কিশোরগঞ্জ শহরের কেন্দ্রস্থলের গৌরাঙ্গ বাজার ব্রিজে দাঁড়িয়ে আক্ষেপ করে তিনি জানালেন, ‘নরসুন্দা এখন একটি মৃত নদীর নাম’।
সরেজমিনে দেখা গেছে, কিশোরগঞ্জ শহরের মাঝ বরাবর প্রবাহিত নরসুন্দাকে এখন আর নদী বলা যায় না।
হয়েছে। গৌরাঙ্গ বাজার ব্রিজের দু’পাশে বহতা নদীর কোনো চিহ্নই নেই। এক টুকরো স্তব্ধ জলাশয়ও ময়লা আর-আবর্জনায় ভরপুর।
অথচ খরস্রোতা ও প্রমত্তা নরসুন্দায় এককালে দেশ-বিদেশের সওদাগরি নৌকা এসে ভিড়েছে। স্বচ্ছ-ছল ছল জলে ভেসে উঠেছে শহরের প্রতিচ্ছবি। শীতের দিন-রাতগুলো মুখরিত হয়েছে হাজার পাখির কলকাকলিতে।
‘আমাদের জীবনের সবটুকু ঘিরে ছিল নদীটি’- স্মৃতিকাতর কামালউদ্দিনের কণ্ঠেও তাই যেন হারানো নদীটির জন্য সুতীব্র বেদনাধ্বনি গুঞ্জরিত হয়।
শহরবাসীরও অভিযোগ, নদীটির দু’পারেই ইচ্ছেমতো জায়গা দখল করে নানা স্থাপনা নির্মাণ করেছে অসাধু চক্র। পুরো শহরের ময়লা ফেলার ডাস্টবিন বানিয়ে ফেলায় ভরাট হয়ে যাচ্ছে নদীটি। পানিপ্রবাহের সামান্য সুযোগও রাখা হয়নি। স্থানে স্থানে ডোবার মতো কিছুটা পানি জমে আছে শুধু।
নদীটির পাড়েই কিশোরগঞ্জ শহরের তিনটি বিখ্যাত বাজার। বাজারগুলোর সমস্ত ময়লায়ও সয়লাব হচ্ছে নদী। শহরের পূর্বাংশে পাশাপাশি পুরান থানা ও বড় বাজার। উত্তর-দক্ষিণে প্রসারিত ব্রিজ বাজার দু’টিকে সংযুক্ত করেছে। ময়লা-আবর্জনা ফেলতে ফেলতে নদী তো বটেই, ব্রিজটিও বুজিয়ে ফেলা হয়েছে।
গৌরাঙ্গ বাজার ব্রিজেরও একই দশা। নদীর ওপরেই দোকানের অংশবিশেষ ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। ভরাট করে বসানো হয়েছে অস্থায়ী বাজার। ব্যবসায়ী ও হকারদের দখলে চলে গেছে নদীর বহুলাংশ। আর জমানো হচ্ছে যাবতীয় ময়লা।
‘একবার এসব অবৈধ স্থাপনা ভেঙে নদীটিকে পুনরুদ্ধারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্ত প্রভাবশালী মহলের কারণে সেটি সম্ভব হয়নি’- বললেন তরুণ কবি খোন্দকার আহমেদ কামাল।
নদীর পাড় দিয়ে বানানো ফুটওয়ের অবস্থা আরও শোচনীয়। ভাগাড়ের মতো হয়ে আছে চারপাশ। দুর্গন্ধে পথচলাই দায় সেখানে। পুরো ফুটওয়েই যেন উন্মুক্ত টয়লেট ও যাবতীয় শৌচকর্মের নিরাপদ স্থান। হাঁটার রাস্তায় আছে বখাটেদের উৎপাতও। নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে মোটরসাইকেল চালিয়ে বেড়ানো উৎশৃঙ্খল তরুণদের দাপট।
কলেজছাত্রী নুসরাত বলেন, ‘নদীতীর বলতে যে স্বাস্থ্যকর ও নান্দনিক পরিবেশকে ধরা হয়, সেটি কিশোরগঞ্জে অনুপস্থিত। দুর্গন্ধ, আবর্জনা ছাড়াও বখাটেদের দৌরাত্ম্যে সম্মান বাঁচানো সম্ভব নয়, মেয়েদের জন্য তো নয়ই। কর্তৃপক্ষের কাছে বহু আবেদন-নিবেদন করেও কোনো নিরাপত্তা পাচ্ছি না’।
প্রশাসন ও পৌরসভা নদীটি এবং স্বাস্থ্যকর ও নিরাপদ পরিবেশ রক্ষায় কার্যকরী কিছুই করেনি বলেও অভিযোগ পৌরবাসীর।
পরিবেশ নিয়ে কর্মরত সুলতান আহমেদ বলেন, ‘নদীর সৌন্দর্য রক্ষায় ১১০ কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়া হলেও কাজ কি হয়েছে জানি না। নদীটি খালে পরিণত হয়েছে, দখল হচ্ছে প্রতিদিনই’।
প্রকল্পটি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন আরও অনেকেই। পত্র-পত্রিকায়ও বিস্তর লেখালেখি হয়েছে। প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো সামাজিক সংগঠন নরসুন্দা রক্ষার দাবিতে মানববন্ধন বা সমাবেশ করছে। অথচ পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হচ্ছে না।
পূর্ব ও পশ্চিম বরাবর বয়ে যাওয়া নরসুন্দা এক সময় ছিল যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম। পশ্চিমে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র থেকে পূর্বদিকে হাওরাঞ্চল হয়ে মেঘনায় মিলিত হয়ে পুরো কিশোরগঞ্জকেই করেছিল প্রাকৃতিকভাবে সুন্দর আর বাণিজ্যিকভাবে সমৃদ্ধ। দেশি প্রজাতির প্রচুর মাছ পাওয়া যেতো এ নদীতে।
কিন্তু এখন দখল-দূষণে পুরো নদীটিরই পানিপ্রবাহ ব্যহত হচ্ছে। তবে শহরের কাছে বেশি আক্রান্ত হয়েছে। দিনে দিনে নানা অনাচারে মৃত্যুঘণ্টা বেজেই চলেছে নরসুন্দার।
নরসুন্দা তাই এখন কিশোরগঞ্জের দুঃখের কারণও। নদীটির ইতিহাস হয়ে আছে ‘জীবন্ত’ আর বর্তমান হয়ে গেছে ‘মৃত’। কোনোমতে অস্তিত্ব নিয়ে শুধুমাত্র টিকে আছে কঙ্কালসদৃশ নরসুন্দা নদীর নামটিই।
বাংলাদেশ সময়: ১৬০৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ০৮, ২০১৭
এএসআর