ঢাকার প্রধান নদীবন্দর সদরঘাট টার্মিনালে যাওয়ার আগে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) ফটকেই কিছু চেনামুখ চোখে পড়ছিল। পথে পথেও সেই মুখরতা টার্মিনাল অভিমুখে।
নৌবিহারের আয়োজনে কয়েক সপ্তাহ ধরে যারা অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছেন, সেই প্রিয় মুখগুলো আগে থেকেই লঞ্চে। সবাই লঞ্চে উঠেই স্যার-ম্যামদের সান্নিধ্যে, যাদের শাসন-ভালোবাসা হাঁটতে শিখিয়েছে যান্ত্রিক নগরে।
ঘড়ির কাঁটা ৮টা পেরোলেও লঞ্চ ছাড়তে সময় নিচ্ছিলো। জানা গেলো, দূর-দূরান্ত থেকে আসতে হচ্ছে বিধায় কয়েকজনের সময় লাগছে। নৌবিহারে যোগ দেবে বলে কর্মদিবস হওয়া সত্ত্বেও কতোকিছু ম্যানেজ করতে হয়েছে। এদের আবেগ-উচ্ছ্বাস নৌবিহারে জমা না হলে জমবে কী করে।
সবাই চেপে বসতেই হুইসেল তুলে লঞ্চ বুড়িগঙ্গার বুক চিরে যাত্রা করলো চাঁদপুরের উদ্দেশে। ক’বছর আগেও বুড়িগঙ্গার পানিতে যে উৎকট গন্ধ ছিল, তার তীব্রতা কমেছে হয়তো, তবে আবর্জনা নিঃসরণও ঠেকানো যাচ্ছে না, যেজন্য স্বচ্ছ করা যাচ্ছে না কালো পানিও।
ঢাকার প্রাণ বুড়িগঙ্গার এই দশা মন খারাপ করলেও লঞ্চে জমে ওঠা প্রাণোচ্ছ্বল আড্ডা মুখ আর মলিন থাকতে দিলো না। মনে হয় সেদিন, ২০০৯ সালে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪ মার্চ অগ্রযাত্রা করেছিল গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ। আজ ১১টি ব্যাচের শত শত শিক্ষার্থীর হৃদয়ের স্পন্দন এই বিভাগ। সাবেক-বর্তমান মিলিয়ে সাড়ে ৩শ’ শিক্ষার্থীর আড্ডা মুখরিত করে তুললো মঙ্গলবারের সকালটাকে।
কেউ একেবারে লঞ্চের ছাদে গিয়ে সামনের দিকটায় বসে টাইটানিক জাহাজের জ্যাক কিংবা রোজের মতো করে দু’হাত প্রসারিত করে নিজেকে সর্বজয়ী ভাবতে চাইছিল, কেউ কেউ নিজের পছন্দের ব্যাকগ্রাউন্ডে ফ্রেমবন্দি হতে ক্যামেরাওয়ালাদের মধুরভাবে জ্বালাতে লাগলো। কেউ কেউ বন্দি হতে লাগলো হালের সেনসেশন সেলফিতে। দু’একজন ক্যামেরাওয়ালা আবার কাউকে কাউকে তার অজান্তেই ক্লিকবন্দি করতে লাগলো, এটা নাকি সেলফির চেয়েও সেনসেশনাল ‘ক্যানডিড’।
কেবিনের সামনের বারান্দায়, ছাদে কিংবা ডেকে গল্প জমতে থাকে, ঘ্রাণ ছড়াতে শুরু করে খিচুড়ি। এই ঘ্রাণে এবার সবার মনে হয়; ক্ষিধে তো লেগেছে। গরম গরম খিচুড়ির সঙ্গে ঝোল, সঙ্গে ডিম ভাজি। এমন নরম আবহাওয়ার সুন্দর সকালে এর চেয়ে মুখরোচক খাবার আর কী হতে পারে!
বুড়িগঙ্গা পেরিয়ে ধলেশ্বরী ছাড়িয়ে লঞ্চ যখন মেঘনায়, তখন যেন বাতাসটা আরও শীতল হতে শুরু করলো। খানিকবাদেই কড়কড়ে রোদ সেই ফুরফুরে বাতাসের পরশকে যেন কেড়ে নিতে চাইলো।
বিশাল মেঘনার বুকে এমভি গাজী সালাউদ্দিনের মতো আরও ক’টি নৌযান তখন গন্তব্য অভিমুখে ছুটছে। গাজী সালাউদ্দিন ছুটতে ছুটতে থামলো চাঁদপুরের মতলবের এক চরে। কড়া রোদ আর আটকে রাখতে পারলো না কাউকে। ফুটবলপ্রেমী একদল নেমে পড়লো চরের পাড়ে। আর সবাই নেমে গেলো মেঘনার শীতল পানিতে পা ভেজাতে। কারও কারও পা ভিজিয়ে মন ভিজলো না, হই-হুল্লোড় করে গোসলও সেরে নিলো। ওদিকে ফুটবলের আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিল সমর্থকরা পছন্দের দলের নামে বিভক্ত হয়ে চালিয়ে যেতে থাকলো ‘মহারণ’। ব্রাজিল দল দারুণ আক্রমণে আর্জেন্টাইনদের রক্ষণভাগে কাঁপণ ধরালেও শেষতক ২-০ গোলে জিতে যায় আর্জেন্টিনাই।
বেলা গড়িয়ে মধ্যাহ্নভোজের সময় হতেই লঞ্চে ডাক পড়লো সবার। পোলাও-মাংস-রোস্ট-ডিমের সঙ্গে দারুণ সবজি আর সালাদে যখন সবাই তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছিল, তখন ছিল কোমল পানীয়। এমন খাবারের পর শরীর যেন একটু আয়েশ চাইছিল।
ওদিকে দোতলায় যে তখন সাংস্কৃতিক আয়োজনের সাজ-আয়োজন। মনোমুগ্ধকর আয়োজনের শুরুটা হয় অন্তরা সেন ও কেয়া সরকারের রবীন্দ্র-নৃত্য দিয়ে। তারপর বিভাগের প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীরা বিশ্ববাসীকে বাংলাদেশে আসার আমন্ত্রণ জানায় ‘ও পৃথিবী এবার এসে বাংলাদেশ নাও চিনে...’ গানে নৃত্য পরিবেশনে।
আমিরুল ইসলাম রনি, নূর মোহাম্মদ, জাহাঙ্গীর কবিরসহ বিভাগের সাবেক-বর্তমান শিক্ষার্থীদের সংগীত পরিবেশনের বাইরে গান গেয়ে সবাইকে চমকে পুরস্কার জিতে নেন বিভাগের সেমিনার সহকারী জিয়া।
গানে গানে নেচে সাংস্কৃতিক মঞ্চ মাতিয়ে তোলে শিথিল, অর্নি, ইমরান, নাবিল, মৌলি, তামান্না ইসলাম, বাঁধন, আরিফসহ অনেকে। শুভ ও মৌলির রম্য সংবাদ আর একাদশ, দ্বাদশ ও চতুর্দশ ব্যাচের শিক্ষার্থীদের আঞ্চলিক বিতর্ক দর্শক-শ্রোতাকে হাসিয়েছে গাল ধরে যাওয়া পর্যন্ত। রোমান্টিকতায় ডুবিয়েছে অন্তরা সেন পিংকি ও মো. তাজনুর ইসলামের আবৃত্তি।
তবে ভাবিয়েছে নিজাম উদ্দিন শামিমের পরিচালনায় রাফসান, নাবিল, তানভির প্রমুখের মুকাভিনয়। বার্তা ছিল নিজাম উদ্দিন শামিমেরই পরিচালনায় তানভির, রাফসান, শামিম ও হৃত্বিক অভিনীত ‘তারা সেই লেভেলের অভিনেতা’ নাটিকায়ও।
হই-হুল্লোড় জমেছিল দেয়ালে সাঁটানো নায়িকার কপালে চোখ বাঁধা অবস্থায় টিপ পরানোর খেলা, নির্দিষ্ট দূরত্ব থেকে ঝুড়িতে বল নিক্ষেপ করা, কপালে রাখা বিস্কুট হাত দিয়ে ধরা ছাড়াই খাওয়া এবং বল পাসিংয়ের মতো আয়োজনের সময়। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থীদের বর্তমান শিক্ষার্থীরা ফুল দিয়ে বরণ করে নেওয়ার পর সবশেষে হয় র্যাফেল ড্র।
সব প্রতিযোগিতা, আর র্যাফেল ড্রর পুরস্কার বিজয়ীদের হাতে তুলে দেন গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের চেয়ারপারসন ড. শাহ নিস্তার জাহান কবির, সহকারী অধ্যাপক মুহাম্মদ আনওয়ারুস সালাম, মো. রাইসুল ইসলাম, প্রভাষক বর্ণনা ভৌমিক, ইব্রাহিম বিন হারুন ও মিঠুন মিয়া।
পুরস্কার বিতরণী পর্ব সঞ্চালনা করেন বিভাগের প্রভাষক মো. জাকারিয়া খান। এসময় সাবেক শিক্ষার্থীদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন সাংবাদিক আখলাকুস সাফা, গণ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও গবেষক সরোজ মেহেদী (মেহেদী হাসান), একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা কবি জিসান আল জুবাইর প্রমুখ।
তার আগে সাংস্কৃতিক পর্ব সঞ্চালনার দায়িত্ব ছিল হামিমুর রহমান ওয়ালিউল্লাহ ও আয়েশা চৌধুরী আঁখির। প্রতিযোগিতা পর্বগুলো সামলানোর দায়িত্ব ছিল রবিউল সুমন ও আহমেদ কাওসারের। আর ক্যামেরা হাতে সুন্দর মুহূর্তগুলো বন্দি করতে ব্যস্ত ছিল বিজু রায়, আশিক-উল বারাত, আবদুল ওয়াহাব ও সাজেদুল ইসলাম সুকর্ণরা।
এরপর ফলাহার পর্বের সঙ্গে সঙ্গে চলে ‘ডিজে পার্টি’। কেউ কেউ ছাদে গিয়ে নির্মল বাতাস গায়ে মেখে জমায় আড্ডা। অন্ধকার ঘনিয়ে আসতেই স্পষ্ট হয় দু’পাড়ের আলো। ‘এইতো চলে এলাম ঢাকা!’ অশুভকে বিদায় দিয়ে মঙ্গল বয়ে আনার বার্তা নিয়ে ওড়ানো ফানুশ যখন হারিয়ে যাচ্ছিল দূর আকাশে, এমভি গাজী সালাহউদ্দিন তখন হুঁইসেল বাজিয়ে যেন বলছিল, ‘এই নোঙর করলাম ঘাটে’।
লেখক: হুসাইন আজাদ, দ্বিতীয় ব্যাচ, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
বাংলাদেশ সময়: ১১২১ ঘণ্টা, মার্চ ১৪, ২০১৯
এইচএ/