ে লিখেছেন। অধ্যাপক জাফর ইকবাল একজন বিজ্ঞানী, সার্থক শিক্ষক, জনপ্রিয় লেখক। তাঁর প্রায় সব লেখাই আমি পড়ি। তিনি আমার একজন প্রিয় মানুষ এবং আমাদের শিক্ষা পরিবারের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। আমরা তার জন্য গর্বিত। ‘একজন সাদাসিধে মা’ শিরোনামে লেখাটি পড়ে আমি আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়ি। আরো দশজন সাধারণ মায়ের কথা এবং আমার অতি সাধারণ ও হতভাগিনী মায়ের কথাও আমার মনে পড়ে। নিজের অজান্তে চোখ ভিজে যায়।

অধ্যাপক জাফর ইকবালের মা- একজন রত্নগর্ভা মা। একজন সাহসী সার্থক মা। তার দূরদর্শিতা, দক্ষতা, সাহস ও কঠোর পরিশ্রমের ফসল তাঁর সফল সন্তানরা। এ সম্পর্কে জাফর ইকবাল লিখেছেন। আমি জীবন সংগ্রামে বিজয়ী তাঁর মায়ের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।

জনপ্রিয় লেখক হুমায়ুন আহমদের মৃত্যুর পর তার আরেক বিখ্যাত ভাই আহসান হাবিবের বাসায় আমি তাদের মাকে আমার শোক ও সমবেদনা জানাতে গিয়েছিলাম। এই শোকের মধ্যেও তিনি আমাকে কাছে বসিয়ে আদর করে কথা বলেছিলেন। এবং হুমায়ুন আহমেদ প্রতিষ্ঠিত নেত্রকোনার স্কুলের বিষয়ে আলাপ করেছিলেন। আমি তাঁর স্নেহ ও আচরণে মুগ্ধ হয়েছি। তিনি অসুস্থ জেনে দেখতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েও যেতে সময় করে উঠতে দেরি হচ্ছিল। এর মধ্যে তিনি ইন্তেকাল করেন।

২৭ সেপ্টেম্বর ভোরে আমি ঢাকার বাইরে একটি জেলায় কাজে চলে গিয়েছিলাম। সভায় থাকার কারণে মোবাইল ফোন বন্ধ ছিল। আমার মেয়ে যথাসময়ে না পেয়ে পরে আমাকে ফোন করে জানায় তাঁর মৃত্যুর খবর। আমি খুবই মর্মাহত হই এবং জীবিত অবস্থায় দেখতে যেতে না পারার জন্য কিছুটা অপরাধবোধ করি। সাথে সাথে আমি অধ্যাপক জাফর ইকবালকে ফোন করি এবং আমার শোক প্রকাশ করে সমবেদনা জানাই। তখনই তার কাছে জানতে পারি, তারা মায়ের মরদেহ নেত্রকোনায় গ্রামের পারিবারিক গোরস্থানে দাফন করার জন্য রওয়ানা হয়ে গেছেন এবং গাজীপুর পাড়ি দিচ্ছেন। আমি আরও হতাশ হলাম। তার মরদেহের সামনে দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধা জানানোর শেষ আশাও আর থাকলোনা। প্রার্থনা করি অধ্যাপক জাফর ইকবালের শ্রদ্ধেয় মা আয়শা ফয়েজকে আল্লাহ বেহেশত নসিব করুন।

হুমায়ুন আহমেদ আমাকে একটি চিঠি লিখেছিলেন। সাক্ষাৎ করে আলোচনা করার জন্য আমাকে তার নুহাশ পল্লীতে আমন্ত্রণ জানান। খুবই আগ্রহ নিয়ে আনন্দের সাথে দেখা করতে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে জবাব দিয়েছিলাম। তিনি লিখেছেন একুশের বই মেলায় পুলিশ ছাড়া সাধারণ মানুষের মধ্যে ঘুরতে দেখে বিস্মিত হয়েছেন। মন্ত্রী এরকম সাধারণভাবে চলে, মানুষের মাঝে আরো দশ জনের মতো ঘুরে ঘুরে বই দেখে, বই কেনে ইত্যাদি নাকি তিনি ধারণা করেননি। তার সাথে দেখা করতে যাওয়ার আগেই তিনি চিকিৎসার জন্য আমেরিকা চলে গেলে এই আলোচনা হতে পারেনি। এটা আমার জন্য কষ্টের কারণ হয়ে আছে এবং একটা মূল্যবান সুযোগ ও অভিজ্ঞতা থেকে বঞ্চিত হয়েছি।

আমার মা এমনই এক সাধারণ নারী ও মা যার সম্পর্কে কিছু বলা বা লেখা বা শোনানোর বিশেষ কিছু নাই। লক্ষ কোটি মায়ের মধ্যে এক অতি সাধারণ মা। আমরা আমাদের মায়ের দুই ছেলে, যারা মায়ের চেহারাও মনে করতে পারি না। আমাদের শিশুকালে আমাদের মা জয়তুরা খাতুন তার দুই সন্তানকে মাতৃহীন করে চির বিদায় নেন প্রায় ষাট বছর আগে। আমার বয়স তখন প্রায় ৭/৮ বছর। আমার ভাইয়ের বয়স প্রায় দেড় বছর। মাতৃহীন দুই শিশু যৌথ বড় পরিবারে দাদি-চাচিদের ভালবাসা ও যত্নে বড় হয়েছি। দাদা বাবা চাচারা ভালবাসা দিয়েছেন উজাড় করে। আমরা ষাট বছর ধরে মাতৃহীন। প্রায় ৩০ বছর ধরে পিতৃহীনও।

আমার ছোট ভাই নজরুল যুক্তরাজ্যে থাকে। প্রায় ৪২ বছর ধরে বিদেশে। পেশায় চিকিৎসক। আমাদের মা সাধারণ গৃহিণী। পরিবারের বড় বউ হিসেবে সফল ছিলেন ও সকলের কাছে প্রিয় ছিলেন। এ কথা অন্য সকলের কাছে শোনা। তাদের শোক ও দুঃখ প্রকাশ থেকে নিয়মিত শুনে জেনেছি। অন্যদের কাছে মায়ের প্রশংসা শুনে আমরা গর্ববোধ করি।

আমার মায়ের বিশেষ কোন আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না। আরবী না বুঝলেও খুব ভালভাবে পড়তে পারতেন। কোরআন শরীফ নিয়মিত তেলাওয়াত করতেন। বাংলা পড়তেন এবং স্বাভাবিকভাবেই বুঝতেন। তবে প্রায় ৬ শত বছর পূর্বে প্রচলিত বাংলা ভাষার প্রমিত লিপির পাশাপাশি ‘নাগরীলিপি’ও প্রচলিত ছিল। সিলেট ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে তার প্রচলন ছিল। বর্তমানে বিলুপ্ত প্রায়। ৫০ বছর আগেই তার বিলুপ্তি ঘটেছে। আমার মা নাগরী লিপিতে লেখা বই পড়তে পারতেন এবং তার অনেকগুলো বই ছিল, নিয়মিত পড়তেন।

সিলেট ও পার্শ্ববর্তী কয়েকটি জেলায় নাগরীলিপির কিছুটা প্রচলন তখনও ছিল। আমার মায়ের একটি বইয়ের কথা আমার এখনো মনে আছে। বইটির নাম ‘কেতাব হালতুন্নবী’ লেখক মুন্সি সাদেক আলী।

অবসর সময়ে এই বইটি পড়তে দেখেছি। প্রতিবেশী নারীরা মাকে ঘিরে বসতেন। মা শব্দ করে পড়তেন এবং সবাই মুগ্ধ হয়ে শুনতেন। আমি আশে পাশে থাকলে লক্ষ্য করতাম, কোনো সময় শ্রোতারা হাসতেন, কোন সময় মন খারাপ করছেন। কারো চোখে পানি। আবার হয়তো হাসি ইত্যাদি। এখন আমার মনে হয় সুখ দুঃখের কাহিনী।

সেই বইটির চেহারা আমার এখনও মনে আছে। যদিও মায়ের চেহারা ভালভাবে মনে করতে পারিনা। বইটিতে সাদা কাগজের একটি মলাট লাগানো ছিল। বইটি কোথায় হারিয়ে গেছে আজও খুঁজে পাইনি। তবে উৎস প্রকাশনের মোস্তফা সেলিম আমাকে সিলেটি নাগরী লিপিতে অতীতে লেখা ও সম্প্রতি প্রকাশিত ২৫টি বই উপহার দিয়েছেন। এর মধ্যে ২৭১ পৃষ্ঠার ‘হালতুন্নবী’ বইটিও রয়েছে।

গত ক’বছরের সর্বাত্মক উদ্যোগ ও চেষ্টায় আমাদের নতুন প্রজন্ম অর্থাৎ আমরা প্রায় সব শিশুকে বিদ্যালয়ে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছি, তাদের ধরে রেখে বর্তমান যুগের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ মানসম্মত শিক্ষা, জ্ঞান, প্রযুক্তি, দক্ষতা এবং নৈতিক মূল্যবোধ ও দেশপ্রেমে উজ্জীবিত পরিপূর্ণ মানুষ তৈরি করে আধুনিক বাংলাদেশের নির্মাতা হিসেবে প্রস্তুত করার সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছি।

গত ৫ বছরে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে দ্বিগুণের বেশি হয়েছে। বর্তমানে আমাদের সব ধরনের সব পর্যায়ের শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৫ কোটির বেশি। এর প্রায় অর্ধেক তাদের পরিবারের প্রথম প্রজন্ম বিদ্যালয়ে যাচ্ছে। তাদের বাবা মায়েরা শিক্ষা লাভ করতে পারেন নাই। তাদের মায়েরা সব বাধা উপেক্ষা করে উৎসাহের সাথে সন্তানদের অনেক আশা নিয়ে বিদ্যালয়ে পাঠাচ্ছেন। আমরা যেন সব সাধারণ মায়ের আশা পূরণ করে তাদের মুখে হাসি ফুটাতে পারি-সকল বাধা উপেক্ষা করে এই প্রচেষ্টা আমরা চালিয়ে যাচ্ছি।

আমাদের নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা অতীতের সকল প্রজন্মের চেয়ে বেশি মেধাবী। তারা আধুনিক জ্ঞান-প্রযুক্তির সুযোগ লাভ করে অনেক বেশি গুণ মানের শিক্ষা, জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন করতে সক্ষম। আমাদের নবীন শিক্ষার্থীরা বিশ্বমানের মেধাবী। তাদের হতাশ ও নিরুৎসাহিত না করে উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে পারলে আমাদের সকল সংগ্রাম স্বার্থক হবে। আমাদের সকল মা অসাধারণ হয়ে উঠবেন, গর্বিত হবে তাদের সন্তানের জন্য। প্রয়াত আয়েশা ফয়েজের জীবন সংগ্রাম থেকে অভিজ্ঞতা, সাহস ও উৎসাহ লাভ করবেন। তার মত স্বার্থক মা হবেন। তার সন্তানের মতো সন্তানে ভরে উঠবে আমাদের দেশ। মা আয়েশা অমর হউন। আপনার প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।

বাংলাদেশ সময়: ১৪৪৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৪, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।