ঢাকা, শনিবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফিচার

চর নয়, নিরাপদ শুঁটকির বিছানা

জেসমিন পাপড়ি, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১১২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৯, ২০১৫
চর নয়, নিরাপদ শুঁটকির বিছানা ছবি: কাশেম হারুন / বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

দুবলার চর থেকে ফিরে: লইট্যা, রুপচাঁদা, কোরাল, লাক্ষ্যা, ছুরি, ফাইস্যা, ছিটকিরি, চাপা, হাঙ্গর, পোপা, রাঙাচকি, কামিলা, মাইট্যা, কালো চান্দা, সুন্দরীসহ অন্তত শত প্রজাতির মাছের বিছানায় পরিণত হয়েছে সুন্দরবনের পাশের ছোট্ট একটি দ্বীপ দুবলার চর। বঙ্গোপসাগরের বুকে কুঙ্গা এবং মরা পশুর নদীর মোহনায় জেগে ওঠা এ চরে এখন শুঁটকি তৈরির মৌসুম।



দিন রাত এক করে শত শত জেলে পরিবার এখন প্রাকৃতিক উপায়ে শুঁটকি তৈরির কাজে ব্যস্ত। আপাতদৃষ্টিতে যা দুবলাকে চর নয়, নিরাপদ শুঁটকির বিছানা করে তুলেছে।

বিকেল হতেই সাগরের বুকে জাল ফেলেন সারি সারি নৌকার জেলেরা। সারা রাত ধরে তাতে মাছ ওঠে। ভোর রাত থেকে শুরু হয় জাল তোলার কাজ। তাতে যে মাছ ওঠে তা নিয়ে জেলেরা হাজির হন দুবলার চরে। এরপর আরেকদল মৎসজীবী মাছগুলোকে নিয়ে চাতালে (মাঠে) ঢেলে কেটে রোদে দেন। মাত্র তিনদিনের কড়া রোদেই শুঁটকিগুলো বিক্রির উপযোগী হয়ে ওঠে। কোনো ধরনের রাসায়নিকের ব্যবহার ছাড়াই প্রাকৃতিক উপায়ে তৈরি এ শুঁটকি সম্পূর্ণ নিরাপদ।

সুন্দরবন ও দুবলার চর এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বনের গাছগুলো ফুঁড়ে সুর্যের আলো বের হয়ে আসার আগেই দুবলার চরের ঘাটে হাজির হয় শত শত নৌকা। দূর থেকে নৌকাগুলোর বুকে রুপালি আভার ছোট টিলা মনে হলেও সেগুলো আসলে জেলেদের সারা রাতের অর্জন সাগরের নানা প্রজাতির মাছ। যে নৌকায় মাছের
টিলাটির উচ্চতা বেশি, সে নৌকার মাঝিদের হাসিও যেন একটু বেশি চওড়া।

মাছের নৌকা ঘাটে ভেড়ানোর সঙ্গে সঙ্গেই সেখানে অপেক্ষায় থাকা সঙ্গীরা মাছগুলোকে নামিয়ে নেন। দ্রুতই সেগুলো নিয়ে তারা হাজির হন যার যার নির্দিষ্ট চাতালে। সেখানে অপেক্ষায় থাকেন আরো কয়েকজন শ্রমিক। তাদের কাজ মাছগুলো বেছে এবং কেটে শুকাতে দেওয়া। মাছের আকৃতি ও প্রকার অনুযায়ী কোনোটা মাচায়, কোনোটা কাঠে বা দড়িতে ঝুলিয়ে, কোনো কোনো মাছ আবার মাঠে শুকাতে দেওয়া হয়।

দুবলার চরে যেদিক থেকেই প্রবেশ করা হোক না কেন, পুরো চরটাকে মনে হবে যেন শুঁটকির বিছানা। সাগরের তীরেও লক্ষ্য করা যায় শুঁটকির চাতাল। প্রতিটি চাতাল পাহারা দেওয়ার ঘরও তৈরি করা হয় বেশ উঁচু করে। যাতে উঁচুতে বসেই বিরাট আয়তনের সেসব চাতালের দিকে লক্ষ্য রাখা যায়।

জেলেদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্ষা মৌসুমের ইলিশ শিকারের পর বহু জেলে কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, বাগেরহাট, পিরোজপুর, খুলনা ও সাতক্ষীরা থেকে এসে পাঁচ মাসের জন্য সাময়িক বসতি গড়েন দুবলার চর নামক এই জেলে গ্রামে। প্রতি বছর অক্টোবর মাসের প্রথমার্ধে শুরু হয় শুঁটকি আহরণ। মৌসুম থাকে পরবর্তী পাঁচ মাস। বন বিভাগের অনুমতি নিয়ে মৌসুমের শুরুতেই চরে এসে শুঁটকি শুকানোর চাতাল এবং থাকার জন্য কুঁড়েঘর তৈরি করেন জেলেরা। মৌসুমজুড়ে এ চরই হয়ে ওঠে তাদের অস্থায়ী সংসার। পুরো সময়টা সাগরে মাছ ধরা আর সেসব মাছের শুঁটকি বানানোর কাজে ব্যস্ত থাকেন জেলেরা। এখান থেকে আহরিত শুঁটকি চট্টগ্রামের আসাদগঞ্জের পাইকারি বাজারে মজুদ ও বিক্রি করা হয়।

তবে এ বছর মৌসুম শুরুর কয়েক সপ্তাহ পরে বনে প্রবেশের অনুমতি মিলেছে জেলেদের। যার কারণে কিছুটা লোকসানের সম্মুখীন হওয়ার আশঙ্কার কথা জানান তারা। বিভিন্ন চাতাল ঘুরে দেখা যায় নানা প্রজাতির সব মাছ। পেশাদার জেলেরা মাছ ধরলেও মাছ শুকানোর কাজ করেন মাছ ধরায় অপেক্ষাকৃত অদক্ষ শ্রমিকরা। তবে সে কাজও নিতান্ত সহজ নয়। রোদে পুড়ে মাছ কাটা, রোদে দেওয়া, রোদে মাছ নাড়া-চাড়া করা, শুকনো মাছ তোলা- এসব কাজেই দিন পার হয়ে যায় তাদের।

কয়রা থেকে আসা জেলে রশিদ শেখ বাংলানিউজকে বলেন, ‘মৌসুমের শুরুতে এখানে আইছি। মাছ নিয়ে থাকতে থাকতে সময় কখন চলে যায় বুঝতি পারিনে। এ বছরে একটু দেরিতে বনে ঢোকার অনুমতি পাইছি। তবে শুরুর দিকে মাছও পাচ্ছি ভালো। পুরো মৌসুম এমন মাছ পেলি ব্যবসা মন্দ যাবে না। তবে জালে মাছ না এলে মৌসুম শেষে দেনাও শোধ করতে পারবো না’। দেখা যায়, দুবলার চরে ঘুরতে আসা পর্যটকরাও শুঁটকি কিনে নিচ্ছেন চাতাল থেকেই।

জেলেরা জানান, এখানে কোনো জেলেই মাছ শুকানোর আগে বা পরে কোনো ধরনের রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করেন না। ফলে এসব শুঁটকিতে কোনো ক্ষতিকারক দ্রব্য নেই। এই চরে মাছ শুকানোর পর নির্ধারিত ঘরে শুঁটকি জমানো হয়। মৌসুম শেষে বা মৌসুমের মাঝামাঝি সময় থেকে সেগুলো দ্রুত চট্টগ্রামে পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু করা হয়।

তবে এ বছর বন বিভাগ মাত্র আট হাত প্রস্থ আর ১৬ হাত দৈর্ঘ্যের ঘর করার অনুমতি দেওয়ায় সেসব ছোট ঘরে মানুষ ও মালামালের জায়গা কোনোভাবেই হচ্ছে না বলে অভিযোগ করেন জেলেরা।

কুতুবদিয়া থেকে আসা ফারুক বলেন, ‘জেলেদের জন্য সরকার একটার পর একটা কঠিন নিয়ম করছে। সামান্য কয়েক মাসের জন্য চরে আসি আমরা। এখানে বিলাসিতা করার জন্য নয়, মাছ ধরে শুঁটকি জোগাড় করাই আমাদের কাজ। কুঁড়েঘরগুলো আমরা বানাই নিজেদের থাকা আর শুকানো মাছ রাখার কাজে। কিন্তু তাতেও সরকার এবার ঘরের সাইজ নির্ধারণ করে দিয়েছে। এতো ছোট ঘরে মাছ রাখার পর শ্রমিক বা জেলেদের জায়গা হওয়া খুব কঠিন। চার পাত পা মেলে দিয়ে ঘুমাতেও পারি না আমরা’।

বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, দুবলার চর থেকে সরকার নিয়মিত হারে রাজস্ব পেয়ে থাকে। প্রতি বছর বিএলসি বা বোট লাইসেন্স সার্টিফিকেট, ডিএফসি বা ডেইলি ফুয়েল (জ্বালানি কাঠ) কন্যাম্পশন ইত্যাদি প্রক্রিয়ায় বন বিভাগকে রাজস্ব প্রদান করে মৎস্য ব্যবসায়ীরা সুন্দরবনে ঢোকার অনুমতি পান। এছাড়া আহরিত শুঁটকি মাছ পরিমাপ করে নিয়ে ফিরে আসার সময় মাছভেদে  নির্ধারিত রাজস্ব দেন তারা।

বাংলাদেশ সময়: ০০৫০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৯, ২০১৫
জেপি/এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।