ঢাকা, শুক্রবার, ১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ১৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফিচার

স্মৃতিতে অম্লান জহির রায়হান

মাছুম কামাল, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২২১ ঘণ্টা, আগস্ট ১৯, ২০২২
স্মৃতিতে অম্লান জহির রায়হান

ঢাকা: সাহিত্যিক, চলচ্চিত্র নির্মাতা, ভাষা সৈনিক, সাংবাদিক অনেক পরিচয় তার। তিনি ছিলেন একাত্তরে নিহত বুদ্ধিজীবী ও সাহিত্যিক শহিদুল্লাহ কায়সারের অনুজ।

দেশের খ্যাতিমান এই ঔপন্যাসিকের নাম মোহাম্মদ জহিরুল্লাহ খান। তবে তিনি জহির রায়হান নামেই বেশি পরিচিত।

জহির রায়হানের লেখার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় নবম শ্রেণির থেকেই। ‘একুশের গল্প’ নামে একটা গল্প পরিমার্জিত আকারে আমাদের পাঠ্য ছিল। সেখানে গল্পের পার্শ্ব চরিত্র মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থী ‘তপু’ ভাষা আন্দোলনে নিহত হয়।

গল্পে রেণু নামে এক মেয়ের সঙ্গে তার পরিণয় ছিল। তপু ছিল প্রাণোচ্ছল, দুরন্ত এক যুবক। নিহত হওয়ার পর তারই স্কেলিটন তার সহপাঠীরা আবিষ্কার করে মেডিক্যাল কলেজের ওই বিষয় পাড়তে গিয়ে। তপুর বা-পায়ের টিবিয়া-ফেবুলা ২ ইঞ্চি ছোট ছিল। সেটা দেখেই শনাক্ত করা হয়, নিহত তপুর কঙ্কালই তার বন্ধুদের পড়ার বইতে খুঁজে পায়। আমি বহুদিন মনেপ্রাণে তপুর বন্ধু হয়ে তার না থাকার শূন্যতা টের পেয়েছিলাম। এক অব্যক্ত বেদনায় হৃদয় হাহাকারে পূর্ণ হয়ে যেত।

নিতান্তই সাধারণ এক গ্রামের স্কুলে পড়তাম আমি। তবে বহুদিন ধরে খুঁজেও আর কোনো ক্লাসের পাঠ্যসূচিতে জহির রায়হানের কোনো লেখা পাইনি। স্থানীয় একটা লাইব্রেরি ছিল বাজারের পাশেই। নাম জনতা লাইব্রেরি। মালিক ছিলেন আমাদের পাশের বাড়িরই। তিনি অবশ্য জানতেন আমার গল্পের বইয়ের প্রতি ঝোঁক আছে। ষষ্ঠ শ্রেণির থেকেই তার লাইব্রেরিতে যেতাম। কিন্তু জহির রায়হানের কোনো বই তার কাছেও পেলাম না।

এইচএসসিতে ভর্তি হয়ে পাঠ্যসূচিতে আবারও পেলাম জহির রায়হানের উপন্যাস ‘হাজার বছর ধরে’। ততদিনে শহরে এসেছি পড়াশোনার জন্য। গ্রাম বাংলার আবহ-পটভূমি নিয়ে এত দুর্দান্ত উপন্যাস মনে হয় খুব কমই লেখা হয়েছে। প্রতিটি চরিত্র যেনো জীবন্ত। প্রতিটি দৃশ্যপট এত সুস্পষ্ট। আর মন্তু-টুনির সেই অসম প্রেম বহুদিন আমার মনে দাগ কেটে আছে।  

আমার মনে হয়, ওই উপন্যাস থেকে এখনও কেউ কোনো প্রশ্ন করলে আমি উত্তর দিয়ে দিতে পারবো। সেই থেকে শুরু। এরপর সময়ের ব্যবধানে হাতে এলো মোবাইলফোন। পিডিএফ বইয়ের যুগও এলো। জহির রায়হান উঠে এলেন আমার জীবনে। বরফ গলা নদী, আরেক ফাল্গুন, শেষ বিকেলের মেয়ে পড়তে থাকলাম। তার প্রায় সবগুলো উপন্যাস পড়লাম একাধিকবার। দেখলাম তার পরিচালনায় নির্মিত সিনেমাগুলো।

যত জানাশোনা বাড়ল, জহির রায়হানের প্রতিভা নিয়ে বিস্মিত হলাম। আনন্দিত হলাম যে ৫২'র ভাষা আন্দোলন নিয়ে এত গুরুত্বপূর্ণ কাজ দেখে। ‘লেট দেয়ার বি লাইট, ‘স্টপ জেনোসাইড'র মত প্রামাণ্যচিত্র বা ভাষা আন্দোলন নিয়ে নির্মিত সিনেমা ‘জীবন থেকে নেয়া’র মত কাজগুলো হৃদয়কে নাড়া দিল তীব্রভাবে। বুঝলাম জহির রায়হানরা শতাব্দীতে একজনই জন্মায়।

জহির রায়হান ১৯৩৫ সালের ১৯ আগস্ট বর্তমান ফেনী জেলার সোনাগাজি উপজেলার নবাবপুর ইউনিয়নের মজুপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মাওলানা মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহ। মাতার নাম সৈয়দা সুফিয়া খাতুন। পিতার কর্মসূত্রে জহির  রায়হান কলকাতা মাদরাসার অ্যাংলো-পার্সিয়ান বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন। তবে ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের পর তিনি তার পরিবারের সাথে কলকাতা হতে বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) স্থানান্তরিত হন।

তিনি ১৯৫৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে বাংলায় স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ব্যক্তিগত জীবনে দু'বার বিয়ে করেন: ১৯৬১ সালে সুমিতা দেবীকে এবং ১৯৬৬ সালে তিনি সুচন্দাকে বিয়ে করেন। দুজনেই ছিলেন সে সময়কার বিখ্যাত চলচ্চিত্র অভিনেত্রী।

তার সাহিত্যিক ও সাংবাদিক জীবন শুরু হয় ১৯৫০ সালে। তিনি সে সময় ‘যুগের আলো’ পত্রিকায় সাংবাদিক হিসেবে কাজ করা শুরু করেন।

পরবর্তীতে তিনি খাপছাড়া, যান্ত্রিক, সিনেমা ইত্যাদি পত্রিকাতেও কাজ করেন। ১৯৫৬ সালে তিনি সম্পাদক হিসেবে ‘প্রবাহ’ পত্রিকায় যোগ দেন। ১৯৫৫ সালে তার প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘সূর্যগ্রহণ’ প্রকাশিত হয়।

১৯৫৭ সালে ‘জাগো হুয়া সাভেরা’ ছবিতে সহকারী হিসেবে কাজ করার মাধ্যমে তার চলচ্চিত্রে পদার্পণ ঘটে। তিনি ‘যে নদী মরুপথেও’ সিনেমা সহকারী হিসেবেও কাজ করেন। প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক এহতেশামের সিনেমা ‘এ দেশ তোমার আমার’ সিনেমায় জহির রায়হান নামসঙ্গীত রচনা করেছিলেন।

এরপর ১৯৬১ সালে তিনি রূপালী জগতে পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন ‘কখনো আসেনি’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। ১৯৬৪ সালে তিনি পাকিস্তানের প্রথম রঙিন চলচ্চিত্র (উর্দু ভাষার সিনেমা) ‘সঙ্গম’ নির্মাণ করেন এবং পরের বছর তার প্রথম সিনেমাস্কোপ চলচ্চিত্র ‘বাহানা’ মুক্তি দেন।

জহির রায়হান ভাষা আন্দোলনেও সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন এবং ২১শে ফেব্রুয়ারির ঐতিহাসিক আমতলা সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন। ভাষা আন্দোলন নিয়ে পরবর্তীতে তিনি ‘জীবন থেকে নেয়া’ নামে বিখ্যাত চলচ্চিত্রও নির্মাণ করেন। জহির রায়হান ১৯৬৯ সালের গণ অভ্যুত্থানে অংশ নেন।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি কলকাতায় চলে যান এবং সেখানে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে প্রচারাভিযান ও তথ্যচিত্র নির্মাণ শুরু করেন। সে সময় কলকাতায় তার নির্মিত চলচ্চিত্র ‘জীবন থেকে নেয়া’র বেশ কয়েকটি প্রদর্শনী হয় এবং চলচ্চিত্রটি দেখে অস্কারপ্রাপ্ত পরিচালক সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, তপন সিনহা এবং ঋত্বিক ঘটক প্রমুখ বিখ্যাত পরিচালক তার ভূয়সী প্রশংসা করেন।

সে সময়ে তিনি চরম অর্থনৈতিক দৈন্যের মধ্যে থাকা সত্ত্বেও তার চলচ্চিত্র প্রদর্শনী হতে প্রাপ্ত সমুদয় অর্থ তিনি মুক্তিযোদ্ধা তহবিলে দান করে দেন।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জহির রায়হান ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর ঢাকা ফিরে আসেন। মিরপুরে তার ভাই শহীদুল্লাহ কায়সারসহ আরও অনেককে বিহারিরা আটকে রেখেছে বলে খবর পেয়ে ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি সকালে তিনি সেনাবাহিনী ও পুলিশের বহরের সঙ্গে মিরপুর ১২ নম্বরের দিকে যান। সকাল সাড়ে নয়টার দিকে বিহারিরা কালাপানি পানির ট্যাংকের সামনে সেনা ও পুলিশ সদস্যদের দিকে গুলিবর্ষণ শুরু করে। এতে তিনি নিহত হন। পরদিন ৩১ জানুয়ারি মিরপুর বিহারি ও পাকিস্তানি সৈন্যদের দখলমুক্ত হলেও তার মরদেহ পাওয়া যায়নি। যদিও তার মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে কিছু বিতর্ক রয়েছে। তবে তাতে তার হারিয়ে যাওয়াকে অস্বীকার করা যায় না।

জহির রায়হান ‘হাজার বছর ধরে’ উপন্যাসের জন্য আদমজী সাহিত্য পুরস্কার, ‘কাচের দেয়াল’ চলচ্চিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ বাংলা চলচ্চিত্র বিভাগে পুরস্কার, গল্প সাহিত্যে অবদানের জন্য বাংলা একাডেমি প্রদত্ত বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (মরণোত্তর), শিল্পকলায় (চলচ্চিত্র) অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান একুশে পদক (মরণোত্তর), সাহিত্যে অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার (মরণোত্তর) লাভ করেন। ‘হাজার বছর ধরে’ চলচ্চিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ কাহিনীকার বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (মরণোত্তর) লাভ করেন।

মাত্র ৩৭ বছরের জীবন নিয়েই জহির রায়হান হয়ে উঠেছেন ইতিহাসের অংশ এবং একই সঙ্গে অনস্বীকার্য। শিল্প-সাহিত্যের প্রায় সব অঙ্গনেই তার মেধার স্বাক্ষর তিনি রেখেছেন। মহাকাল তো কত কিছুই নিয়ে নেয়। কত মানুষ বিস্মৃত হয় তবুও তার উপন্যাসের এই পঙক্তির মত করেই বিশ্বাস করি জহির রায়হান হারিয়ে যাবেন না বরং ‘আসছে ফাল্গুনে আমরা কিন্তু দ্বিগুণ হব’।

বাংলাদেশ সময়: ১২১৯ ঘণ্টা, আগস্ট ১৯, ২০২২
এমকে/এনএইচআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।