‘বইয়ের মত এতো বিশ্বস্ত বন্ধু আর নেই’—বলেছিলেন আর্নেস্ট হেমিংওয়ে। একটা সময় বই ছিল মানুষের নিত্যসঙ্গী।
বয়সের ভারে নুয়ে পড়া শরীর, ক্ষীণ দৃষ্টি—তবু ছোট্ট একটি দোকানে সাজানো হাজারো পুরানো বইয়ের মাঝ থেকে পাঠকের প্রয়োজনীয় বই খুঁজে বের করে হাতে তুলে দেন অবলীলায়। অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় ধরে এই কাজটিকেই জীবনের ব্রত করে নিয়েছেন তিনি।
ঢাকার নীলক্ষেতের এক সরু গলির আলো-আঁধারিতে দাঁড়িয়ে থাকা তার দোকান ‘শাহজাহান সেবা বুক শপ’। ঝকঝকে কোনো সাইনবোর্ড নেই। কিন্তু বইপ্রেমীদের কাছে এটি এক সুপরিচিত ঠিকানা। দোকানের মালিক শাহজাহান মিয়া, যিনি সবার কাছে পরিচিত ‘শাহজাহান মামা’ নামে।
ছোট্ট দোকানটি যেন পুরোনো দিনের এক টুকরো জাদুঘর। পাঠ্যবই, সাহিত্য, অনুবাদ, ইতিহাস, ধর্ম, দর্শন—কী নেই এখানে! এমনকি অর্ধশতাব্দী আগের অনেক দুষ্প্রাপ্য বইও রয়েছে তার যত্নের সংগ্রহে। ছেঁড়া-ফাটা বইগুলো নিজ হাতে মেরামত করে মোড়ক দিয়েছেন, প্রতিটি বইয়ের নাম নিজ হাতে লিখে রেখেছেন, যেন কোনো স্মৃতিও হারিয়ে না যায়।
‘দরকারি পুরোনো বই, যা প্রায় দুষ্প্রাপ্য তা পাঠকের হাতে তুলে দেওয়া আমার কর্তব্য, এটাকে একপ্রকার সেবা হিসেবেই দেখি,’ বলেন শাহজাহান মিয়া। তাই তো দোকানের নামের সঙ্গেও যুক্ত করেছেন ‘সেবা’ শব্দটি।
হাজার হাজার বইয়ের মাঝে তিনি নিজেও কখনো ভুলে যান তার সংগ্রহের বিশাল সম্ভারে কোন কোন রত্ন আছে! জায়গার অভাবে এক বইয়ের ওপর আরেক বই—দোকানের ভেতরে যেন ছোট ছোট বইয়ের পাহাড় গড়ে উঠেছে। তার নিজের বসার জায়গাটুকুও সামান্য। তবু যখন কেউ পুরোনো বই বিক্রি করতে আসে, তিনি যেন শিশুর মতো আনন্দে উচ্ছ্বসিত হন। চিরচেনা হাসিতে বলেন, ‘পুরোনো বই কেনা আমার নেশা। ’
একসময় শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে বইপাগল পাঠকরা ভিড় করত শাহজাহান মিয়ার দোকানে। পুরোনো বইয়ের সন্ধানে তাদের শেষ ভরসা ছিলেন তিনি। এখনো অনেকে আসেন, তবে সংখ্যাটা আগের তুলনায় অনেক কম।
বইয়ের জায়গা দখল করে নিয়েছে মোবাইল ফোনসহ নামি-দামিসহ ডিভাইস। ডিজিটাল ডিভাইসের সঙ্গে মানুষের সখ্য বাড়ার বিপরীতে বইয়ের সঙ্গে দূরত্ব বেড়েছে বলে মনে করেন শাহজাহান মিয়া।
নিজের বই পড়ার নেশা থেকেই বইয়ের ব্যবসায় আসা ‘শাহজাহান মামা’র। অবসর সময়ে এখনো দোকানের কোণে বসে ডুবে থাকেন বইয়ের জগতে। অর্ধশতকে কত বই পড়েছেন তার কোনো হিসাব নেই। আধুনিক যুগের সঙ্গে তিনি অনেকটাই দূরত্ব বজায় রেখেছেন। ব্যবহার করেন না কোনো মোবাইল ফোনও। বইয়ের রাজ্যে চুপচাপ তার দিন কেটে যায়। শুধু কেউ বই কিনতে এলেই প্রাণচঞ্চল হয়ে ওঠেন তিনি, এগিয়ে দেন ক্রেতার কাঙ্ক্ষিত বই।
তার নিঃসঙ্গতা, স্মৃতি, আর ভালোবাসা—সবকিছুই আবর্তিত হয় বইকে কেন্দ্র করে।
শাহজাহান মিয়ার মতো মানুষেরা আছেন বলেই হয়তো এই শহরে আজও টিকে আছে পুরোনো বইয়ের ঘ্রাণ, অক্ষরের মায়া। আজও মানুষ হয়তো পুরোনো বইয়ে আবেগে ভাসে, নস্টালজিয়ায় ডুবে যায়। সময় পেলে পুরোনো বইয়ের খোঁজে বেরিয়ে পড়ে, আর ‘শাহজাহান মামা’রা সেসব বই যত্নে আগলে রাখেন, পুরোনো পাতার পাহারাদার হয়ে।
বাংলাদেশ সময়: ২০৩৯ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৭, ২০২৫
এইচএ/