নোয়াখালী: হাসপাতালে ভর্তিকৃত রোগীদের প্রায় ৮৮ ভাগেরই এর কল্যাণ তহবিল সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই।
৭৭ ভাগ রোগী চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী হাসপাতাল থেকে প্রয়োজনের তুলনায় খুব কম ওষুধ পান।
সম্প্রতি নোয়াখালীতে সুশাসনের জন্য প্রচারাভিযান (সুপ্র) পরিচালিত স্বাস্থ্যসেবা পরিস্থিতি নিয়ে এক সামাজিক জরিপের প্রতিবেদনে এমনটাই বলা হয়েছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, সব শ্রেণি-পেশার মানুষই সরকারি স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণে আগ্রহী। এক্ষেত্রে সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান ও দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরাও তৎপর রয়েছেন। তবে সমন্বয়ের অভাবে ব্যাহত হচ্ছে স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির প্রক্রিয়া।
কিছু প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসা উপকরণ পর্যাপ্ত থাকলেও অবকাঠামো নাজুক। আবার কোথাও অবকাঠামো আধুনিক পর্যায়ের হলেও চিকিৎসা উপকরণ ও জনবলের ঘাটতি রয়েছে।
সুপ্র এ জরিপের জন্য নোয়াখালীর বেশ কয়েকটি স্বাস্থ্যকেন্দ্র পর্যবেক্ষণ করে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, বেগমগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, একলাশপুর কমিউনিটি ক্লিনিক ও আলাইয়াপুর ইউনিয়ন স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র।
এ জরিপের উদ্দেশ্য ছিলো, সরকারি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের সীমাবদ্ধতা দূর, কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি, দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য অধিকার নিশ্চিত করা, জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি, জনমত তৈরি এবং প্রয়োজনীয় সুপারিশ বাস্তবায়নের লক্ষে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে পরামর্শ করা।
কমিউনিটি ক্লিনিকের চিকিৎসা সেবা:
সুপ্রর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জেলার অধিকাংশ কমিউনিটি ক্লিনিকে প্রসূতি ও নবজাতকের জন্য সেবার ব্যবস্থা রয়েছে এবং সব ধরনের ওষুধ পাওয়া যায়। ক্লিনিকগুলোতে বিদ্যুতের ব্যবস্থা নেই, তবে শৌচাগার পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন।
এছাড়া কমিউনিটি ক্লিনিকে যে ম্যানেজমেন্ট কমিটি রয়েছে প্রতিমাসে নিয়মিত তারা মিটিং করেন।
তথ্যদাতা রোগীরা জানান, এখানে চিকিৎসকরা রোগীদের সময় নিয়ে পরীক্ষা করেন। রোগীদের মতামত, অভিযোগ এবং পরামর্শ গ্রহণের জন্য রেজিস্ট্রার রয়েছে, যা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা হয়।
প্রতিবেদনে কমিউনিটি ক্লিনিকের জন্য যে সুপারিশ করা হয়েছে তা হলো, নবজাতকের সেবার মান নিশ্চিত করা, ম্যানেজমেন্ট কমিটির মিটিং নিয়মিত ও কার্যকর করা, সেবার মান বহুমুখী ও জনগণকে সচেতন করা, সেবা গ্রহীতাদের মধ্যে কমিউনিটি ক্লিনিক সম্পর্কে আস্থা তৈরি করা এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নে জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণ।
ইউনিয়ন স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের চিকিৎসা সেবা:
ইউনিয়নের স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে আসা রোগী ও তাদের স্বজনদের তথ্য অনুযায়ী প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এখানে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, যন্ত্রপাতি, চিকিৎসা উপকরণ ও পর্যাপ্তসংখ্যক কর্মচারী নেই। এসব কেন্দ্রে শুধু প্রসূতি সেবা ও সর্দি-জ্বরের চিকিৎসা দেওয়া হয়।
এছাড়া জ্বর, সর্দি-কাশি, পরিবার পরিকল্পনা ও ডায়রিয়ার ওষুধ দেওয়া হয়।
তথ্যদাতারা আরো জানিয়েছেন, এসব কেন্দ্রে বিশুদ্ধ খাবার পানির ব্যবস্থা নেই এবং টয়লেটের পরিবেশ অপরিচ্ছন্ন।
ইউনিয়ন স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের মানোন্নয়নে যে সুপারিশ করা হয়েছে তা হলো, প্রয়োজনীয় ওষুধ ও বিশেষজ্ঞ সেবা প্রদানকারীর উপস্থিতি নিশ্চিত করা, প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, যন্ত্রপাতি, চিকিৎসা উপকরণ ও পর্যাপ্তসংখ্যক কর্মচারীর ব্যবস্থা করা, বিশুদ্ধ খাবার পানির ব্যবস্থা রাখা এবং পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে আরো যত্নবান হওয়া।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসা সেবা:
উপজেলার স্বাস্থ্য বিষয়ে জরিপের জন্য তিনজন নারী ও দুইজন পুরুষের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে। এদের মধ্যে একজন সেকমো, একজন স্টোর কিপার, একজন নার্স, একজন ল্যাব টেকনিশিয়ান ও একজন ফার্মাসিস্ট রয়েছেন।
এদের মধ্যে শতকরা ৬০ ভাগ উত্তরদাতা জানিয়েছেন, সেবাকেন্দ্রগুলোতে টেলিমেডিসিনের ব্যবস্থা আছে। ৪০ ভাগ বলেছেন, কেন্দ্রগুলোতে মা ও শিশুসেবার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই। ৪০ ভাগের মত সেবা গ্রহণকারীর অনুপাতে প্রয়োজনীয় কর্মী ও উপকরণ নেই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে।
তারা বলেছেন সব কেন্দ্রেই অ্যাম্বুলেন্স সচল থাকলেও ভাড়ার তালিকা রয়েছে শতকরা ৬০ ভাগ ক্ষেত্রে। সব কেন্দ্রে বিদ্যুতের ব্যবস্থা ও বিকল্প বিদ্যুতের ব্যবস্থা রয়েছে।
৮০ ভাগ উত্তরদাতা জানান, কেন্দ্রগুলোতে বিনামূল্যে যে ওষুধ পাওয়া যায় তা পর্যাপ্ত নয়। ৪০ ভাগের দাবি ওষুধসহ অন্যান্য সুবিধা ও সরকারি ভর্তুকির ব্যাপারে তারা জানেন না।
এদিকে, জরিপকালে উপজেলা পর্যায়ে ১৭ জন রোগীর সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। এদের মধ্যে ৮ জন অভ্যন্তরীণ ও ৯ জন বর্হিবিভাগের রোগী। এদের মধ্যে ৯ জন নারী ও ৮ জন পুরুষ।
এ তথ্যদাতাদের ৪৭ ভাগ জানান, কেন্দ্র যেসব সেবা পাওয়া যায় সে সম্পর্কে তারা জানেন। ৪১ ভাগ রোগী বলেছেন চিকিৎসকের সাক্ষাৎ পেতে তাদের বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয় না।
৭৭ ভাগের দাবি চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী খুব কম ওষুধই তারা কেন্দ্র থেকে পান। ২৪ ভাগ জানান, তারা স্বাস্থ্যসেবা ও ওষুধে সরকারি ভর্তুকির কথা জানেন।
মাত্র ১৮ ভাগ রোগী স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা করান। অভ্যন্তরীণ রোগীদের প্রায় সবাই ওয়ার্ডে সিট পান। সমানসংখ্যক রোগী নার্স ও চিকিৎসকের সেবার মান নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন। এছাড়া ভর্তিকৃত রোগীদের প্রায় ৮৮ ভাগেরই হাসপাতালের কল্যাণ তহবিল সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই।
উপজেলা স্বাস্থ্যসেবার মানের উন্নয়নের যে প্রতিবন্ধকতা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে তা হলো, প্রতিটা পর্যায়েই সেবার মান উপরিকাঠামোর দুর্বলতার জন্য বাধাগ্রস্ত হয়, মানুষ সেবা ও সেবা প্রদানের প্রক্রিয়ার সঙ্গে পরিচিত নয়, তাদের সেবা সম্পর্কে সঠিক তথ্য প্রদান করা হয় না, জনবল সংকট, বাজেট স্বল্পতা এবং মনিটরিং অবস্থা দুর্বল।
সুপ্রর নোয়াখালী জেলার সাধারণ সম্পাদক নুরুল আলম মাসুদ বাংলানিউজকে জানান, সরকারের দায়িত্ব প্রতিটি নাগরিকের স্বাস্থ্যসেবার অধিকার নিশ্চিত করতে উপযুক্ত ও পরিপূর্ণ ব্যবস্থা গ্রহণ করা। এছাড়া জনগণের জন্য দেওয়া সুবিধার সঠিক বাস্তবায়ন হচ্ছে কিনা তা ফলোআপ করা এবং প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করা।
সুপ্রর স্বাস্থ্যসেবা পরিস্থিতি নিয়ে সামাজিক জরিপকে সাধুবাদ জানিয়ে জেলা সিভিল সার্জন ডা. দেলোয়ার হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, তাদের এই প্রতিবেদনকে গুরুত্ব দিয়ে আমরা স্বাস্থ্য গ্রহণ ও প্রদানে সমন্বয়ের ক্ষেত্রে আরো কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করবো।
বাংলাদেশ সময়: ০৯২৪ ঘণ্টা, মার্চ ২২, ২০১৫