ঋতুচক্রে বাংলাদেশ বারবার নিজেকে নতুন সাজে সাজিয়ে তোলে। গ্রীষ্মের প্রখর রোদ্দুর, বর্ষার শেষে যখন প্রকৃতি এক নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ পায়, তখনই আবির্ভাব ঘটে শরতের।
দিগন্তজুড়ে ভেসে বেড়ায় সাদা তুলোর মতো মেঘের ভেলা। কখনো সেই মেঘ পাহাড়ের রূপ নেয়, কখনো বা ছড়িয়ে পড়ে তুলোর স্তূপের মতো। এই দৃশ্য যেন এক অনবদ্য কল্পনার জগৎ, যেখানে আকাশ-পৃথিবী মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। শরতের নির্মল আকাশ মনকে দেয় অনাবিল প্রশান্তি।
শরতের শেষদিকে সকাল শুরু হয় শিশিরভেজা ঘাসে হাঁটার অনুভূতি দিয়ে। তখন প্রকৃতির প্রতিটি কোণে এক অন্যরকম স্নিগ্ধতা বিরাজ করে। নগরের কোলাহল থেকে দূরে, গ্রামীণ প্রান্তরে শরতের আসল রূপ উন্মোচিত হয়। মাঠে কাশফুলের ঢেউ খেলে যায়, নদীর ধারে দুলতে থাকে সাদা রঙের কাশের সারি। মনে হয় প্রকৃতি তার সবচেয়ে কোমল রূপে সাজিয়ে তুলেছে বাংলার বুক।
শরতের ফুল, সুবাস ও সাংস্কৃতিক আবহ
শরতের সঙ্গে জড়িয়ে আছে শিউলি ফুলের গল্প। প্রভাতের প্রথম আলোতে, মসজিদের পাশে বা গ্রামের উঠোনে শিশিরে ভেজা সাদা-কমলা রঙের শিউলি পড়ে থাকে। ফজরের নামাজ শেষে যখন মানুষ ঘরে ফেরে, শিউলির সেই মিষ্টি সুবাস হৃদয় ভরিয়ে তোলে। এই ফুলকে ঘিরে রচিত হয়েছে অসংখ্য কবিতা, গান আর কাব্য। যেন এই ছোট্ট ফুলের মাঝেই লুকিয়ে আছে শরতের আসল সৌন্দর্য্।
শুধু শিউলি নয়, শরতের কাশফুলও প্রকৃতিকে ভিন্ন সৌন্দর্যে ভরিয়ে তোলে। নদীর পাড় ধরে কিংবা খোলা মাঠে যখন কাশফুল ঝকঝক করে ওঠে, তখন মনে হয় প্রকৃতি এক স্বর্গীয় দৃশ্যপট সাজিয়েছে। এই দৃশ্য নাগরিক কোলাহল থেকে দূরে মানুষকে টেনে নিয়ে যায় এক নিরিবিলি, শান্তিপূর্ণ জগতে।
বাংলাদেশের সংস্কৃতিতেও শরতের আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। এই ঋতুতেই সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় উৎসব দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়। নদীর ধারে, গ্রামের মাঠে কিংবা শহরের পূজা মণ্ডপে উৎসবের আমেজে শরতের সাংস্কৃতিক আবহ ছড়িয়ে পড়ে। শরৎ যেন কেবল প্রকৃতির রূপেই নয়, মানুষের আনন্দ-উৎসবের মাধ্যমেও জীবন্ত হয়ে ওঠে।
গ্রামবাংলার প্রকৃতি ও জীবনের চলন
গ্রামবাংলার মেঠো পথ ধরে হাঁটলে সেই বাতাস শরীরে এসে লাগে, যেন প্রকৃতি আলতো করে ছুঁয়ে দিচ্ছে। ফসলের মাঠে ধান গাছগুলো সবুজ থেকে ধীরে ধীরে সোনালি হয়ে ওঠে। বাতাস বয়ে গেলে সেই ধানক্ষেত ঢেউয়ের মতো দুলে ওঠে। মনে হয় যেন কৃষকের স্বপ্ন গোপনে হাসে মাঠের বুকজুড়ে।
এই সময় গ্রামবাংলার দৃশ্য আরও প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। নদী ও খালগুলো বর্ষার উত্তাল ধারা হারিয়ে শান্ত ও স্থির হয়ে আসে। নৌকায় জেলে মাছ ধরে, কৃষক জমি চাষে ব্যস্ত থাকে। এই গ্রামীণ জীবনচিত্র শরতের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সঙ্গে মিশে এক অপূর্ব চিত্রশিল্প তৈরি করে।
মাঠ, নদী, গাছপালা সব মিলিয়ে শরতের একটি আলাদা সত্তা ফুটে ওঠে। নাগরিক জীবনেও শরতের প্রভাব অস্বীকার করার উপায় নেই। শহরের পার্ক, বাগান কিংবা রাস্তার ধারে শরতের আকাশ আর বাতাস মানুষকে আলাদা প্রশান্তি দেয়।
শরতের দার্শনিক বার্তা ও জীবনের শিক্ষা
শরৎ শুধু প্রকৃতি বা উৎসবেই সীমাবদ্ধ নয়, এটি মানুষের জীবনে বয়ে আনে দার্শনিক এক বার্তা। বর্ষার মেঘ, কাদামাটি ও বিষণ্ণতার পর শরতের নির্মলতা আমাদের শেখায় জীবনের প্রতিটি কঠিন সময়ের পরও আসে নতুন দিন, আসে নতুন আলো। শরতের মতো আমাদের জীবনেও শান্তি ও আনন্দের ঋতু অপেক্ষা করে থাকে।
শরৎ আমাদের মনে করিয়ে দেয় নবজীবনের কথা। প্রকৃতি যখন ধুলো-কাদামাটি ধুয়ে পরিষ্কার হয়, তখন সে নতুন রঙে সেজে ওঠে। তেমনই মানুষও জীবনের ক্লান্তি ও দুঃখ কাটিয়ে নতুন করে শুরু করতে পারে। শরৎ যেন প্রকৃতির পক্ষ থেকে মানুষের উদ্দেশ্যে এক বার্তা- ‘হতাশার অন্ধকার ভেদ করেই আশা ও শান্তির আলো জন্ম নেয়। ’
বাংলাদেশের শরৎ তাই শুধু ঋতু নয়, এটি আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, আমাদের স্মৃতি ও কাব্যের এক অম্লান অংশ। কাশফুলের সাদা ঢেউ, শিউলির সুবাস আর নীল আকাশের অসীমতা- সবকিছু মিলেই শরৎকে করে তোলে অনন্য। প্রকৃতির প্রতিটি পরিবর্তনেই লুকিয়ে আছে জীবনের গভীরতম সৌন্দর্য।
ইব্রাহীম জাহিদ, গণমাধ্যমকর্মী।