ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

ফিচার

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পঞ্চম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী

মোরশেদ সরকার | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪২৪ ঘণ্টা, অক্টোবর ২০, ২০১০
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পঞ্চম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী

উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন বিদ্যাপীঠ আজকের জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা ২০০৫ সালের ২০ অক্টোবর। এর রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস।

কালের চাহিদায় আজকের এই বিশ্ববিদ্যালয়টির উত্থান পাঠশালা থেকে।

জন্মকথা

ব্রাহ্মসমাজের উদ্যোগে ১৮৬৩ সালে পুরান ঢাকার আর্মানিটোলায় ব্রাহ্ম স্কুল নামে যে প্রতিষ্ঠানের যাত্রা শুরু হয়েছিল, কালের বিবর্তনে তা আজ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।   ব্রাহ্মসন্তানদের বিদ্যা শিক্ষাদান এবং ধর্মচর্চার উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত হলেও এর দ্বার সবার জন্য উন্মুক্ত ছিল। ১৮৬৮ সালে আর্থিক সংকটের কারণে স্কুল কর্তৃপক্ষ মানিকগঞ্জের বালিয়াটির জমিদার কিশোরীলাল রায় চৌধুরীর কাছে এর  দায়িত্ব অর্পণ করেন। তিনি তার পিতা জগন্নাথ রায় চৌধুরীর নামে স্কুলটির নামকরণ করেন জগন্নাথ স্কুল। তখন লোকমুখে এটি পাঠশালা বলেই বেশি পরিচিত ছিল। প্রতিষ্ঠার অল্প দিনের মধ্যেই আশপাশের নামকরা অনেক স্কুলকে ছাড়িয়ে যায় স্কুলটি। ওই সময়ে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় পর পর কয়েক বছর প্রথম হয়েছিল স্কুলটি। ফলে দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে এর ছাত্রসংখ্যা। এ সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে ১৮৮৪ সালে কিশোরীলাল চৌধুরী একে উচ্চমাধ্যমিক কলেজে উন্নীত করেন। পরে স্নাতকও শুরু হয়। কিন্তু ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী সংকট হওয়ার আশঙ্কায় জগন্নাথ কলেজের স্নাতক পর্যায়ের পাঠদান বন্ধ হয়ে যায়। আবারও উচ্চমাধ্যমিক কলেজে রূপান্তরিত হয়। তবে শুধু শিক্ষার্থী দিয়েই নয়, শিক ও গ্রন্থাগারের বিপুল পরিমাণ বই দিয়েও জগন্নাথ কলেজ সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পথ চলাকে সাহায্য করে। কৃতজ্ঞতাস্বরূপ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলের নাম রাখা হয় জগন্নাথ হল।

১৯৪২ সালে সহ-শিক্ষার দ্বার উন্মুক্ত করা হয়। আন্দোলনের মুখে ১৯৬৯ সালে পুনরায় অনার্স কোস চালুর অনুমতি পায়। এরপর ছাত্রসংখ্যার চাপ কমাতে ১৯৮২ সালে কলেজের ইন্টারমিডিয়েট কোর্স তুলে দেওয়া হয়। পরে সময়ের চাহিদার আলোকে জগ্নাথ কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত করার দাবি উঠে বিভিন্ন মহল থেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবিতে আন্দোলনে নামেন শিক্ষার্থীরা। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৫ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। পরে ২০০৫ সালের ৬ নভেম্বর একনেকের বৈঠকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় প্রকল্প পাস হয়। একই বছর ২০ অক্টোবর সরকারি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে  পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে এ প্রতিষ্ঠানটি যাত্রা শুরু করে।

মুক্তিযুদ্ধে অবদান
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধসহ দেশের সব উল্লেখযোগ্য আন্দোলন-সংগ্রামে জগন্নাথের ছাত্রদের অগ্রণী ভূমিকা রয়েছে। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ঐতিহাসিক ছয় দফা ঘোষিত হলে তার সমর্থনে ৭ জুন সফল হরতাল পালনে ভূমিকা পালন করে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ সভা এবং প্রথম মিছিলটি বের করা হয় এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই। ‘৬৯-এর গণঅভ্যুথানে ১৪৪ ধারা ভেঙে প্রথম মিছিলটি বের করে জগন্নাথের ছাত্ররা। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অসংখ্য ছাত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। আজমল, শাহাবুদ্দিন, সিরাজের মতো অনেকে শহীদ হন। শিকদের মধ্যে শহীদ হয়েছিলেন অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ। বিজয়ের প্রাক-মুহূর্তে হানাদার বাহিনীর সহযোগী আল-বদরদের হাতে শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরদা, সন্তোষ ভট্টচার্যও ছিলেন এ প্রতিষ্ঠানের প্রাক্তন শিক।

মুক্তিযুদ্ধের সময় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসটিতে পাক হানাদার বাহিনী ক্যাম্প গড়ে তোলে। এ এলাকার বধ্যভূমি ও নির্যাতন কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার হয় ক্যাম্পাসটি। যুদ্ধের পর মাঠে একাধিক গণকবর আবিষ্কৃত হয়। শহীদদের স্মৃতি রার্থে ক্যাম্পাসে ‘মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি ও একাত্তরের গণহত্যা’ নামের একটি গুচ্ছ ভাস্কর্য নির্মিত হয়। ভাস্কর রাশা ও তার সহযোগীদের নিয়ে নির্মিত এ ভাস্কর্যটি দেশের প্রথম গুচ্ছ ভাস্কর্য।  

খ্যাতিমান শিক্ষার্থীরা

জগন্নাথ বিশ্বাবিদ্যালয়ের খ্যাতিমান শিক্ষার্থীদের মধ্যে আছেন ড. দীনেশ চন্দ্র সেন,  আতাউর রহমান খান, ড. আনিসুজ্জামান, কর্ণেল (অব.) শওকত আলী (বর্তমান ডেপুটি স্পিকার), রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজু (বর্তমান মন্ত্রী), শাহরিয়ার কবির, শেখ ফজলুল হক মনি, ব্রজেন দাশ, সাদেক হোসেন খোকা (মেয়র), ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম, কাজী ফিরোজ রশীদ, ডা. মোস্তফা জালাল মুহিউদ্দিন (সাংসদ), মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, নজরুল ইসলাম বাবু (সাংসদ), আলী ইমাম, প্রবীর মিত্র, এটিএম শামসুজ্জামান, ফকীর আলমগীর, হায়দার হোসেন (শিল্পী) ছাড়াও দেশে-বিদেশে বিখ্যাত অনেকে।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথও এ ক্যাম্পাসে এসেছিলেন। সংবর্ধনা পেয়েছেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। এ ক্যাম্পাসে শিক্ষকতা করেছেন দেশবরেণ্য লেখক, শিক্ষাবিদরা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগঠন

বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাশ ভবন বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের তৎপরতায় মুখর থাকে। সাংবাদিক সমিতি, বাঁধন, বিএনসিসি, রোভার স্কাউট, রেঞ্জার ইউনিট, উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী, বিশ্ববিদ্যালয় থিয়েটার, আবৃত্তি সংসদ, জবি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, ডিবেটিং সোসাইটিসহ ২৮টি বিভাগের নিজস্ব সংগঠন রয়েছে। তাছাড়া আছে বিভিন্ন আঞ্চলিক সংগঠন ।

বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার

গ্রন্থাগারটির রয়েছে ঘটনাবহুল ইতিহাস। স্বাধীনতার আগে তৎকালীন জগন্নাথ কলেজ থাকার সময়ে এটি সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার ছিল। ১৯২১ সালে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শতকরা ৫০ ভাগ বই দিয়ে সাজানো হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকবাহিনী ক্যাম্পাসে ক্যাম্প গড়ার পর এ গ্রন্থাগারের বইকে লাকড়ি হিসেবে ব্যবহার করেছে। সে সময় অনেক মূল্যেবান বই নষ্ট করে ফেলে পাকসেনারা। ১৯৭৫ সালের হিসাব মতে গ্রন্থাগারে বই ছিল প্রায় ৪০ হাজার। বর্তমানে ১৯ হাজার বই রয়েছে।

আবাসিক হল

বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২টি হল রয়েছে। তবে তার মধ্যে ১১টি হলই গত দুই যুগ ধরে অবৈধভাবে দখল করে রেখেছে স্থানীয় প্রভাবশালী, ভূমিদস্যু ও পুলিশ। তবে বিশ্ববিদ্যায় প্রশাসনের দাবি, তারা হলগুলো উদ্ধারে চেষ্টা করছে।

উপাচার্যের কথা
অধ্যাপক ড. মেসবাহ উদ্দিন আহমেদ বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন ২০০৯ সালে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিষয়ে তার মতামত:
‘বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নের জন্য আমরা মাস্টার প্ল্যান অনুযায় এগোচ্ছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নে সরকারের তরফ থেকে একশ কোটি টাকা পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। তা ইতিমধ্যে প্রি-একনেকে পাস হয়েছে বলে  জানা গেছে।
তাছাড়া কেরানীগঞ্জে বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় ক্যাম্পাস করার জন্য সরকারের কাছে একশ একর জায়গা পাওয়ার জন্য কাজ করে যাচ্ছি। ’

এক পলকে পরিচিতি

প্রতিষ্ঠাকাল: ২০ অক্টোবর ২০০৫
আয়তন: ১১.১১ একর।
অনুষদ: ৪টি
বিভাগ:২৮ টি
শিক: শিক্ষকের মোট পদ ৩৮০। বর্তমানে ১৮৭ (স্থায়ী) ও ১৮৭  (প্রেষণে) শিক্ষক আছেন ।
শিক্ষার্থী: ২৩ হাজার।
আবাসিক হল: ১২টি (বেদখলে ১১টি)
শিক্ষাদান পদ্ধতি: সব বিভাগে সেমিস্টার পদ্ধতি।
সাইবার সেন্টার: ১টি
ভাষা কেন্দ্র:১টি
গ্রন্থাগার: ১টি, সেমিনার ২৮টি।

বাংলাদেশ স্থানীয় সময় ১৩৫৫, অক্টোবর ১৯, ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।