গণঅর্থায়নে নির্মাতা খন্দকার সুমন নির্মাণ করেছেন ‘সাঁতাও’। সিনেমাটি ‘২১তম ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব’র বাংলাদেশ প্যানোরমা বিভাগে প্রিমিয়ার হয়েছে।
সিট না পেয়ে কেউ কেউ ফ্লোরে বসেই সিনেমাটি উপভোগ করেছেন। এখানেই শেষ নয়, হলের বাইরেও ছিল দর্শকদের উপচে পড়া ভিড়। আবার নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ায় জাতীয় জাদুঘরের মূল গেটের বাইরেও দেখা গেছে সিনেমাটি দেখতে আসা অনেককেই।
তবে যারা সিনেমাটি দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন তাদের সবাই সিনেমাটির প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন। একইসঙ্গে নির্মাতা, কলাকুশলীদের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সুমাইয়া সোমা সিনেমাটি দেখার পর নিজের অভিব্যক্তি প্রকাশ করেন এভাবে, 'সাঁতাও সিনেমাটির প্রিমিয়ার দেখলাম। দেখলাম বললে ভুল হবে, অনুভব করলাম। তিস্তা ব্যারেজ, প্রান্তিক কৃষকের জনজীবন এবং সংগ্রাম, কারখানা শ্রমিকের জীবনের অনিশ্চয়তা, রাজনীতি, প্রেম, দেশজ সঙ্গীত- সব মিলিয়ে দারুণ। মনে হয়েছে, এই সিনেমার চরিত্র গুলোতো আমি, আমার মা, আমার পরিবার, আমার সমাজ ব্যবস্থা, আমার রাষ্ট্রনব্যবস্থাকে তুলে ধরেছে।
তিনি আরো বলেন, সিনেমার দৃশ্য, চরিত্রগুলোর অভিনয় খুবই নিপুণ আঙ্গিকের সঙ্গে রচনা করা হয়েছে। আজকে ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে সিনেমাটি হাউজফুল ছিল। আমার দেখা এই প্রথম কোন সিনেমা দেখার জন্য দর্শক ফ্লোরে বসে পড়েছিল। সিনেমার সঙ্গে জড়িত প্রত্যেক কলাকুশলীর প্রতি অনেক শুভকামনা, সিনেমাটি আরো একবার দেখতে চাই অবশ্যই সিনেমা হলে।
মুশতাক মুজাহিদ নামের একজন জানান,
সাঁতাও ফাটিয়ে ফেলছে ভাই। সবাই ২৭ জানুয়ারি হলে দেখতে যাবেন। সুমন (সিনেমাটির নির্মাতা) ভাই শেষে আপনার কথাগুলো শুনে নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারি নাই, কেঁদে ফেলছি ভাই। আপনাকে অভিনন্দন জানাই, সাঁতাও মানুষের মন কাড়বেই।
নির্মাতা রাশিদ পলাশ জানান, এই ভিড় সাঁতাও সিনেমা দেখার জন্য, এই ভিড়টাই হলে দেখতে চাই ২৭ জানুয়ারি থেকে। অভিনন্দন খন্দকার সুমন ভাই। সিনেপ্লেক্সে বসে দেখতে চাই আপনার সিনেমা।
জাহাঙ্গীর নগর থিয়েটারের পাবলিকসিটি সেক্রেটারি অনুবরতা নন্দী জানান, সাঁতাও'র প্রিমিয়ার শো উপভোগ করলাম। গ্রামীণ কৃষক সমাজ আমাদের অর্থনীতির ভিত, তা সে যেই যুগই হোক। পরিচালক খন্দকার সুমন খুবই সুনিপুণভাবে উত্তরবঙ্গের এক কৃষক পরিবারের জীবনযাত্রা এবং সেখানে তাদের গৃহপালিত পশু থেকে শুরু করে প্রকৃতি কিভাবে অবদান রাখে তা সুস্পষ্টভাবে ধারণ করেছেন। গণঅর্থায়নে নির্মিত সাঁতাও আমি মনে করি, সুমন ভাই এবং তার দলের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল। সাঁতাও দেশব্যাপী মুক্তি পাচ্ছে আগামী ২৭শে জানুয়ারি। আমি আশা রাখবো আমার এই লেখাটি যিনিই দেখে থাকবেন, হলে গিয়ে একবার হলেও সিনেমাটি দেখবেন, নইলে বাংলাদেশের বর্তমান স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাতাদের একটি ভাষা জানার সুযোগ থেকে যে বঞ্চিত হবেন! সাঁতাও'র জন্য শুভকামনা। আমি পরিবার নিয়ে হলে গিয়ে আরেকবার সনেমটি দেখবো!
দর্শক প্রশংসায় ভাসলেও প্রিমিয়ার শেষে পরিচালক সুমন আক্ষেপ নিয়ে বলেন, আমাদের সিনেমাটি অনেক সিনেমা হল মালিক নিতে ভয় পাচ্ছেন। তাদের ধারণা এ ধরনের সিনেমা দর্শকরা দেখে না। কিন্তু তাদের সে ধারণা মিথ্যে প্রমাণিত হয়েছে। আমাদের সিনেমারও দর্শক রয়েছে।
এই নির্মাতা আরো বলেন, শুধু সিনেমা হল থেকে নয় কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোও আমাদের সিনেমাকে স্পন্সর করতে রাজি হয়নি। কারণ তাদের কাছে কৃষক হচ্ছে ব্র্যান্ডিংয়ের জায়গা থেকে সর্বনিম্ন জায়গা। অথচ এদেশে কৃষক হচ্ছে সবচেয়ে বড় ব্র্যান্ড।
সিনেমার নায়িকা আইনুন পুতুল প্রিমিয়ার শেষে দর্শকদের অভিনন্দনে আপ্লুত হয়ে পড়েন। আবেগজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, আমাদের সিনেমাটি ভারতের গোয়া আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয়েছিলো। আমার মা অসুস্থ থাকায় আমি যেতে পারিনি। কিন্তু আমার কাছে মনে হয়েছে এটা গোয়া-অস্কারের চেয়ে কম কিছু না।
‘সাঁতাও’ আগামী ২৭ জানুয়ারি মুক্তি পাওয়ার কথা রয়েছে। সিনেমাটির প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন আইনুন পুতুল ও ফজলুল হক।
এর গল্পে দেখা যাবে, গ্রামের কৃষক ফজলু বিয়ের পর বুঝতে পারে নতুন সংসারে পুতুল একাকিত্ব অনুভব করছে। পুতুলের একাকিত্ব দূর করতে ফজলু একটি গাভী কিনে আনে। পুতুল তার সংসারে নতুন সঙ্গী পেয়ে বাবার বাড়ি ছেড়ে আসার কষ্ট গুলো কিছুটা ভুলতে শুরু করে।
এই দিকে নদীর উজানে একের পর এক বাঁধের কারণে ভাটি অঞ্চল শুকিয়ে যাচ্ছে। এমন প্রতিকূল পরিবেশে ফজলুর মত কৃষকদের কৃষি কাজে নানান সমস্যা সম্মুখীন হতে হয়। অবিরাম বৃষ্টিপাত আর উজানের ঢল এসে উপচে না পড়া পর্যন্ত বাঁধগুলোর দরজা বন্ধ রাখা হয়। আবার বাঁধের দরজাগুলো খুলে দিলে আটকে থাকা বিশাল জলধারা নদীতে প্রবাহিত হতে শুরু করে।
নদীর গভীরতা কম থাকায় হঠাৎ প্রবাহিত জলধারা নিম্নাঞ্চলে প্লাবিত হয়ে পশু-পাখিসহ জনজীবনে অভিশাপ বয়ে আনে। নদীর এমন বিরূপ আচরণে ফজলু এবং পুতুলের সুখি সংসার বিষাদময় হয়ে উঠে।
সিনেমাটিতে পুতুল ও ফজলুল ছাড়াও অন্যান্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন মো. সালাউদ্দিন, সাবেরা ইয়াসমিন, স্বাক্ষ্য শাহীদ, শ্রাবণী দাস রিমি, তাসমিতা শিমু, মিতু সরকার, ফারুক শিয়ার চিনু, আফ্রিনা বুলবুল, রুবল লোদী, কামরুজ্জামান রাব্বী, আব্দুল আজিজ মন্ডল, বিধান রায়, জুলফিকার চঞ্চল, বিনয় প্রসাদ গুপ্ত, সুপিন বর্মণ, রেফাত হাসান সৈকত, আব্দুল্লাহ আল সেন্টু, আলমগীর কবীর বাদল, রবি দেওয়ান, দীনবন্ধু পাল, হামিদ সরকার, মোঃ হানিফ রানা, আকতার হোসেন, আজিজুল হাকিম শিউস, সাইফুল ইসলাম লিটন, রাসেল তোকদার, মজনু সরকার, আবু কালাম, সিদ্দীক আলী, সুজন মাহমুদ, তাহসিনা আকতার তন্বী, নিশাত তাহিয়াত মিমন এবং তিস্তাবাজার এলাকাবাসী।
আইডিয়া এক্সচেঞ্জের ব্যানারে ‘সাঁতাও’ প্রযোজনা করেছেন শরিফ উল আনোয়ার সজ্জন। পরিচালনার পাশাপাশি কাহিনি, চিত্রনাট্য ও সংলাপ লিখেছেন খন্দকার সুমন। সম্পাদনা, রং-বিন্যাস, এফেক্ট ও টাইটেল, সাউন্ড ডিজাইন ও সাউন্ড মিক্সিং করেছেন সুজন মাহমুদ। শব্দ গ্রহণে ছিলেন নাহিদ মাসুদ।
চিত্রগ্রহণে ছিলেন সজল হোসেন, ইহতেশাম আহমদ টিংকু ও খন্দকার সুমন। আবহ সংহীত করেছেন মাহমুদ হায়াৎ অর্পণ। গানে কণ্ঠ দিয়েছেন কামরুজ্জামান রাব্বী, লায়লা তাজনূর সাউদী, লিমা হক। শিল্প নির্দেশনা দিয়েছেন রবি দেওয়ান।
পোশাক পরিকল্পনায় ছিলেন আফ্রিনা বুলবুল। নৃত্য পরিচালনা করেছেন ফাহিম রায়হান। রূপসজ্জা করেছেন ফরহাদ রেজা মিলন ও পোস্টার ডিজাইন করেছেন সাজ্জাদুল ইসলাম সায়েম।
বাংলাদেশ সময়: ০৮০৬ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২১, ২০২৩
এনএটি