ঢাকা, মঙ্গলবার, ৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৯ মার্চ ২০২৪, ০৮ রমজান ১৪৪৫

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য

স্বপ্ন ছোঁয়ার অপেক্ষায় ‘পলিনেট হাউস’

শরীফ সুমন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৪৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ২, ২০২২
স্বপ্ন ছোঁয়ার অপেক্ষায় ‘পলিনেট হাউস’ পলিনেট হাউস। ছবি: বাংলানিউজ

রাজশাহী: শীতের সময় গরম। বৃষ্টির সময় খরা।

যখন বৃষ্টির প্রয়োজন তখন বয়ে যায় তাপপ্রবাহ। আবার যখন রোদের প্রয়োজন তখন হয় বৃষ্টি। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে প্রকৃতিতে এখন এমনই টালমাটাল অবস্থা! 

বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে গবেষকরা বলছেন, সময় যত গড়াচ্ছে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ততই বাড়ছে। এ অবস্থায় ক্রমেই হুমকির মুখে পড়ছে কৃষি। তাই কৃষিকে বাঁচাতে নতুন নতুন গবেষণা ও উদ্ভাবনের চেষ্টা চলছে বিশ্বজুড়েই।  

‘পলিনেট হাউস’ তেমনই এক গবেষণার ফসল। বলা হচ্ছে, জলবায়ু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কৃষি বিজ্ঞানের এই উদ্ভাবন টেকসই কৃষি ব্যবস্থাপনার নতুন রূপান্তর।

জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি সামাল দিয়ে আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণ, রোগবালাইয়ের আক্রমণ প্রতিরোধ, বীজতলার মাণ নিয়ন্ত্রণ এবং অসময়ের সবজি চাষসহ আধুনিক কৃষিকাজের জন্য ‘পলিনেট হাউজের’ কোনো জুড়ি নেই। গ্রিনহাউস’র আদলে দেশীয় কৃষি ব্যবস্থাপনায় নতুন সংযোজন এই ‘পলিনেট হাউস’।  

এর মাধ্যমে শীতকালীন সবজি যেমন গ্রীষ্মকালে উৎপাদন করা যাবে, তেমনি গ্রীষ্মকালের সবজিও শীতে উৎপাদন করা যাবে খুব সহজেই। হাতের মুঠোয় নতুন এই প্রযুক্তি চলে আসায় কৃষককে কোনো বেগ পেতে হবে না।  

এই ‘পলিনেট হাউস’ প্রযুক্তির মাধ্যমে ভারী বৃষ্টি, তীব্র তাপদাহ, কীটপতঙ্গ, ভাইরাসজনিত রোগ ইত্যাদির মতো প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও নিরাপদ থাকবে শাক-সবজি এবং ফলমূলসহ সব ধরনের কৃষি উৎপাদন।

তাই অত্যাধুনিক প্রক্রিয়ায় পলিনেট হাউসে উৎপাদিত ফসলের দিকেই এখন ঝোঁক বেশি কৃষকদের। তবে এখনও সবখানে নেই ‘পলিনেট হাউস’। পাইলট প্রকল্পের মাধ্যমে আপাতত সরকারি উদ্যোগে দেশের সবগুলো বিভাগে একটি দুইটি করে পলিনেট হাউস নির্মাণ করে দেওয়া হচ্ছে। তা দেখেই উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠছেন অন্য কৃষকরা। দেশের শস্যভাণ্ডার খ্যাত রাজশাহী বিভাগের এমন ২১টি ‘পলিনেট হাউস’ রয়েছে। এর মধ্যে একটি রয়েছে পবার খড়খড়িতে।

রাজশাহীর পবা উপজেলার খড়খড়িতে গিয়ে দেখা যায় ‘কৃষক বন্ধন বিসমিল্লাহ্ নার্সারির স্বত্বাধিকারী শামসুল আলম কাদুর ২৫ শতক জমিতে কৃষি বিভাগ থেকে সম্পূর্ণ সরকারি সহযোগিতায় পলিনেট হাউস করে দেওয়া হয়েছে।

এতে উন্নত মানের পলি ওয়ালপেপার ব্যবহার করা হয়েছে। লোহার অ্যাঙ্গেলের ওপর পলিপেপার দিয়ে তিনটি শেডে এই পলিনেট হাউস নির্মাণ করা হয়েছে। এতে ব্যয় হয়েছে প্রায় ১৫ লাখ টাকা। এর স্থায়িত্বকাল ধরা হয়েছে প্রায় ২০ বছর।  

এরপর রক্ষণাবেক্ষণসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র পরিবর্তনের প্রয়োজন হতে পারে। প্রথমবার কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে পুরো খরচ দেওয়া হয়েছে। তবে এই টাকা শোধ দিতে হবে না। তবে এর জন্য শামসুল আলমকে একটি শর্ত দিয়েছে কৃষি বিভাগ। শর্তটি হচ্ছে- এখানে উৎপাদিত বীজ, শাক-সবজি ও ফলমূল স্থানীয়ভাবে সবার কাছে ন্যায্যমূল্যে বিক্রি করতে হবে। আর এ জন্য রশিদ বই রাখতে হবে।

নার্সারির স্বত্বাধিকারী শামসুল আলম কাদু বাংলানিউজকে বলেন তার নার্সারির পাশেই এই পলিনেট হাউস নির্মাণ করে দিয়েছে কৃষি বিভাগ। জুলাই থেকে এর ভেতরে চাষাবাদ শুরু করেছেন। তিনি ৮০ হাজার টাকার বীজ বুনেছেন। এখান থেকে চারা উৎপাদন করছেন।  

এখানে শীতকালীন টমেটো, ফুলকপি ও কাঁটা বেগুন এবং চায়না বেগুনের বীজ বুনেছেন। আপাতত তিনি বীজ থেকে চারা উৎপাদন করছেন। এরপর অন্যান্য ফসল চাষের ব্যাপারেও ভাববেন। তবে পলিনেট হাউসের মধ্যে এই দুই মাসের মধ্যেই তিনি উন্নতমানের বীজ উৎপাদনে সফলতা পেয়েছেন। আশপাশের কৃষকরা এখনই পলিনেট হাউসের ব্যাপারে জানতে পেরেছেন।

তারা এতদিন নিম্নমানের চারা ও মেয়াদোত্তীর্ণ চারা নিয়ে উদ্বেগ-কণ্ঠার মধ্যে থাকতেন। কিন্তু তার এখান থেকে উন্নতমানের বীজের চারা পেয়ে অনেক খুশি। বাজারের চেয়ে দামও কম। তাই তাদের অনেকে এখন ব্যক্তি উদ্যোগেই এই পলিনেট হাউস নির্মাণের কথা ভাবছেন।

এদিকে স্থানীয় কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, পলিনেট হাউসে উচ্চমূল্যের ফসল যেমন ক্যাপসিকাম, ব্রকলি, রকমেলন, রঙিন (হলুদ) তরমুজ, রঙিন ফুলকপি, বাঁধাকপি, লেটুস ও অন্যান্য অসময়ের সবজির পাশাপাশি চারা উৎপাদনের সুযোগ তৈরি হয়েছে।  

এছাড়াও গ্রীষ্মকালেও ফলবে শীতকালীন সবজি। এর মধ্যে টমেটো, ফুলকপি, বেগুন, গাজর ইত্যাদি ফসল রয়েছে। এর ফলে সবজি চাষে যেমন বৈচিত্র্য আসবে, তেমনি অনেকেই আয়ের নতুন উৎসের সন্ধান পাবে। ওপরে উন্নতমানের পলিথিনের আচ্ছাদন থাকে। তাই এতে সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মি ভেতরে প্রবেশে বাধা পায়। এজন্য অতি বৃষ্টি বা প্রাকৃতিক দুর্যোগেও ফসল অক্ষত থাকে। আর এই পদ্ধতিতে কৃষকরা সারা বছর সবজি চাষ করতে পারবেন। এতে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে সব ধরনের সবজি চাষ করে কৃষক আর্থিকভাবে সফলতা পাবেন। কৃষি বিভাগ থেকে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পরমর্শ দেওয়া হচ্ছে।

পলিনেট হাউস দেখে আসার পর কথা হয় রাজশাহীর পবা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. শফিকুল ইসলামের সঙ্গে।  তিনি বাংলানিউজকে বলেন, পলিনেট হাউসের আদ্যোপান্ত জানান। অসময়ে সবজি চাষের জন্য পলিনেট হাউস দেশে আধুনিক কৃষি প্রযুক্তির নতুনভাবে সংযোজন হতে যাচ্ছে। এটি তৃণমূল কৃষকের স্বপ্ন ছুঁয়ে যাবে।  

গবেষণায় দেখা গেছে, পলিনেট হাউসে ফসলের উৎপাদন ২০ শতাংশ বেশি। পাশাপাশি পোকামাকড়ের আক্রমণও ৭০ শতাংশের কম। প্রাথমিকভাবে খরচ কিছুটা বেশি হলেও এতে উৎপাদন খরচ অত্যন্ত কম হবে।  

আর নিরাপদ ফসল উৎপাদন সহজ হবে। পলিনেটে সুস্থ সবল চারা উৎপাদন করা যাবে এবং উচ্চমূল্যের ফসলও উৎপাদন করে অধিক লাভবান হতে পারবেন সাধারণ কৃষক।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম জানান, পবায় এই প্রথম পলিনেট হাউস তৈরি হয়েছে। যা দেখে এখন শিক্ষিত বেকার যুবকরাও আগ্রহী এবং উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন। তারা আশা করছেন, পলিনেট হাউসের মাধ্যমে উচ্চমূল্যের ফসল যেমন ফলবে তেমনি অফ সিজনে অন্যান্য সবজি উৎপাদন হবে। পাশাপাশি চারা উৎপাদনের সুযোগও তৈরি হবে। ফলে রাজশাহী অঞ্চলে সবজি চাষে বৈচিত্র্যতা আসবে।

অতিমারী ও নানা দুর্যোগের পরিপ্রেক্ষিতে কৃষির গুরুত্ব দিন দিন বাড়ছে। কাজেই দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কৃষির টেকসই রূপান্তর ও আগামীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় পলিনেট হাউসের ব্যবহার উল্লেখযোগ্য হারে বাড়াতে হবে বলেও বিশেষভাবে উল্লেখ করেন এই কৃষি কর্মকর্তা।

রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. মোজদার হোসেন বাংলানিউজকে জানান, আধুনিক প্রযুক্তি সম্প্রসারণের মাধ্যমে রাজশাহী জেলায় কৃষি উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় পবায় পলিনেট হাউস স্থাপন করা হয়েছে। এ পদ্ধতিতে কৃষকরা সারা বছরই সব ধরনের সবজি চাষ করতে পারবেন। আগ্রহীদের এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।

বাংলাদেশ সময়: ১৩৪৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ০২, ২০২২
এসএস/এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।