ঢাকা, মঙ্গলবার, ১ আশ্বিন ১৪৩২, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ২৩ রবিউল আউয়াল ১৪৪৭

ফিচার

ক্যান্সার চিকিৎসায় যুগান্তকারী আবিষ্কার

‘মুস্তাফা (সা.) পুরস্কার’ পেলেন ইরানের নারী বিজ্ঞানী

আশরাফুর রহমান, তেহরান থেকে | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮:১৪, সেপ্টেম্বর ১৬, ২০২৫
‘মুস্তাফা (সা.) পুরস্কার’ পেলেন ইরানের নারী বিজ্ঞানী মুস্তাফা (সা.) পুরস্কার হাতে ড. সেপিদেহ মির্জায়ী-ভারযেগানি

ক্যান্সার চিকিৎসার ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ হলো ‘ওষুধ প্রতিরোধ’ (Drug Resistance)। রোগীরা প্রথমে চিকিৎসায় সাড়া দিলেও কিছুদিন পর টিউমার নতুন কৌশলে প্রতিরোধ গড়ে তোলে, ফলে চিকিৎসা ব্যর্থ হয়ে যায়।

এই দীর্ঘদিনের অচলাবস্থায় নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছেন ইরানি তরুণ বিজ্ঞানী ড. সেপিদেহ মির্জায়ী-ভারযেগানি।

তিনি আণবিক জীববিজ্ঞানের জটিল সংকেতপথ এবং নন-কোডিং আরএনএ নিয়ে গবেষণা করে দেখিয়েছেন, ক্যান্সার কোষকে আবারও ওষুধের প্রতি সংবেদনশীল করা সম্ভব। এই যুগান্তকারী আবিষ্কারের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি পেয়েছেন মুসলিম বিশ্বের নোবেলখ্যাত সম্মান—‘মুস্তাফা (সা.) পুরস্কার’।

পুরস্কারের মর্যাদা ও ইতিহাস

২০১২ সালে ইরানে চালু হওয়া ‘মুস্তাফা পুরস্কার’ মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্মাননাগুলোর একটি। পুরস্কারের নাম ‘মুস্তাফা’ ইসলামের মহানবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তাফা (সা.)-এর সম্মানার্থে রাখা হয়েছে।

২০১৫ সাল থেকে এই পুরস্কার প্রতি দুই বছর অন্তর তিনটি বিভাগে দেওয়া হচ্ছে: ‘জীবন ও চিকিৎসা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি’, ‘তথ্য ও যোগাযোগ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি’ এবং ‘মৌলিক ও প্রকৌশল বিজ্ঞান’। পুরস্কারের আর্থিক মূল্যমান ৫ লাখ ডলার, যা দেওয়া হয় এমন বৈজ্ঞানিক সাফল্যকে, যা মানবজীবন উন্নত করে, জ্ঞানের সীমানা প্রসারিত করে বা নতুন গবেষণাপদ্ধতি প্রবর্তন করে।

২০২৩ সাল থেকে ‘মুস্তাফা পুরস্কার’-এ চালু হয়েছে নতুন একটি বিভাগ— ‘যুব বিজ্ঞানী পদক’। এর লক্ষ্য ৪০ বছরের কম বয়সী প্রতিভাবানদের স্বীকৃতি দেওয়া, যাদের গবেষণা মানবকল্যাণে প্রত্যক্ষ অবদান রাখে। এই পদক চালুর উদ্যোগ নেন ‘মুস্তাফা পুরস্কার’ বিজয়ী দুই বিশিষ্ট বিজ্ঞানী— প্রফেসর উগুর সাহিন ও প্রফেসর ওমিদ ফারোখজাদ— যারা তাঁদের প্রাপ্ত পুরস্কারের অর্থ দান করেছিলেন।

মুস্তাফা পুরস্কারের বৈজ্ঞানিক কমিটির প্রধান আলী আকবর সালেহি বলেন, “তরুণ বিজ্ঞানীদের সম্মান জানানো কেবল প্রশংসা নয়, বরং এটি এক বিনিয়োগ— যা ইসলামি সভ্যতার পুনর্জাগরণের বার্তা বহন করে। ”

তাঁর ব্যাখ্যা অনুযায়ী, এবারের বাছাই প্রক্রিয়া ছিল অত্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক। সচিবালয়ে জমা পড়ে মোট ১,০০২টি বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত নথি—তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিতে ২০৭টি, জৈবিক ও চিকিৎসা বিজ্ঞানে ৮১টি এবং মৌলিক ও প্রকৌশলে ৭১৪টি। প্রতিটি যুব বিজ্ঞানী পদক বিজয়ীকে দেওয়া হয়েছে একটি সনদপত্র ও ১০ হাজার ডলার অর্থ পুরস্কার।

সালেহি জোর দিয়ে বলেন, মুস্তাফা পুরস্কার শুধু স্বীকৃতির মঞ্চ নয়, বরং এটি বিজ্ঞানীদের মধ্যে জ্ঞান বিনিময় ও সহযোগিতার এক গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্মে পরিণত হয়েছে। এই পুরস্কারের জন্য বিজয়ীদের নির্বাচন করা হয় সতর্কতার সঙ্গে এবং কোনো পক্ষপাত ছাড়াই। এ কারণেই আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এটি ক্রমশ স্বীকৃতি পাচ্ছে। ”

তিনি আরও জানান, ভবিষ্যতে মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন রাজধানীতে এই পুরস্কার প্রদানের অনুষ্ঠান আয়োজনের পরিকল্পনা চলছে, যাতে পুরস্কারের প্রভাব ও বিস্তার আরও বাড়ে।

মুস্তাফা মেডেল: শিল্প, ঐতিহ্য ও প্রতীক

মুস্তাফা পুরস্কারের মেডেল নিজেই একটি শিল্পকর্ম ও প্রতীকী বার্তা বহন করে। ৭০০ গ্রাম ওজনের ৯২৫ স্টার্লিং সিলভার দিয়ে তৈরি এই ১১ × ৯ সেন্টিমিটার আকারের মেডেলে রয়েছে ২৪ ক্যারেট সোনার প্রলেপ এবং কেন্দ্রে বসানো ২০ ক্যারেটের লাল ইয়েমেনি আকিক। মেডেলে খোদাই করা অ্যাস্ট্রোলাবের নকশা ইসলামের স্বর্ণযুগের বৈজ্ঞানিক কৃতিত্বের প্রতীক, যা জ্যোতির্বিদ্যায় মুসলমানদের ঐতিহাসিক অবদানের স্মারক। আকিক ব্যবহারের ঐতিহ্যও গভীরভাবে ইসলামি সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত—হাদিসে এ পাথরকে সৌভাগ্য ও সুরক্ষার প্রতীক বলা হয়েছে। মেডেলের নকশায় বৃত্ত আকার অনন্ত ও বিজ্ঞান-জগতের সীমাহীনতার ধারণা প্রকাশ করে। ফারসি, আরবি ও ইংরেজি ভাষায় উৎকীর্ণ “Mustafa Prize” নামটি এর আন্তর্জাতিকতাকে নির্দেশ করে, আর প্রতিটি মেডেলে লরিয়েটের নাম খোদাই করে রাখা হয়। সোনালি রং ও গম্বুজাকৃতি নকশা ইসলামী স্থাপত্য ও শিল্প-ঐতিহ্যের প্রতিফলন করে।

মির্জায়ী-ভারযেগানির গবেষণার মূল সাফল্য

তেহরানের ইসলামিক আজাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের সায়েন্স অ্যান্ড রিসার্চ শাখায় সেল অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টাল বায়োলজির সহকারী অধ্যাপক মির্জায়ী-ভারযেগানি অনকোলজির সবচেয়ে জটিল সমস্যাগুলোর একটি অর্থাৎ ‘ওষুধ প্রতিরোধ’ নিয়ে কাজ করেছেন।

এ সম্পর্কে তিনি বলেন, “ক্যান্সার রোগীরা প্রথমে চিকিৎসায় ভালো সাড়া দেন। কিন্তু কয়েক দফা চিকিৎসার পর টিউমারগুলো মানিয়ে নেয় এবং প্রতিরোধী হয়ে ওঠে। তখন একসময়কার কার্যকর ওষুধ আর কাজ করে না। ”

তাঁর গবেষণা কেন্দ্রীভূত NF-κB নামের একটি শক্তিশালী নিউক্লিয়ার ফ্যাক্টরের ওপর, যা শরীরের ৪০০টিরও বেশি জিন নিয়ন্ত্রণ করে। এটি ভারসাম্যপূর্ণ থাকলে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা ও প্রদাহ নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হয়। কিন্তু অতিসক্রিয় হলে এটি ক্যান্সার বৃদ্ধিতে জ্বালানি জোগায়, টিউমার ছড়িয়ে দেয় (মেটাস্টেসিস) এবং ওষুধ প্রতিরোধ সৃষ্টি করে।

নতুনত্ব এসেছে এই পথকে ‘নন-কোডিং আরএনএ’-র সঙ্গে যুক্ত করার মাধ্যমে। দীর্ঘদিন এগুলোকে ‘অপ্রয়োজনীয় জিন’ মনে করা হলেও, এখন প্রমাণ হয়েছে যে এই আরএনএ, বিশেষ করে মাইক্রোআরএনএ (miRNA), মূল সুইচের মতো কাজ করে। কিছু miRNA NF-κB বন্ধ করে ক্যান্সার কোষকে চিকিৎসার প্রতি সংবেদনশীল করে তোলে, আবার কিছু এটিকে সক্রিয় করে প্রতিরোধ বাড়ায়।

মির্জায়ী গবেষণায় আরও যুক্ত করেছেন ‘লং নন-কোডিং আরএনএ (lncRNA)' ও  ‘সার্কুলার আরএনএ (circRNA)’, যেগুলো miRNA-এর সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করে এক জটিল আণবিক নেটওয়ার্ক তৈরি করে। এগুলো একত্রে NF-κB-এর আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে, যা নির্ধারণ করে টিউমার সংকুচিত হবে নাকি ছড়িয়ে পড়বে।

তিনি বলেন: “অতিসক্রিয় NF-κB হলো যেন ক্যান্সারের জন্য ট্রিগার টানা—রক্তনালী তৈরি থেকে মেটাস্টেসিস পর্যন্ত। যদি আমরা নন-কোডিং আরএনএর সাহায্যে এই ট্রিগারকে নীরব করতে পারি, তাহলে ক্যান্সারের অগ্রগতি থামানো সম্ভব। ”

তাঁর গবেষণা প্রমাণ করেছে, অনেক বিদ্যমান ক্যান্সারবিরোধী ওষুধ আরও কার্যকর হতে পারে যদি আরএনএ-ভিত্তিক থেরাপির সঙ্গে প্রয়োগ করা যায়। যেমন NF-κB দমনকারী miRNA বৃদ্ধির মাধ্যমে ওষুধ প্রতিরোধ ভেঙে রোগীর আয়ুষ্কাল বাড়ানো সম্ভব।

নতুন প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরণা

সেপিদেহ মির্জায়ী-ভারযেগানির আবিষ্কার কেবল টিউমার নিয়ন্ত্রণ নয়, বরং ক্যান্সার চিকিৎসায় ওষুধ প্রতিরোধ ভাঙার নতুন দিক উন্মোচন করেছে। তাঁর গবেষণা ভবিষ্যতে স্মার্ট ও নির্ভুল ক্যান্সার থেরাপির ভিত্তি হয়ে উঠতে পারে।

এটি প্রমাণ করেছে, মুসলিম বিশ্বের তরুণ বিজ্ঞানীরাও বৈশ্বিক গবেষণায় বড় অবদান রাখতে সক্ষম— যা পরবর্তী প্রজন্মকে বিজ্ঞানের প্রতি অনুপ্রাণিত করবে।

এবার ‘মুস্তাফা পুরস্কার’ পেলেন যাঁরা

মির্জায়ী-ভারযেগানির পাশাপাশি আরও দুই তরুণ বিজ্ঞানী এ বছর যুব বিজ্ঞানী পদকে ভূষিত হয়েছেন। তারা হলেন- আবুধাবির খলিফা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিক্যাল ও পেট্রোলিয়াম ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক পাউ-লোক শো এবং  ইস্তাম্বুলের কচ বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের প্রভাষক ড. বুসে জেভাতেমরে ইয়িলদিরিম।

এছাড়া ৬ষ্ঠ মুস্তাফা পুরস্কারের মূল বিজয়ী হয়েছেন তিনজন। মাইক্রোফ্লুইডিক প্রযুক্তির মাধ্যমে দ্রুত টিউমার কোষ বিচ্ছিন্ন করার জন্য তুরস্কের মেহমেত টোনার, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অ্যালগরিদমে অবদানের জন্য ইরানের ওহাব মিররোকনি এবং সৌরকোষ প্রযুক্তি বিশেষ করে পেরোভস্কাইট সেলে অবদানের জন্য ভারতের মোহাম্মদ নাজিরউদ্দিন।

এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।