ঢাকা, বুধবার, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

ফিচার

অর্জন

মুসা ইব্রাহিমের সঙ্গে একটি সকাল কেওক্রাডং থেকে এভারেস্ট-চূড়ায়

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৬৫২ ঘণ্টা, জুন ২১, ২০১০
মুসা ইব্রাহিমের সঙ্গে একটি সকাল কেওক্রাডং থেকে এভারেস্ট-চূড়ায়

বাংলাদেশের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ কেওক্রাডং দিয়ে মুসা ইব্রাহিমের পর্বত জয়ের অভিযান শুরু। এরপর একে একে মেরা, মাউন্ট ফ্রে, চুলু ওয়েস্ট, লাংসিসা রি আর অন্নপূর্ণার পরে মাউন্ট এভারেস্ট।

রুদ্ধশ্বাস অভিযান। পায়ে পায়ে মৃত্যুঝুঁকি। শূন্যের চেয়েও ২০ ডিগ্রি কম তাপমাত্রা, পাহাড়ের বরফ বিছানো খাড়া ঢাল আর তুষারঝড়ের বিভীষিকা। কিন্তু মুসার স্বপ্নপূরণের অদম্য আকাক্সক্ষার সামনে সবই তুচ্ছ। ২৯ হাজার ৩৫ ফুট উঁচু এভারেস্টের চূড়ায় গত ২৩ মে ভোরে প্রথমবারের মতো তিনি উড়িয়ে দিলেন লাল-সবুজ পতাকা। সেই এডভেঞ্চারের গল্পে যাওয়ার আগে আসুন জেনে নেয়া যাক, কেমন ছিল তার শৈশব-কৈশোর?

এভারেস্ট জয়ী মুসা ইব্রাহিমের গ্রামের বাড়ি লালমনিরহাটের দুর্গাপুর উপজেলা। গ্রামের নাম গন্ধবরুয়া। তবে বাবার চাকরিসূত্রে ছিলেন পঞ্চগড় আর ঠাকুরগাঁওয়ে। বাবা আনসার আলী চাকরি করতেন সুগার অ্যান্ড ফুড কর্পোরেশনে। মা বিলকিস বেগম গৃহিণী। এক বোন আর দুই ভাইয়ের মধ্যে মুসা দ্বিতীয়। বাংলাদেশের প্রথম এভারেস্টবিজয়ী হয়ে দেশে ফেরার দু দিন পর ২ জুন সকালে আমরা মুসা ও তার পরিবারের মুখোমুখি হই তাদের মোহাম্মদপুরের বাসায়। স্বাভাবিক কারণেই মুসা ইব্রাহিম খুব ব্যস্ত। সকালে এই চ্যানেলের টক শো তো বিকেলে ওই চ্যানেলের লাইভ শো। এখন অমুক পত্রিকায় ইন্টারভিউ তো তখন তমুক পত্রিকার সেশন। আজ এই সংগঠন সংবর্ধনা দেবে, কাল আরেকটা। কাউকে নিরাশ করতে চান না মুসা। দেশে ফিরে  তাই বউ-বাচ্চাকেও সময় দিতে পারছেন না। তার স্ত্রী উম্মে শরাবন তহুরা রিমি ময়মনসিংহ জেলার সহকারী জজ। তাদের দেড় বছর বয়সী পুত্রসন্তান ওয়াজী ইব্রাহিম রাইদ।

একটা সংগঠন থেকে গাড়ি এসে বসে আছে মুসাকে নিয়ে যাবার জন্য। রাজধানীর অভিজাত একটি হোটেলে তাকে সম্মাননা জানানো হবে। মুসা বললেন, আগে আমার পরিবারের কাছ থেকে যা জানার জেনে নিন। আমি সবার শেষে কথা বলবো । এই ফাঁকে চট করে তৈরি হয়ে আসি। আপনাদের সাথে কথা বলেই ওদের সঙ্গে রওনা দিতে হবে।

মুসার ছোটবেলা সম্পর্কে জানার জন্য আমরা একে একে কথা বলি তার বাবা, মা ও সুদানপ্রবাসী বড় বোনের সঙ্গে। শুরুতেই মুসার বাবা জানালেন, খুব ছোট থেকেই ও ছিল দুরন্ত স্বভাবের। প্রকৃতির প্রতি তার ছিল আলাদা টান। তিনি বলেন, আমরা তখন থাকতাম পঞ্চগড়ে। আকাশ পরিষ্কার থাকলে সেখান থেকে মেঘের মতো আবছা আবছা হিমালয় দেখা যায়। ছোটবেলায় মুসা প্রায়ই সেদিকে অবাক দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে থাকত। পঞ্চগড় শহরের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে করতোয়া নদী। সমবয়সী ছেলেদের নিয়ে সে নদীর পারে ঘুড়ে বেড়াতো । বয়স কতো আর তখন, এই কাস ওয়ান-টুর ছাত্র। আমরা ভয় পেতাম, যদি কোন দুর্ঘটনা ঘটে! অনেক বকাঝকাও করতাম। তারপর আমি বদলি হই ঠাকুরগাঁও। এই শহরটির পাশ দিয়েও বয়ে গেছে ছোট্ট এক নদী, নাম সুখ নদী। আমার বাসা ছিল একেবারে নদীর কিনারে। মুসা সেই নদীতে সাঁতার কাটতো। বর্ষাকালের টইটুম্বর নদী ছিল তার খুব প্রিয়। সঙ্গীদের নিয়ে নদীর নতুন পানিতে লম্ফঝম্ফ ছিল তার প্রিয় খেলা। শুধু পড়ালেখা নয়, সব কাজই মনোযোগ দিয়ে করতো মুসা।

মুসার বাবার কাছে প্রশ্ন ছিল, এডভেঞ্চারের ঝোঁক আপনাদের পরিবারের আর কারো মধ্যে কি ছিল? লাজুক হেসে বললেন, আসলে এটা মুসা আমার কাছ থেকেই পেয়েছে। আমিও নদী-বিল পছন্দ করতাম। বেড়াতে পছন্দ করতাম। যেসব কাজ কষ্টসাধ্য, যেখানে ভয়-ভীতি বেশি, সেসবই আমাকে টানতো।

মুসা ইব্রাহিমের মায়ের কাছে জানতে চাওয়া হলো, ছেলের বনে-পাহাড়ে ছুটে বেড়ানো আপনার কেমন লাগে? তিনি বললেন, মোটেও ভালো লাগে না। আমি তাকে কতোবার নিষেধ করেছি , কিন্তু সে আমাদের কথা কানে তোলে না। একেকবার পাহাড় থেকে ঘুরে এসে আমাকে রেকর্ড করা ভিডিও দেখাতে চাইতো। আমার ওসব দেখতে ভালো লাগতো না। বরফের মধ্যে লোহার জুতা পরে ছোটাছুটি কোনো কাজ হলো নাকি! কোথায় চোরাবরফ আছে কে জানে, পা পড়লে জীবন শেষ! পড়াশোনায় এতো ভালো রেজাল্ট করেও সে কোনো স্থায়ী চাকরি করলো না। একটু সংসারী হবে, এই আশায় তাকে তাড়াতাড়ি বিয়ে করিয়ে দিলাম। কিন্তু কোনো পরিবর্তন নেই। সন্তানের বাবা হওয়ার পর ভাবলাম, এবার বোধহয় ছেলের মুখের দিকে ঘরমুখো হবে। কিন্তু কিসের কী!

মা আরো বললেন, এভারেস্টে যাবার আগে এবার যখন তার টাকা-পয়সার জোগাড় হচ্ছিল না, তখন মনে মনে খুশি হয়েছিলাম। কিন্তু ভাইয়ের শখ পূরণে এগিয়ে এলো তার বড় বোন। কী আর করা!

বললেন, মুসা যখন এভারেস্টের উদ্দেশে রওনা দেয় আমি আর তার বাবা ছিলাম সুদানে, মেয়ের কাছে। প্রতিদিন বউমার কাছে ফোন করতাম মুসার খবর জানার জন্য। ১৬ তারিখের পর থেকে তার সঙ্গে বউমার কোনো যোগাযোগ নেই শুনে আমিও খুব টেনশনে পড়ে যাই। কান্নাকাটি শুরু করি দেশে ফেরার জন্য। নির্ধারিত সময়ের আগে দেশে ফিরি। আর দেশে ফিরেই শুনলাম সুখবর। মুসাকে নিয়ে মানুষের এতো আবেগ-উচ্ছ্বাস দেখে মনে হচ্ছে, সত্যিই আমার ছেলে এক অসাধ্য কাজ করেছে।

এভারেস্টে আরোহণে জনপ্রতি প্রয়োজন হয় প্রায় ৪০ লাখ টাকা। এজন্য এন্ট্রি ফি বাবদ তিব্বত সরকারকেই শুধু ট্যাক্স দিতে হয় প্রায় ৮ লাখ টাকা। এক পর্যায়ে প্রয়োজনীয় স্পন্সর না পাওয়ায় মুসার এভারেস্ট অভিযান অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। এ সময় এগিয়ে আসেন বড় বোন নূর আয়েশা। মুসার হাতে তুলে দেন নিজের সঞ্চিত ১৪ লাখ টাকা। সুদানে ইউএনডিপিতে চাকরিরত নূর আয়েশা ছুটি কাটাতে বাংলাদেশ এসেছেন। তার সঙ্গে কথা হলো আমাদের। তিনি বললেন, ঘুরে বেড়ানোর ঝোঁক মুসার ছোটবেলা থেকেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জার্নালিজমে মাস্টার্স পরীক্ষা দেয়ার পর আমি ছ মাস প্রথম আলোতে ইন্টার্নি করি। আমার সঙ্গে মুসাও যেত। একসময় সে নিজেও প্রথম আলোতে লেখালেখি শুরু করে। সাংবাদিকদের সঙ্গে বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, সেন্টমার্টিন, সুন্দরবন এসব জায়গা ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে একসময় তার মধ্যে পাহাড় জয়ের নেশা তৈরি হয়। ছোট ভাইয়ের এই এডভেঞ্চারে বেরিয়ে পড়াকে আমি সবসময় অনুপ্রাণিত করেছি। এবার যখন দীর্ঘ প্রস্তুতির পর আর্থিক কারণে তার এভারেস্ট যাওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়ে এবং শেষ আশ্রয় হিসেবে আমার কাছে আসে, তখন তাকে সাহায্য করাটা নৈতিক দায়িত্ব মনে করেছি। কারণ সে যদি এভারেস্ট যেতে না পারে, তাহলে হয়তো মানসিকভাবে ভেঙে পড়তে পারে।

প্রথম আলোতে মুসা কাজ করতেন কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার হিসেবে। তারপর সাব-এডিটর হিসেবে কাজ করেন যায়যায়দিন ও নয়াদিগন্তে। প্রথম আলোতেই পরিচয় হয়েছিল আরেক কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার উম্মে শরাবন তহুরা রিমির সঙ্গে। চিন্তাভাবনার মিল দুজনকে কাছে নিয়ে আসে। ২০০৭-এর সেপ্টেম্বরে দুই পরিবারের মধ্যস্থতায় তারা বিয়ের পিঁড়িতে বসেন। এরই মধ্যে শরাবন যোগ দেন সরকারি চাকরিতে। বর্তমানে ময়মনসিংহ জেলার সহকারি জজ। মুসার পাহাড় জয়ের নেশাকে কীভাবে দেখেন? উত্তরে শরাবন বললেন, বিয়ের আগে কাজটাকে খুব থ্রিলিং মনে হতো। মুসা আমার কাছে পাহাড়ে ওঠার গল্প করতো, ছবি দেখাতো। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাহাড়ের চূড়ায় ওঠাকে মনে হতো খুব এক্সাইটিং ব্যাপার। কিন্তু বিয়ের পর সেই দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে যায়।

এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আসলে দুটো সম্পূর্ণ দু রকম অনুভূতি। বিয়ের পর ২০০৮ সালে সে যখন নেপালের চুলু পাহাড়ে ওঠার প্রস্তুতি নেয়, আমি তাকে নিষেধ করেছিলাম। কোন স্ত্রী চায় তার সবচে কাছের মানুষ এমন একটা ঝুঁকিপূর্ণ কাজে যাক? এভারেস্ট যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়ার সময়ও এতে আমার সম্মতি ছিল না। তবে বাধা দিইনি, কারণ ততোদিনে বুঝে গেছি আমার ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ মুসাকে খুব বেশি প্রভাবিত করবে না। তবে অর্থসংকটে যখন তার এভারেস্ট যাওয়া অনিশ্চিত হয়ে যায় আমি তার পাশে দাঁড়াই। আসলে মুসার হতাশ মুখের অভিব্যক্তি দেখে আমার মনে হয়েছিল আমার কাছে যদি টাকাটা থাকতো আমি তা ওকে দিয়ে দিতাম। তারপর ওর সঙ্গে স্পন্সর জোগাড় করার জন্য প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানের কাছে যাই। তাঁকে বলি, আপনি শুধু কয়েকটা জায়গায় ফোন করে দিলেই মুসা স্পন্সর পেয়ে যাবে। মতি ভাই সহযোগিতা দেবেন বলে আশ্বস্ত করেন।

১০ মে মুসা ইব্রাহিম এভারেস্টের উদ্দেশে দেশ ছাড়েন। ১৬ মে পর্যন্ত ফোনে স্ত্রীর সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল। তারপর সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। সে সময়ের অনুভূতির কথা জানিয়ে শরাবন তহুরা বললেন, কী যে টেনশনে ছিলাম বলে বোঝাতে পারবো না। মুসার সঙ্গের লোকজনকে ফোন করে তার খবর জানতে চাইতাম। মুসা ভালো আছে বলে তারা আমাকে সান্ত¡না দিতে চাইতো। আমি বলতাম, আপনারা কীভাবে বলছেন সে ভালো আছে, আপনাদের সঙ্গে কি তার দেখা হয়েছে? তারা আমার কথা শুনে বিব্রত হতো। আসলে তিব্বতের গ্রাউন্ড বেসক্যাম্প ছাড়ার পর মুসা যোগাযোগের আওতার বাইরে চলে যায়।

এভারেস্ট জয়ের খবর পাওয়া প্রসঙ্গে শরাবন বলেন, আমি ২৩ মে এজলাস থেকে নেমে দেখি আমার মোবাইলে বেশ কিছু মিসকল। নম্বরগুলো মুসার সঙ্গীদের। আমি সঙ্গে সঙ্গে তাদের কল দিই। তারা জানান, মুসা এভারেস্টে উঠেছে। এখন সে নেমে আসছে। তাদের কাছে স্যাটেলাইটে এই ম্যাসেজ এসেছে। প্রথমে তাদের কথা বিশ্বাস করিনি। পরে বেশ কজনকে ফোন করে নিশ্চিত হই। মুসার সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয় তার পাহাড় থেকে নেমে আসার পর।

পরিবারের সবার সঙ্গে কথা বলা শেষ হলে মুসা ইব্রাহিম আমাদের মুখোমুখি বসলেন। এভারেস্ট জয়ের সংকল্প প্রসঙ্গে তিনি বললেন, আপনারা তো এরই মাঝে শুনে নিয়েছেন যে ছোটবেলা থেকে অজানা-অচেনা জায়গায় ঘুরে বেড়ানোটা আমার নেশা। সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়তাম। প্রথম আলোতে যখন লেখালেখি শুরু করি, তখন সাংবাদিকদের সঙ্গে গড়ে ওঠে ভালো সম্পর্ক। আনিসুল হক, নওরোজ ইমতিয়াজ, সুমনা শারমীন প্রমুখের সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ানোর বিষয়টা আমি শেয়ার করতাম।

পত্রিকা থেকে বান্দরবান, রাঙামাটি, সেন্টমার্টিন, সুন্দরবন এসব জায়গায় কোনো টিম গেলে তারা ফোন দিতেন। বলতেন, একটা টিম অমুক জায়গায় যাচ্ছে, তুমি যেতে চাইলে দ্রুত তৈরি হয়ে নাও। সঙ্গে সঙ্গেই আমি চলে আসতাম। এভারেস্টে উঠার স্বপ্নটা আমি দেখতে শুরু করি ২০০২ সালে কেওক্রাডং ওঠার পর থেকে। গড়ে তুলি নর্থ আলপাইন কাব। তারপর প্রত্যেক সিজনেই বেরিয়ে পড়তাম নানা জায়গায়। কখনো দার্জিলিং, কখনো নেপাল। কোর্স করি মাউন্ট ট্রেকিংয়ের ওপর। দীর্ঘ আট বছর প্রস্তুতির পর আমার স্বপ্ন পূরণ হলো।

ছোটবেলায় পঞ্চগড় থেকে হিমালয় দেখা প্রসঙ্গে মুসা বললেন, তখন বয়স ছিল কম। কম বয়সের স্বপ্নগুলোও বোধহয় ছোট ছোট হয়। বহুদূর থেকে হিমালয়ের দিকে চেয়ে ভাবতাম, যদি একবার পাহাড়টাকে খুব কাছ থেকে দেখতে পরতাম। হিমালয়ের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ এভারেস্টে উঠবো তখন স্বপ্নেও ভাবিনি। তবে দূর থেকে হিমালয় দেখে আমি পাহাড়কে ভালবাসতে শিখি। তিনি বলেন, আমি আমার দেশকে খুব ভালোবাসি। বাংলাদেশের সবচেয়ে উঁচু পাহাড় কেওক্রাডং উঠে কারো কাছ থেকে জানতে পারি, বাংলাদেশের কোনো মানুষ তখনও এভারেস্টের চূড়ায় ওঠেনি । তখনই মনে মনে সিদ্ধান্ত নিই, কাজটা আমিই প্রথম করবো। আমার চরিত্রের বিশেষ একটি দিক, আমি কোনো বিষয়ে একবার সিদ্ধান্ত নিলে সেটা যেভাবেই হোক করবোই। সেজন্য যতো কষ্টই সহ্য করতে হোক, আমি পিছপা হই না।

এভারেস্টে উঠার সময় কোন অভিজ্ঞতাটি ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ? মুসা বললেন, কোনটা রেখে কোনটার কথা বলি! জীবনটাকে হাতের মুঠোয় নিয়েই এভারেস্টে উঠতে হয়। এভারেস্টের অ্যাডভান্স ক্যাম্পে পৌঁছার পর শুরু হলো ভয়ংকর তুষারঝড়। হিমালয়ের এই তুষারঝড় খুবই বিপজ্জনক। অনেক মানুষ এ ঝড়ে প্রাণ হারিয়েছে। ঝড়ের কারণে পুরো একদিন আমাদের ক্যাম্পে থাকতে  হয়েছে। সঙ্গের শেরপারা বলছিলেন, এ ঝড় এক সপ্তাহের আগে থামবে না। ভীষণ হতাশ লাগছিল তখন, মনে হচ্ছিল আমার স্বপ্ন বুঝি পূরণ হবে না। কারণ এক সপ্তাহ এখানে অবস্থানের মতো প্রস্তুতি আমরা নিয়ে আসিনি। সঙ্গের অনেক অভিযাত্রীই সে সময় চূড়ায় উঠার ইচ্ছেটাকে বলি দিয়ে নিচে নেমে যান। আমি অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিই। কারণ এমনিতেই  অনেক ঋণ করে এখানে এসেছি। এখন ফিরে গেলে আরেকবার আসার টাকা জোগাড় করা আমার পক্ষে অসম্ভব। আল্লার রহমতে পরদিন ঝড় থেমে যাওয়ায় আমরা আবার উপরে ওঠা শুরু করি। কিন্তু আলগা তুষার পড়ে ট্র্র্যাক হয়ে গিয়েছিল খুব পিচ্ছিল। অ্যাডভান্স ক্যাম্প ছেড়ে উপরে উঠার পথে আমার চোখে পড়ে বেশ কিছু মৃতদেহ। সে সময় কিছু সময়ের জন্য আমার মাথায় মৃত্যুভয় ভর করে। আমি মারা গেলে কী হবে আমার স্ত্রী-সন্তানের! একসময় জোর করে সেই ভাবনা সরিয়ে দিই। এভারেস্টের চূড়ায় সামিট করার পর হঠাৎ আমার প্রচ- শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। ভাবলাম এইবার শেষ। আমাকে আজীবন মৃতদেহ হয়ে এখানে পড়ে থাকতে হবে। আমি ঢলে তুষারের ওপর বসে পড়ি। শেরপারা এগিয়ে এসে আমার অক্সিজেন ইক্যুয়েপমেন্টের ত্রুটি ঠিক না করলে সত্যিই আমার ফেরা হতো না। মুসা আরো জানালেন, এভারেস্টে ওঠার চেয়ে নেমে আসাটাই বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ উপরে ওঠার সময় চোখ থাকে ওপরের দিকে। নিচের দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে রাখা যায়। কিন্তু নেমে আসার সময় নিচের দিকে দৃষ্টি না দিলে চলে না। চূড়া থেকে নিচের দিকে তাকিয়ে তার শিরদাঁড়া দিয়ে আতংকের স্রোত বয়ে গিয়েছিল বলে মুসা জানালেন।

মুসা ইব্রাহিমের পরবর্তী এডভেঞ্চারের পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বললেন, বাংলাদেশের প্রথম মানুষ হিসেবে এভারেস্টে পা রাখার পর পাহাড় নিয়ে আমার নতুন কোনো পরিকল্পনা নেই। তবে আমার কাব নর্থ আলপাইন নিয়ে বেশ কিছু পরিকল্পনা আছে। এর মধ্যে একটি হলো, কাব থেকে কোনো একজন নারীকে এভারেস্ট আরোহণে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করা। আমি চাই, আমাদের কাব থেকেই বাংলাদেশের কোনো নারী এভারেস্টের চূড়ায় প্রথম পা রাখুক। মুসা তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা জানিয়ে আরো বললেন, আমি শিক্ষা নিয়ে কিছু কাজ করতে চাই। আমরা যে পদ্ধতিতে পড়াশোনা করছি তার সংস্কার প্রয়োজন। এ নিয়ে আমার নিজস্ব কিছু চিন্তাভাবনা আছে। আগামীতে এ বিষয়ে বিস্তারিত বলবো।

বাংলাদেশের স্থানীয় সময়: ১১৫০ ঘণ্টা, জুন ২১, ২০১০
এসকেএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।