ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

স্বাস্থ্য

স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দের পাশাপাশি ব্যয়ের সক্ষমতা বাড়ানোর তাগিদ

রেজাউল করিম রাজা, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪২১ ঘণ্টা, জুন ১০, ২০২৩
স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দের পাশাপাশি ব্যয়ের সক্ষমতা বাড়ানোর তাগিদ প্রতীকী ছবি

ঢাকা: স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ খাতে এবার ৩৮ হাজার ৫২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। বিদায়ী অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ৩৬ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা।

সে হিসেবে বিদায়ী বাজেটের তুলনায় বরাদ্দ এবার বেড়েছে ১ হাজার ১৮৯ কোটি টাকা।  

মোট বাজেটের খাতওয়ারি বরাদ্দের নিরিখে এবার স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ কমেছে। গত বছর মোট বাজেটের বিপরীতে স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ ছিল ৫ দশমিক ৪ শতাংশ, এবার সেটি হয়েছে ৫ শতাংশ। গত বছরের বরাদ্দের তুলনায় উন্নয়ন ব্যয় ১৭ শতাংশ কম প্রস্তাব করা হয়েছে।

স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দের বিষয়ে কিছুটা অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, নতুন বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৩৮ হাজার ৫২ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ৫ শতাংশ। আগের অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ রাখা হয় মোট বাজেটের ৫ দশমিক ৪ শতাংশ বা ৩৬ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা। স্বাস্থ্যসেবার যে পরিধি বেড়েছে, সে অনুযায়ী বরাদ্দ আরও কিছুটা বাড়ানো প্রয়োজন ছিল।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক স্বাস্থ্যখাতে বাজেট বরাদ্দ আরও বাড়ানোর কথা বললেও বাস্তবতা হচ্ছে এ অপ্রতুল অর্থও খরচ করতে পারে না স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। বাজেট বাড়ানোর পাশাপাশি বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয়ের সক্ষমতা বাড়ানোর পক্ষে মতামত জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়নের (আইএমইডি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থ বছরে স্বাস্থ্য বিভাগ বরাদ্দের ২৯ শতাংশ খরচ করতে পারেনি। এ অর্থ বছরের বাজেটে বরাদ্দ ছিল ১৩ হাজার ১৭ কোটি টাকা, খরচ হয়েছিল ১০ হাজার ২৯২ কোটি টাকা।

২০২০-২১ অর্থ বছরে বাজেটে বরাদ্দের প্রায় ৪২ শতাংশ ফেরত যায়। ২০২০-২১ অর্থ বছরে বরাদ্দ ছিল ১২ হাজার ৯৮৯ কোটি টাকা। সে সময় ৬ হাজার ৯৩৩ কোটি টাকা ব্যয় হয়।

২০১৯-২০ অর্থ বছরে বরাদ্দ ছিল ৭ হাজার ৭৬১ কোটি টাকা। এর ৫ হাজার ৭৪১ কোটি টাকা খরচ হয়। বরাদ্দের ২৬ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ টাকা অব্যবহৃত থাকে।

২০১৮-১৯ অর্থ বছরে বরাদ্দ ছিল ৮ হাজার ২৬১ কোটি টাকা। ব্যয় করা হয় ৭ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা। অব্যবহৃত অর্থের পরিমাণ ১১ দশমিক ২২ শতাংশ।   

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বাস্থ্য সেবা খাতে বরাদ্দ কমে গেলে, সরকারি স্বাস্থ্য সেবার মান খারাপ হবে। মানুষ চিকিৎসার জন্য বেসরকারি হাসপাতালমুখী হবে, এতে আবার মানুষের স্বাস্থ্য সেবা পেতে ব্যক্তিগত ব্যয় বেড়ে যাবে এবং সার্বজনীন স্বাস্থ্য সেবায় সরকারের অঙ্গীকার রয়েছে সেটিও ব্যাহত হবে। তাই বরাদ্দ বাড়ানোর পাশাপাশি, বরাদ্দকৃত অর্থের যথাযথ ব্যবহারের জন্য দক্ষ জনবল প্রয়োজন।   

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ বলেন, স্বাস্থ্য বাজেটে নতুন কোনো কিছুর রিফ্লেকশন নেই। পরিচালন বাজেট ২৪ শতাংশ বেড়েছে, উন্নয়ন বাজেট ১৭ শতাংশ কমে গিয়েছে। স্বাস্থ্য খাতে সার্বিকভাবে বাজেট প্রায় তিন শতাংশ বেড়েছে। অন্যদিকে মুদ্রাস্ফীতি রয়েছে ৬ শতাংশ যেটা সরকার নিজেই শিকার করছে। বাস্তবে মুদ্রাস্ফীতি আরও অনেক বেশি। সুতরাং গত বছরের বাজেট দিয়ে যে পরিমাণ কর্মকাণ্ড করা গিয়েছিল, এবারের বাজেট দিয়ে সে পরিমাণ কর্মকাণ্ড করা সম্ভব নয়।

তিনি আরও বলেন, স্বাস্থ্য খাতে এখন যে পরিমাণ অর্থ প্রস্তাব করা হয়েছে তার তিনগুণ বরাদ্দ দেওয়া উচিত। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মতে এটি ১২ থেকে ১৫ শতাংশ হওয়া উচিত। বাজেট বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে সেটিকে কার্যকরভাবে ব্যয় করতে হবে। কিন্তু সে খরচ করার সক্ষমতা আমাদের নেই। আমাদের স্বাস্থ্য খাতে পদ্ধতির মধ্যে নানা ত্রুটি রয়েছে। এ ত্রুটির সঙ্গে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ভেতরের লোক এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত অন্যান্য মন্ত্রণালয় জড়িত রয়েছে। সে ত্রুটি মেরামত না করলে ব্যয় বাড়ানো যাবে না। ব্যয় বাড়ানোর সক্ষমতা গড়ে তোলার জন্য বিভিন্ন কার্যকর কর্মসূচি গ্রহণ করা দরকার।

স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ এবং ব্যয়ের বিষয়ে জানতে চাইলে জনস্বাস্থ্য এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক ও অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ বলেন, আমরা যদি আমার আমাদের স্বাস্থ্য খাতকে কল্যাণমুখী এবং সার্বজনীন করতে চাই তাহলে বাজেট অবশ্যই বাড়াতে হবে। বাজেটে বরাদ্দকৃত টাকা শতভাগ কিংবা শতভাগের কাছাকাছি ব্যয় করতে হবে। চলতি বছরের প্রথম ১০ মাসে বরাদ্দকৃত বাজেটের প্রায় ৩৩ শতাংশ খরচ করা হয়েছে। বাকি মাসে হয়তো বিভিন্ন বিল এবং খরচ মিলে এটা ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ হবে। অর্থাৎ বরাদ্দকৃত টাকার ২০ শতাংশই যখন খরচ হচ্ছে না।  

তিনি আরও বলেন, অথচ স্বাস্থ্য খাতে আমাদের ব্যক্তিগত ব্যয় ৬৯ শতাংশ। এর দুটি মূল কারণ চিহ্নিত হয়েছে, একটি হচ্ছে বেসরকারিভাবে বিভিন্ন রোগের পরীক্ষা-নিরীক্ষা, দ্বিতীয়ত সরকারি হাসপাতাল থেকে ওষুধপত্র না দিয়ে বাইরে থেকে কেনার জন্য প্রেসক্রিপশন করে দেওয়া। স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ কমে গেলে মানুষের ব্যক্তিগত খরচ আরও বেড়ে যাবে। বরাদ্দকৃত টাকা খরচ হয় না কেন সেই কারণগুলো খুঁজে বের করতে হবে। ‌ কারণগুলো উদঘাটন করে যদি নিরসন না করা হয়, তাহলে বরাদ্দকৃত অর্থ খরচ হবে না। এটি চলতে থাকলে সরকারি খাত থেকে জনগণ স্বাস্থ্য সেবায় বঞ্চিত হবে, একপর্যায়ে বেসরকারি চিকিৎসার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। সুতরাং বাজেট বাড়াতে হবে এবং ব্যয়ের সক্ষমতাও বাড়াতে হবে।

বিশিষ্ট চিকিৎসা বিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ডা. লিয়াকত আলী বলেন, এবার সার্বিকভাবে বাজেট ১২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, সেখানে স্বাস্থ্য খাতে ৩. ১৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। মুদ্রাস্ফীতির তুলনায় স্বাস্থ্য খাতের এ বাজেট অনেক কম। স্বাস্থ্য খাতের আগের মান ধরে রাখতে চাইলেও সেটি এ বাজেট দিয়ে সম্ভব নয়। বাজেট কিন্তু শুধুই অংক নয়, বাজেট অর্থ খতিয়ে দেখা খরচটা হয় না কেন। কি করলে ব্যয় হবে সেখানে কোনো বাজেটের প্রয়োজন রয়েছে কিনা সেটিও খতিয়ে দেখা। স্বাস্থ্য খাতের যেভাবে বৃদ্ধি হয়েছে সে তুলনায় যথাযথ এবং দক্ষ জনবলের বৃদ্ধি ঘটেনি। বাজেটে দিকনির্দেশনা থাকতে হবে কেন ব্যয় হচ্ছে না, আমাদের পরিকল্পনা এবং বাজেট বরাদ্দে কোনো ঘাটতি, ত্রুটি রয়েছে কিনা?

তিনি আরও বলেন, গতবার বাজেট ছিল ৫.৪ শতাংশ এবার সেটি ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হলো। ‌যেখানে আমাদের অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় পর্যায়ক্রমে ১১ দশমিক এক শতাংশ নিয়ে যাওয়ার কথা। সেখানে আমরা এ বছর ৫ শতাংশে নামিয়ে দিলাম। সুতরাং এটি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। সত্য বলতে স্বাস্থ্য খাতকে যেভাবে মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন ছিল সেটি হলো না। স্বাস্থ্য খাতে সরকারের অংশগ্রহণ যদি দ্রুত বাড়ানো না যায় তাহলে মানুষের ব্যক্তিগত খরচ বাড়তেই থাকবে এবং জনগণ আরও দুঃসহনীয় অবস্থায় পড়বে।

বাংলাদেশ সময়: ১৪২১ ঘণ্টা, জুন ১০, ২০২৩
আরকেআর/জেএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।