মৌলভীবাজার: পেশার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে ভালোবাসা। যে পেশায় হৃদয়ের ভালোবাসার কোনো সংমিশ্রণ নেই– সে পেশায় টিকে থাকতে প্রতিনিয়তই রয়েছে ঝুঁকি।
দীর্ঘকালের পথপরিক্রমা! জীবনসায়াহ্নে এসেও মৃৎশিল্পের পেশাকে আজো জীবনের সঙ্গী বলেই মনে হয় তার। প্রতিদিন কাকডাকা ভোর তার জন্য নিয়ে আসে কর্মপ্রেরণা। সেই মানুষের নাম বিনয় পাল। মাটি ভালোবেসেই তিনি পার করে দিচ্ছেন একটা জীবন।
সম্প্রতি এক সকালে দেখা গেল পাকা সড়কের ধার ধরে ছুটে চলেছেন ফেরিওয়ালা বিনয় পাল। কাঁধে করে ভারবহনের কারণে তাকে দূর থেকে কিছুটা কুঁজো মনে হলো।
কথা প্রসঙ্গে তিনি বললেন, প্রায় চল্লিশ বছর ধরে মাটির জিনিসপত্র বিক্রি করে সংসার চালাচ্ছেন। খুব ভোরে উঠে শ্রীমঙ্গল শহর থেকে বিভিন্ন গ্রামে ছুটে যান সপ্তাহে ছয়দিন। একদিন ঘরে থেকে শরীরটাকে আরাম দেন।
এই কঠিন পেশা কেন?– এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আর তো কোনো কাজ তেমনভাবে শিখিনি। আর মাটির জিনিসপত্র বিক্রি করতেই আমার খুব ভালো লাগে। তাই তো আজও ছাড়তে পারি না এই পেশা। আমার বাড়িতেও আমি মাটির জিনিসপত্র বেশি ব্যবহার করি। শুনেছি প্লাস্টিকের চেয়ে এই মাটির জিনিসগুলো নাকি মানুষের শরীর ও স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারী। ’
পরিবার-সংসার প্রসঙ্গ আলোচনায় তিনি বলেন, আমার স্ত্রী এবং তিন মেয়ে, এক ছেলে নিয়ে আমার সংসার। মানুষের সায়সাহায্য এবং আল্পকিছু ঋণকর্য করে দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছি কোনো মতে। আরেকটা মেয়ে সেও বিয়ের উপযুক্ত। আর ছেলেটার বয়স দশ। পার্শ্ববর্তী স্কুলে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। মেয়েদের আমি কষ্টমষ্ট করে মেট্রিক (এসএসসি) পর্যন্ত পড়াইছি। তারপর ভালো ভালো পরিবার থেকে বিয়ের আলাপ আসায় আর দেরি করিনি। আমার পূর্বপূরুষসহ যারা আমাকে ভালোবাসেন তাদের আশির্বাদে মোটামুটি ভালো জায়গায় দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি। সুখেশান্তিতে আছে ওরা।
ভারে মাটির জিনিসপত্রের নাম ও সংখ্যা জানতে চাইলে তিনি জানান, তেরোটা মাটির ঘট, আটটা আরতির ধুপদানি, তিন আকৃতির ছয়টা পাতিল, কয়েকটা চাটাপ্রদীপ, তেরোটা মাটির কাই, মাটির কাইসহ ৮টা আইটেমের প্রায় ৮০টি মাটির জিনিস রয়েছে আমার এই ভারে। মাটির এই জিনিসগুলোর ওজন অনেক বেশি। এগুলো শ্রীমঙ্গল শহর থেকে ডলুছড়া পৌঁছে দিতে হবে। পিকআপ গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছি। গাড়িতে করে গেলে তাড়াতাড়ি গন্তব্যে যেতে পারবো এবং বিক্রিবাট্টাও ভালো হবে।
দৈনিক মূলধনের প্রসঙ্গে মাটির এই ফেরিওয়ালা বলেন, আমার আজকের এই ভার মালামাল কিনতে খরচ হয়েছে প্রায় পাঁচশত টাকা। সারাদিনে বিক্রি করতে পারলে মোটামুটি এক হাজার টাকায় সবগুলো মাটির জিনিস বিক্রি করা সম্ভব হবে। তাতে দৈনিক ৫০০-৭০০ টাকা গড়ে আয় হয়। কিন্তু বর্তমান বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের যে দাম কিছুতেই সামলাতে পারি না।
‘এখন তো মাটির জিনিসপত্র শহরে তেমন চলে না। গ্রামগঞ্জে গেলে মোটামুটি ভালো বিক্রি হয়। প্লাস্টিকের জিনিসপত্র এসে মাটির শিল্প ধ্বংস করে দিয়েছে’ - দুঃখ প্রকাশ করে এই বেদনাভরা কথাগুলো বিনয়ের সাথে বলেন বিনয় পাল।
বাংলাদেশ সময়: ২১১০ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৮, ২০২২
বিবিবি