ঢাকা, শনিবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফিচার

কাকাতিয়া সাম্রাজ্য যেনো শেষ বিকেলের মুছে যাওয়া আলপনা!

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০১৭ ঘণ্টা, অক্টোবর ১০, ২০১৭
কাকাতিয়া সাম্রাজ্য যেনো শেষ বিকেলের মুছে যাওয়া আলপনা! কাকাতীয় সাম্রাজ্যের সময়কার শিব ও নান্দীর ভাস্কর্য ছবি: শুভ্রনীল সাগর

ওয়ারাঙ্গাল (তেলেঙ্গানা) থেকে ফিরে: তেলেগুরা রোজ সকালে বাড়ির সদর দরজার সামনে আলপনা করে। এটি তাদের ঐতিহ্য। তেলেগু বলতে তেলেঙ্গানা ও অন্ধ্রপ্রদেশের অধিবাসীদের বোঝায়। তাদের ভাষা তেলেগু। আমরা যেমন বাংলায় কথা বলি, সেখান থেকে বাঙালি। তেমন তারা পরিচিত তেলেগু হিসেবে।

সাতসকালে ঘরবাড়ি-উঠান-রাস্তা ঝাড় দিয়ে সাদা চকে এঁকে দেয় সুদৃশ্য সব ফুলের নকশা। নকশার ঠিক মাঝখানে মাঝখানে শুকনো মরিচ ও হলুদের এক চিমটি গুঁড়ো।

বাড়িতে অমঙ্গল ও জরা যেনো ঢুকতে না পারে সেজন্য এই রীতি। তেলেগু বাড়ির সদর দরজার বাইরে আলপনা ছবি: শুভ্রনীল সাগরপ্রায় এক হাজার বছর আগে যে অঞ্চলটি ওয়ারাঙ্গাল ফোর্টের মধ্যে ছিলো, সেখানে আজ দোকানপাট, ঘরবাড়ি উঠে গেছে। সকাল-সন্ধ্যা সামাজিক সংসার। ঘরের বাইরে আলপনা। এখন কে বলবে এই জেলাটি একসময়কার প্রতাপশালী কাকাতিয়া সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিলো!

আজ সেই ‘রামও নেই, অযোধ্যাও নেই’। নেই হাতি-ঘোড়া, তলোয়ারের ঝনঝনানি। কেবল কিছু হাজার বছরের ‍পুরনো পাথরের স্মৃতি ফিরিয়ে নিয়ে যায় সেই ৯০০ খ্রিস্টাব্দে।

দক্ষিণ ভারতের একটি অংশের রাজা ছিলেন কিংবদন্তি শাসক দূর্জয়। ঐতিহাসিকরা অনুমান করেন, তারই উত্তরপুরুষদের একটি ধারা থেকে এসেছেন কাকাতীয়রা। ওয়ারাঙ্গাল ফোর্টে ঢোকার পথ, ছবি: শুভ্রনীল সাগরচালুক্য রাজবংশের সঙ্গেও কাকাতিয়াদের যোগ রয়েছে বলে অনেকের মত।

ইতিহাসের পাতায় প্রতাপ রুদ্র (১ম) থেকে পরবর্তী শাসকদদের কথা উল্লেখ রয়েছে। প্রতাপ রুদ্র (১ম) ১১৬৩ খ্রিস্টাব্দে স্বায়ত্তশাসিত কাকাতিয়া সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করলেও, ১০৮৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে তাদের যাত্রা। কিন্তু আগেকার কাকাতীয় শাসকদের সম্পর্কে তেমন কোনো তথ্য মেলে না।

প্রতাপ রুদ্র (১ম) কাকাতিয়া সাম্রাজ্যের রাজধানী স্থাপন করেন 'ওরুঙ্গাল'-এ। ওরুঙ্গাল থেকেই এসেছে ওয়ারাঙ্গাল। বর্তমানে এটি ভারতের তেলেঙ্গানা রাজ্যের অন্যতম একটি জেলা। হায়দ্রাবাদ শহর থেকে ১৩৭ কিমি, তিন ঘণ্টার ট্রেন পথ। বাসেও যাওয়া-আসা যায়। ফোর্টের ভেতরে গড়ে ওঠা বসতি, ছবি: শুভ্রনীল সাগরওয়ারাঙ্গাল জেলাটি ভারতের অন্যতম ঘোষিত হেরিটেজ শহর। এর কারণ অবশ্যই কাকাতিয়া সাম্রাজ্য। সেসময়কার বহু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন এখনও রয়েছে। বলা ভালো, নিদর্শনের ধংসাবশেষ।

তখন দিল্লিতে খিলজি রাজবংশের শাসনের অবসান ঘটেছে। তুর্কি শাসক গিয়াসউদ্দিন তুঘলক শাহের রাজত্ব শুরু হয়। ১৩২৩ সালে তিনি কাকাতিয়া রাজা প্রতাপ রুদ্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন এবং প্রতাপ রুদ্রকে পরাজিত করার জন্য তার বিশ্বস্ত ও চৌকস সেনাপতি উলুগ খানকে পাঠান। উলুগ খানের প্রাথমিক আক্রমণ প্রতিহত করা গেলেও কিছুদিন পর কাকাতিয়া রাজ্যের অপ্রস্তুত সৈন্যবাহিনী তার কাছে পরাজিত হয়। রাজা প্রতাপ রুদ্র এই অতর্কিত যুদ্ধে প্রাণ হারান। সেময়কার ফোর্টের ভেতর তোরণ, ছবি: শুভ্রনীল সাগরকাকাতিয়া রাজ্যের রাজধানী ওয়ারাঙ্গালে এক মাস পর্যন্ত লুণ্ঠন ও ধ্বংসলীলা চলতে থাকে। কতো শত হীরা, মাণিক্য, রৌপ্য, গহনা লুণ্ঠন করে পাঠানো হয় দিল্লিতে।

ধারণা করা হয়, সেই ধ্বংসলীলার সময়ই ভূলুণ্ঠিত হয় বিখ্যাত কাকাতিয়া ফোর্ট, শিব মন্দির, কালী মন্দির এবং অসংখ্য দেব-দেবীর ভাস্কর্য। এরপর শুরু হয় মুঘল শাসন। ভারত ব্রিটিশদের করায়ত্বেও ছিলো ২শ বছরেরও মতো। ক্যালেন্ডারের পাতা ওল্টানোর মতো কেটে যায় একে একে ৭শ বছর। কাকাতীয় সাম্রাজ্যের একটি নিদর্শন , ছবি: শুভ্রনীল সাগরএই দীর্ঘ কালের পরিক্রমায়ও কাকাতিয়া সাম্রাজ্যের স্মৃতিধন্য একটি শিব মন্দির, ফোর্টের কিছু পাথুরে ধংসাবশেষ, কিছু ভাঙা-আধাভাঙা দেব-দেবীর ভাস্কর্য, পাথরে নির্মিত ফোর্টে ঢোকার গেট, ভাঙা প্রাচীর এবং বিভিন্ন জায়গায় ছড়নো-ছিটানো কিছু নিদর্শন রয়ে গেছে।

এগুলো দীর্ঘদিন অযত্নে-অবহেলায় পড়ে ছিলো। ধ্বংস, দখল, নষ্ট প্রভৃতির পর যা অবশিষ্ট রয়েছে তা এখন আর্কেওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার তত্ত্বাবধানে। যেখান থেকে যা মিলেছে জড়ো করে এক জায়গায় সাজিয়ে পার্কের মতো করে রাখা হয়েছে। ভারতীয় হলে জনপ্রতি ১৫ ‍রুপি, বিদেশি হলে ২০০ রুপি দিয়ে সকাল থেকে সন্ধ্যা সেসব দেখার ব্যবস্থা রয়েছে।

সদর দরজার বাইরে তেলেগুদের আলপনা দিয়ে লেখা শুরু হয়েছিল। কাকাতিয়া সাম্রাজ্যের রাজধানী ঘুরে যখন ফিরছি তখন সূয্যিমামা মাথার উপর। সকালের তরতাজা আলপনাগুলো বাড়ির সদস্য ও অন্যদের আসা-যাওয়ায় ধীরে মুছে যেতে বসেছে। বিকেল হতে হতে হয়তো প্রায় মিলিয়েই যাবে। এটিই সময় ও সভ্যতার নিয়ম। কাকাতীয় সাম্রাজ্যের ধ্বংসাবশেষ, ছবি: শুভ্রনীল সাগরসেসময় দক্ষিণের অন্য রাজারাও সমীহ করে চলতেন কাকাতীয় রাজাদের। ধন-সম্পদ ও প্রভাব-প্রতিপত্তিতে দক্ষিণ ভারতসহ গোটা ভারতেই নাম-ডাক ছিলো এ রাজবংশের। এক সময় শোভা দিয়েছে কিন্তু সময়ের বিধান বড়ই অন্যরকম— কাকাতিয়া সাম্রাজ্য যেনো এখন শেষ বিকেলে প্রায় মুছে যাওয়া তেলেগু বাড়ির আলপনা!

বাংলাদেশ সময়: ১৬১৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ১০, ২০১৭
এসএনএস 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।