ঢাকা, বুধবার, ২৪ আশ্বিন ১৪৩১, ০৯ অক্টোবর ২০২৪, ০৫ রবিউস সানি ১৪৪৬

ফিচার

ধুনকর ব্যবসায় শহরের পরিবেশ ও নিরাপত্তা হুমকিতে

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৪৪০ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৯, ২০১৭
ধুনকর ব্যবসায় শহরের পরিবেশ ও নিরাপত্তা হুমকিতে লেপ-তোশকের শ্রমিকদের ঘুম নেই। ছবি: সাখাওয়াত হোসেন হৃদয়

কিশোরগঞ্জ থেকে: শহরের কেন্দ্রস্থলে গৌরাঙ্গ বাজার এলাকার ‘বিহারি পট্টি’ নামটি এখন অনেকেই জানে না। ‘লেপ পট্টি’ বললে সহজেই জায়গাটি চিনতে পারে মানুষ। শীতের আগমনীতে পাড়াটি এখন দিন-রাত জেগে আছে।

ঘুম নেই লেপ-তোশকের কারিগরদের। বছরের অন্যান্য সময় ঝিমিয়ে দিন কাটালেও এখন চলছে ধুনকরদের ভরা মৌসুম।

শহরের মাঝখানে ধুনকর ব্যবসায় কিশোরগঞ্জ শহরের পরিবেশ ও নিরাপত্তাও হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে।

সাতচল্লিশের দেশভাগের সময় বিহারের আঁরা জেলা থেকে চার জন লোক সপরিবারে কিশোরগঞ্জ শহরে এসে ঠাঁই নেন। তারা ছিলেন ধুনকর সম্প্রদায়ের মানুষ। তুলা ধুনে বাড়ি বাড়ি লেপ-তোশক- বালিশ বানাতেন তারা। কালক্রমে হাতে তুলা ধুনার ব্যবস্থা দখল করেছে মেশিন। এরাও দোকান-বাড়ি করে থিতু হয়েছেন ব্যবসায়। আবদুর রাজ্জাক, কদম রসুল, মো. শফিক ও ইসহাক খান নামের চার বিহারবাসীর বংশধররাই কিশোরগঞ্জে একচেটিয়াভাবে লেপ-তোশকের ব্যবসা করছে।

একাত্তর সালে এই সম্প্রদায়ের বির্তকিত কাজকর্মের দরুণ একটা সময় যথেষ্ট কোণঠাসা ছিল এরা।

পাকিস্তানের হানাদার বাহিনির সঙ্গে সহযোগিতা ও অপকর্মের জন্য কয়েকজন বিহারি অপরাধী জনতার হাতে নিহতও হয়েছিল। ক্রমে পরিস্থিতি সহজ হলে আবারও চুটিয়ে ব্যবসায় মেতে উঠেছে এই সম্প্রদায়ের লোকজন।

দেহাতি হিন্দি মিশ্রিত বাংলায় বেশ চালিয়ে নিচ্ছে ব্যবসার কাজ। তবে ভাষা ও সংস্কৃতির দিক থেকে এখনও তারা রয়ে গেছে মূলস্রোতের বাঙালিদের চেয়ে আলাদা।

ব্যবসায় দুয়েক জন বাঙালি শ্রমিক নিয়োজিত থাকলেও মূল ব্যবসাটি তারা হাতছাড়া করে নি। তৃতীয় প্রজন্মের ধুনকর ইউসুফ বিহারি বাংলানিউজকে বলেন, ‘এখন আমাদের সিজন চলছে। অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি পযন্ত পাঁচ মাস হলো ব্যবসার মূল সময়। অন্যান মাসে কয়েকটা বিয়ের লেপ-তোশকের অর্ডার ছাড়া বিশেষ কিছু পাওয়া যায় না। ’

তিনি বলেন, ‘তুলা ও কাপড়ের কোয়ালিটি অনুযায়ী আমরা ৫০০ থেকে ১৫০০ টাকার মধ্যে লেপ, তোশক বানিয়ে দিয়ে থাকি। মশারি, বালিশ এসবের জন্য মান অনুযায়ী দাম নির্ধারিত হয়। আমরা সাধারণ রেডিমেট মালামাল যেমন রাখি, তেমনি অর্ডার নিয়ে কোয়ালিটি কাজও করি গ্রাহকদের চাহিদা মোতাবেক ডিজাইন ও স্টাইলের ভিত্তিতে। ’

ধুনকর সম্প্রদায়ের সঙ্গে ব্যবসায়িক লেনদেনে জড়িত আলম শাহিন বাংলানিউজকে জানান, ‘বছরের এই সময় প্রচুর তুলা ও পাটের অবশিষ্টাংশ (জুটন) প্রয়োজন পড়ে। নারায়ণগঞ্জ থেকে ট্রাকে করে এসব এনে সাপ্লাই করা হয়। সৌখিন বালিশের জন্য মোলায়েম শিমূল তুলা স্থানীয় গ্রামের বাজার থেকে পাওয়া যায়। ’

ধুনকর সম্প্রদায় শহরের বড় রাস্তার উপরেই সামনে দোকান আর পেছনে বাড়ি নিয়ে বাস করে। ফুটপাতে লেপ সেলাই করে। তুলা ধুনার কাজটি করে দোকানের পেছনে স্থাপিত মেশিনে। বেশ কয়েকবার শহরের মাঝখান থেকে এই কারখানা ও ব্যবসাটিকে সরিয়ে শহরের এক প্রান্তে পুনর্বাসন করার দাবি উঠেছিল।

কারণ, তুলা ধুনার ডাস্ট বা ধূলা শহরের কেন্দ্রস্থলকে আচ্ছন্ন করে বিরাট পরিবেশ সমস্যার সৃষ্টি করে। বিশেষত যক্ষা, কফ, কাশি, হাপানির মতো সংক্রামক রোগের ঝুঁকি থাকে তুলার ডাস্টের মাধ্যমে। তাছাড়া সারা রাত তুলা ধুনার মেশিন চালনার শব্দও নাগরিক শান্তির পক্ষে বিপজ্জনক হিসাবে চিহ্ণিত হয়েছে। তদুপরি ভয়ানক ঝুঁকিপূর্ণ তুলা, লেপ, তোশকের দোকানগুলো থেকে অগ্নিকাণ্ডের আশঙ্কাও থাকে। প্রায়-প্রতি বছরই এই পট্টিতে এক বা একাধিক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে, যাতে পার্শ্ববর্তী দোকান ও বাড়িগুলোও ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়।

কিশোরগঞ্জের বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষ শহরের নিরাপত্তা ও পরিবেশ রক্ষার্থে সরকারি ব্যবস্থাপনায় অন্য জায়গার ব্যবস্থা করে লেপ পট্টি সরিয়ে নেওয়ার দাবি করেছেন। তারা বলেন, যে কেউ স্বাধীন পেশা গ্রহণের অধিকার রাখে। তবে এক্ষেত্রে সমাজ ও মানুষের স্বার্থের দিকটিতেও নজর রাখতে হবে। বিহারি সম্প্রদায়ও তাদের পৈত্রিক পেশা নিয়ে নিরাপত্তা ও পরিবেশের সমস্যা না করে থাকুক। এ ব্যাপারে প্রশাসনের পক্ষে উদ্যোগী ভূমিকা নেওয়া দরকার বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।

বাংলাদেশ সময়: ১০৩৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৯, ২০১৭
এমপি/জেডএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।