ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফিচার

দুর্ভাগা সিরাজের ভাগ্যলিপি

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৫৭ ঘণ্টা, জুন ১৮, ২০১৭
দুর্ভাগা সিরাজের ভাগ্যলিপি নবাব সিরাজউদ্দৌলার সমাধি

২৩ জুন ১৭৫৭ সাল। কয়েক ঘণ্টার ‘তথাকথিত-যুদ্ধ’ নামের প্রহসনে পাল্টে গেল বাংলার এবং দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক ভাগ্য। যুদ্ধের বহুমাত্রিক রাজনৈতিক ধারার ঐতিহাসিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে পলাশীর ২৬০ বছর পূর্তিতে পূর্বাপর ঘটনাপ্রবাহ তুলে ধরছেন বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম-এর কন্ট্রিবিউটিং এডিটর ড. মাহফুজ পারভেজ। পড়ুন সপ্তম পর্ব

করুণ মৃত্যুর পর নির্যাতন আর মিথ্যাচার কবলিত নবাব সিরাজ জীবনকালেও ছিলেন দুর্ভাগ্যের অসহায় শিকার। বাংলার শেষ নবাব তরুণ সিরাজউদ্দৌলা উত্তরাধিকারের অংশ হিসাবেই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা যেমন পেয়েছিলেন,  ক্ষমতার রাজনীতি ও প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের ধারাবাহিকতাও লাভ করেছিলেন।

চক্রান্তের ঘূর্ণাবতে দুর্ভাগা সিরাজের ভাগ্যলিপি আবর্তিত হয়েছিল।

প্রসঙ্গত বলা সঙ্গত, সিরাজের ক্ষমতা গ্রহণের আগে থেকেই তৎকালীন বাংলার রাজনীতিতে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার ষড়যন্ত্রমূলক ধারা চলছিল। আন্তঃদ্বন্দ্ব ও ষড়যন্ত্রে শেষ পর্যন্ত যিনি বিজয়ী হয়েছেন, তিনিই ক্ষমতার মূল জায়গাটি দখল করতে পেরেছেন। সিরাজের দুর্ভাগ্য এই যে, ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে গৃহীত তার পদক্ষেপগুলো সফল হয় নি। বরং ষড়যন্ত্রীরাই রাজনৈতিকভাবে সিরাজের ওপর টেক্কা দিতে সমর্থ হয়েছিল। যে কারণে বিপুল সামরিক শক্তি থাকার পরও সিরাজ যুদ্ধ নামের প্রহসনে নিদারুনভাবে পরাজিত হন। তার রাজনৈতিক পরাজয়ই তার সামরিক পরাজয় ডেকে আনে।

তৎকালীন বাংলার রাজনীতিতে বিরাজমান ষড়যন্ত্রমূলক রাজনৈতিক ধারা বুঝতে হলে কিছুটা পেছনে ফিরে তাকাতে হয়। নবাব আলীবর্দী খান মহবত জং যখন মারা যান তখন জয়েন উদ-দীন আহমদ খানের পুত্র, আলীবর্দীর দৌহিত্র সিরাজউদ্দৌলা বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার নিজামতের মসনদে বসেন। আলীবর্দী জীবিতকালেই সিরাজকে তাঁর উত্তরাধিকারী ঘোষণা করেছিলেন, নানাভাবে প্রশিক্ষিত করেছিলেন এবং সিরাজকে নিজামতের মসনদে বসিয়ে আলীবর্দী নিজে এবং দরবারের অন্য আমিরদের আনুগত্য দেখিয়েছিলেন ও উপহার দিয়েছিলেন। আলীবর্দী জীবিত থাকাকালে কেউ সিরাজকে ক্ষমতায় বসানোর সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে টু শব্দটিও করেন নি। আনন্দিত চিত্তে সকলেই নবাব আলীবর্দী খানের সিদ্ধান্ত মেনে সিরাজকে মান্য করেছিলেন।  মীর জাফর ও তার ‍পুত্র মীর মিরন ১৭৫৭ সালে ইউলিয়াম ওয়াটস এর কাছে চুক্তিপত্র দিচ্ছেন।

কিন্তু পলাশীর পর ইংরেজের ভাড়া করা লেখকরা জানাচ্ছেন যে, সিরাজ ঔদ্ধত্য ও দাম্ভিকতা দেখাতেন। এ অভিযোগের ব্যাপারে সমকালীন অন্যান্য ঐতিহাসিক (যারা সিরাজ পরবর্তী ইংরেজ শাসকদের অনুগ্রহভাজন ছিলেন) একই মত পোষণ করেছেন। যেমন, ‘ইব্রাত-ই-আরবাব-ই-বসর’ গ্রন্থে সিরাজকে ‘লঘুচিত্ত, একগুঁয়ে, বদ-মেজাজি, অধীর ও বদ-জবান এবং কাউকে রেহাই দিয়ে কথা বলতেন না’ বলা হয়েছে। মধ্যযুগের নবাব-বাদশাহ-রাজাদের এরচেয়েও বেশি অবিবেচনাপ্রসূত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের বিবরণ পাওয়া যায়। রাজাদের ক্ষেত্রে এমনটি এক ধরনের যোগ্যতার মাপকাঠি রূপেই ধরা হয়েছে। সিরাজের ক্ষেত্রে এজন্য আপত্তি উত্থাপিত হল কেন? এবং সেটাও আবার তার মৃত্যুর বহু বছর পর? তাছাড়া, একজন শাসকের এসব সীমাবদ্ধতার জন্য সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে তাকে নির্মমভাবে হত্যা ও ক্ষমতাচ্যুত করা কতটুকু যৌক্তিক হতে পারে?

‘সিয়ার উল মুতাখখিরিন’-এ বলা হয়েছে : “সিরাজ কর্কশ ও অভদ্র কথাবার্তা এবং সরকারি কর্মচারিদের ঠাট্টা ও উপহাস করায় সকলের মনে ক্ষোভ ছিল। ” কেবল এগুলোই যদি সিরাজের অপরাধ হয় এবং তাঁর পাপের তালিকা যদি এতেই সীমাবদ্ধ থাকে, তবে এত লঘু পাপে বাংলার সিংহাসন বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়া, এত বড় দণ্ড দেওয়া হল কেন, এমন জিজ্ঞাসার উদয় হওয়া সমীচীন।

আসলে সিরাজ উত্তরাধিকার সূত্রে ষড়যন্ত্র ও দুর্ভাগ্যের ভাগীদার ছিলেন। সে সময় আলীবর্দীর অপর কন্যা নওয়াজেশ আহমদ খান সাহামত জং এর বিধবা ঘসেটি বেগম কতগুলো কারণে সিরাজের বিরোধিতা করেন। ষড়যন্ত্রের মূল হোতা জগৎশেঠ ঘসেটি বেগমের নিকট গিয়ে তাকে নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সিরাজ বিরোধী জোটের অন্তর্ভুক্ত করে।

ক্ষমতা আরোহণের পর সিরাজ অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্র ও সামগ্রিক পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরেছিলেন। তিনি নিজের শাসনের সুবিধা অনুযায়ী কিছু প্রশাসনিক ও সামরিক পরিবর্তন করেন। কিন্তু মহবত জং-এর ভগ্নিপতি ও সামরিক বাহিনীর প্রধান মীর মুহম্মদ জাফর আলী খান তা মানতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন। এমনকি, তিনি নবাব সিরাজকে পর্যন্ত সম্মান প্রদর্শনে বিরত থাকেন।

এ প্রসঙ্গে ‘সিয়ার-উল-মুতাখখিরিন’-এ বর্ণিত হয়েছে যে: মীরজাফরের মনে অসন্তোষ সৃষ্টি হওয়ায় তিনি মরহুম মহবত জং এর অন্যান্য কর্মচারিদের সঙ্গে নিয়ে সিরাজের পতনের এবং নিজে মসনদ দখল করার জন্য ষড়যন্ত্র করেন।   ‘ইব্রাত-ই-আরবার-ই-বসর’-এ উল্লেখিত রয়েছে যে, “সিরাজের অধীনতা ছিন্ন করার জন্য দরবারের পুরাতন আমিররা ব্যগ্র হয়ে উঠেছিলেন। ”নিমক হারাম দেউড়ি নামে পরিচিত মীর জাফরের প্রাসাদ

যদিও রিয়াজে বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করা হয়নি, তথাপি সিয়ার এবং ইব্রাত এ উল্লেখিত হয়েছে যে, সিরাজ ক্ষমতা গ্রহণের পর সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিম্নোক্ত কার্যগুলোর দ্বারা রাজত্ব আরম্ভ করেছিলেন এবং বিরুদ্ধবাদীদের দমনের যথাযথ পদক্ষেপ নিয়েছিলেন:
১.     ঘসেটি বেগমকে দমন এবং সম্পদ বাজেয়াপ্তকরণ;
২.     মীর জাফরের অবাধ্যতার কারণে বিশ্বস্ত মোহনলালকে প্রধান উজির পদে নিয়োগ;
৩.     ষড়যন্ত্রকারী রাজবল্লভকে বন্দিকরণ;
৪.     ইংরেজদের ষড়যন্ত্রের ঘাঁটি কলকাতা জয়; এবং
৫.     পূর্ণিয়া জয়।

নিরপেক্ষভাবে বিবেচনা করলে দেখা যায় যে, উপরোক্ত কাজগুলো অন্যায় হয়নি, সামরিক ও রাজনৈতিকভাবে অবিবেচনাপ্রসূত হয়নি। আইনগত দিক থেকেও একজন শাসকের পক্ষে কাজগুলো মোটেও অবৈধ হয় নি। কারণ, প্রথমত, আলীবর্দীর দেওয়ান সাহামত জং-এর নিকট আমানত রাজকীয় সম্পদ ঘসেটি বেগম কর্তৃক দখল করার ও নিয়ে যাওয়ার কোনই অধিকার ছিল না। সিরাজ আইনসঙ্গতভাবে আলীবর্দীর উত্তরাধিকার হওয়ায় উক্ত সম্পদ পুনরাধিকার করা তার পক্ষে সম্পূর্ণ ন্যায়সঙ্গত ছিল। দ্বিতীয়ত, মীরজাফরকে কোণঠাসা করারও প্রয়োজন ছিল। কেননা, আলীবর্দীর জীবিকতকালেও মারাঠাদের সঙ্গে যুদ্ধের সময় মীরজাফর অকৃতজ্ঞ ও বিশ্বাসঘাতকরূপে প্রমাণিত হয়েছিল। সুতরাং সিরাজের পক্ষে তাকে সন্দেহ করা ও তাকে সৈন্যবাহিনীর ও প্রশাসনিক ক্ষমতা থেকে সরিয়ে রাখাও অযৌক্তিক হয়নি। তৃতীয়ত, রাজবল্লভকে প্রহরাধীন রাখা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে একান্ত প্রয়োজন ছিল। কেননা, সাহামত জং (ঢাকার প্রাক্তন ডেপুটি গভর্নর)-এর  জাহাঙ্গীরনগরের (বা ঢাকার) এই ধূর্ত ডেপুটি দেওয়ান বা পেশকার যথাযথভাবে হিসাব নিকাশ পেশ করতে পারেনি এবং এই ব্যক্তি বিপুল পরিমাণ সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করে। চতুর্থ, বিশিষ্ট আমাত্য কৃষ্ণদাশ সমস্ত অর্থ ও সম্পদসহ কলকাতা পালিয়ে যায়। সুতরাং সরকারি অর্থ সম্পদ উদ্ধার ও বিদ্রোহী কৃষ্ণদাশ ও তার আশ্রয়দাতা ইংরেজদের শাস্তি দেওয়ার জন্য শাসক হিসাবে বাধ্য হয়ে সিরাজকে কলকাতা আক্রমণ করতে হয়েছিল। পঞ্চমত, পূর্ণিয়া বিজয়েরও বিশেষ রাজনৈতিক প্রয়োজন ছিল। কারণ, মীরজাফরের প্ররোচনায় পূর্ণিয়া হতে শওকত জং বাংলার গদি দাবি করেন এবং নবাবের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ান।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, মীরজাফর বিপ্লব সৃষ্টির উদ্দেশ্যে একাধিক বারষড়যন্ত্র করেন, এমন প্রমাণ পাওয়া যায়। এহেন উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য বাংলার নবাব হওয়ার আশা দিয়ে বিদ্রোহে নেতৃত্ব গ্রহণ করার জন্য শওকত জংকে পত্রও পাঠায় মীরজাফর। উক্ত পত্র পাওয়ার পর শওকত জং বিহারের পূর্ণিয়ায় যে ষড়যন্ত্র শুরু করে, তা নির্মূল করা সিরাজের জন্য অপরিহার্য ছিল। শওকত জং-এর সঙ্গে যুদ্ধের কারণ সিরাজ নন, সিরাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও বিপ্লব সৃষ্টির ষড়যন্ত্রই এর অন্তর্নিহিত কারণ। পলাশীর যুদ্ধ

ফলে আত্মরক্ষার জন্য যুদ্ধ ব্যতিত সিরাজের সামনে অন্য কোন গত্যন্তর ছিল না। একজন সার্বভৌম শাসক হিসাবে তিনি যথাযথ পদক্ষেপই গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু এতে ক্ষমতালোভী কায়েমী স্বার্থবাদী ও ষড়যন্ত্রকারীরা বিচলিত বোধ করেন এবং সিরাজকে তাদের জন্য বিপদের কারণ হিসাবে মনে করেন। একইভাবে ইংরেজরা তাদের বাণিজ্যিক, সামরিক ও অপরাপর স্বার্থ হাসিলের পথে সিরাজের কাছ থেকে বাধা পেতে থাকে। ফলে সকল পক্ষই একাট্টা হয়ে সিরাজের চারপাশে ষড়যন্ত্রের জাল বিছাতে থাকে। এবং পর্যায় ক্রমে চক্রান্তকারীরা সিরাজ বিরোধী রাজনৈতিক মেরুকরণ সম্পন্ন করে সিরাজের সামরিক পরাজয় নিশ্চিত করে।

পরবর্তী পর্ব
ষড়যন্ত্রের রাজনৈতিক মেরুকরণ

পূর্ববর্তী পর্ব
পলাশী-পরবর্তী নির্যাতন-মিথ্যাচার

বাংলাদেশ সময়: ১৭০০ ঘণ্টা, জুন ১৮, ২০১৭
জেডএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।