ঢাকা, রবিবার, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫

ফুটবল

অমলেশ সেনের সব কষ্ট ভুলিয়ে দিয়েছে স্বাধীনতার আনন্দ

মহিবুর রহমান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৩৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৫, ২০১৬
অমলেশ সেনের সব কষ্ট ভুলিয়ে দিয়েছে স্বাধীনতার আনন্দ আমলেশ সেন/ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

অস্ত্র হাতে সম্মুখযুদ্ধে অংশ না নিয়েও দেশ মাতৃকার কল্যাণে নিজেকে আত্মনিয়োগ করা যায়, সঁপে দেয়া যায় জন্মভূমির মুক্তির লড়াইয়ে। এমন মহতী উদ্দেশ্য নিয়ে ১৯৭১ সালে পশ্চিম পাকিস্তানের হাত থেকে পরাধীন বাংলাদেশের স্বাধীনতার লাল সূর্য এনে দিতে অবদান রেখেছিলেন এদেশের সব পেশার মানুষ।

ঢাকা: অস্ত্র হাতে সম্মুখযুদ্ধে অংশ না নিয়েও দেশ মাতৃকার কল্যাণে নিজেকে আত্মনিয়োগ করা যায়, সঁপে দেয়া যায় জন্মভূমির মুক্তির লড়াইয়ে। এমন মহতী উদ্দেশ্য নিয়ে ১৯৭১ সালে পশ্চিম পাকিস্তানের হাত থেকে পরাধীন বাংলাদেশের স্বাধীনতার লাল সূর্য এনে দিতে অবদান রেখেছিলেন এদেশের সব পেশার মানুষ।

হাতে অস্ত্র নেই তারপরেও কীভাবে মুক্তির সংগ্রামে অংশ নেয়া যায়? আর তারাই বা কারা? অবশ্যই যায়। লাল-সবুজের মুক্তিকামী মানুষ তাই করে দেখিয়েছেন। নিরস্ত্র থেকেও গান, কবিতা, নাটকের মধ্য দিয়ে সম্মুখ যোদ্ধাদের উৎসাহ যুগিয়ে, আশ্রয় দিয়ে, খাবার সরবরাহ করে, আহতদের চিকিৎসা দিয়ে, পাক হানাদারদের বর্বতার খবর জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মাধ্যমে প্রচার করে উত্তাল সেই দিনগুলোতে অবদান রেখেছিলেন এদেশের ডাক্তার, শিক্ষক, সাংবাদিক, ছাত্রসহ মুক্তিকামী সবাই।

বসে ছিলেন না এ দেশের ফুটবলাররাও। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে বিভিন্ন ক্যাম্পে অবস্থানরত বাংলার একঝাঁক দামাল ছেলেদের নিয়ে তৎকালীন সময়ে গড়ে তোলা হয়েছিল স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল।

স্বাধীন বাংলা ফুটবল একটি সংগঠন যার সদস্যরা মুক্তির সংগ্রামের সময় দেশ ছেড়েছিলেন মাতৃভূমির পক্ষে জনসমর্থন আদায় ও এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যার্থে অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে। আর এই কাজটি তাঁরা করেছেন প্রতিবেশী দেশ ভারতের বিভিন্নস্থানে প্রদর্শণী ফুটবলে অংশ নিয়ে।

স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের সদস্য হতে বিভিন্ন ক্যাম্প থেকে এসেছিলেন হাজার হাজার তরুণ। কিন্তু সেই দলে সবার জায়গা হয়নি। যাচাইবাছাই শেষে নির্বাচন করা হয়েছিল ৩২ জনকে। আর তাদের নিয়েই গঠন করা হয়েছিল স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল।

সেই দলে ছিলেন: ননী বসাক (কোচ), জাকারিয়া পিন্টু (অধিনায়ক), প্রতাপ শংকর হাজরা (সহ-অধিনায়ক), আমলেশ সেন, খন্দকার নুরুন্নবী, আলী ইমাম, কায়কোবাদ, আইনুল হক, বিমল কর, আশরাফ আলী, শাহজাহান আলম, শেখ মনসুর আলী লালু, এনায়েতুর রহমান, নওশেরউজ্জাসান, সুভাষ চন্দ্র সাহা, ফজলে সাদাইন খোকন, কাজী মো: সালাহউদ্দিন, আব্দুল হাকিম, মো: তোসলেম উদ্দিন শেখ, আমিনুল ইসলাম সুরুজ, আব্দুল মোমেন জোয়ার্দার, মনিরুজ্জামান পেয়ারা, ‍অনিরুদ্ধ চ্যাটার্জি, আব্দুস সাত্তার, গোবিন্দ কুন্ড, নিহার কান্তি দাস, মজিবুর রহমান, লুতফর রহমান খান, সঞ্জিত কুমার দে, মাহমুদুর রহমান রশিদ, সাইদুর রহমান প্যাটেল ও দেওয়ান মো: সিরাজউদ্দিন সিরাজ। তানভির মাজহার তান্না ছিলেন টিম মানেজার।

দল গঠনের প্রথমদিকে সদস্যরা সবাই থাকতেন কলকাতার কার্নানি স্ট্রিটে। পরে আগস্টের শেষে সবাই চলে আসেন চৌরঙ্গির মল্লিক ম্যানশনে, জানালেন স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের সদস্য অমলেশ সেন।

আমলেশ সেন/ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

কেমন ছিল কলকাতায় আপনাদের সেই দিনগুলো? জানতে চাইলে অমলেশ সেন জানান, ‘ওইখানে আমরা দুইটি ছোট ছোট কক্ষে থাকতাম। ১৫ কি ১৬ জন গাদাগাদি করে এক কক্ষে আমরা ঘুমাতাম, খাওয়া-দাওয়া করতাম। শোয়ার সময় আমাদের মধ্যে ব্যবধান থাকতো মাত্র ছয় ইঞ্চি বা তারও কম। মানে পা ফেলার মত পর্যাপ্ত জায়গাও ছিল না। পানি থেকে শুরু করে সব কিছুরই কষ্ঠ ছিল। বাথরুম ছিল দুইটি। একই বিছানা এবং অপরিচ্ছন্ন কক্ষে থাকতে থাকতে আমাদের অনেকেরই চর্মরোগ হয়ে গিয়েছিল। আবার কারও চোখে ইনফেকশন হয়ে গিয়েছিল। ’

‘তবে এই কষ্টকে আমরা কোন কষ্টই মনে করিনি। দেশের জন্য এতটুকু ত্যাগ কোন ব্যাপারই মনে হয়নি। তবে নিজেকে স্বার্থক মনে হয়েছে দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে। এখন মনে হয় দেশের জন্য কিছু একটা করেছি। ’ যোগ করেন অমলেশ।

এই দল নিয়ে আপনারা কতগুলো ম্যাচ খেলেছিলেন এবং কয়টিতে জিতেছিলেন? উত্তরে অমলেশ সেন জানালেন, ‘যতটুকু মনে পড়ে ১৯৭১ এর জুন থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত মোট ১৪টি ম্যাচ খেলেছি। এর মধ্যে ৩টিতে হেরেছি বাকি ১১টিতেই জিতেছি। এর মধ্যে প্রথম ম্যাচটি ছিল নদীয়া একাদশের বিপক্ষে ১৯৭১ এর ২৪ জুলাই যা ২-২ গোলে ড্র হয়। ’

দ্বিতীয়টি গোষ্ঠপাল একাদশ, তৃতীয়টি দক্ষিণ কলকাতা (রবীন্দ্র সরোবর) একাদশ, চতুর্থটি নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন একাদশ, পঞ্চমটি দূর্গাপুর একাদশ, ষষ্ঠটি বর্ধমান একাদশ, সপ্তমটি পূর্ণিয়া একাদশ, অষ্টমটি সিওয়াল একাদশ, নবমটি উত্তরপ্রদেশ একাদশের বিপক্ষে বানারসে, দশমটি আসানসোল একাদশ, একাদশটি মহারাষ্ট্র একাদশ (অধিনায়ক ছিলেন মনসুর আলী খান পতৌদি),  দ্বাদশ ও ত্রয়োদশটি ছিল বালুঘাট একাদশ আর চতুর্থদশটি ছিল মুর্শিদাবাদ একাদশের বিপক্ষে।

তবে এই সবকটি ম্যাচের মধ্যে অমলেশ সেনের মানষপটে দাগ কাটে ‘বোম্বে স্পোর্টস উইক’র আয়োজনে মাহারাষ্ট্র একাদশের বিপক্ষে ওই ম্যাচটি, ‘ওই ম্যাচে বোম্বে একাদশ অংশ নিয়েছিল। দলটির অধিনায়ক ছিলেন পতৌদির নবাব মনসুর আলী খান। ম্যাচের প্রথমার্ধ পর্যন্ত উনি খেলেছেন এবং ঠাট্টা করে সতীর্থদের বলেছেন, এরা সবাই মুক্তিযোদ্ধা। তোমরা খেলতে গিয়ে উনাদের আহত করো না। শর্মীলা ঠাকুর আমাদের খেলা দেখতে এসেছিলেন। খেলার পরে আমাদের সাথে দেখা করেছেন এবং  ভারতীয় টাকার ৫০ হাজার রুপি আমাদের হাতে তুলে দিয়েছেন। ওখানে ভারতের নামকরা গায়ক শচীন দেব বর্মণ ও আগরতলার রাজপরিবারের ছেলেও উপস্থিত ছিলেন। ’

এই ক’টি ম্যাচ খেলে ওই সময়ের প্রেক্ষপটে বেশ ভালো পরিমান অর্থ বাংলাদেশ সরকারের হাতে দিতে পেরেছিল স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলটি বলে জানালেন এই স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের সদস্য।

ক্রান্তিকালীন সময়ে জন্মভূমিকে এভাবে সাহায্য করতে পেরে স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরেও গর্বে ভোরে উঠে অমলেশ সেনের বুক।

বাংলাদেশ সময়: ১৬৩০ ঘণ্টা, ১৫ ডিসেম্বর ২০১৬
এইচএল/এমআরএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।